অভিন্ন লক্ষ্য বেলজিয়ামেরও। না, ট্রফি জেতার স্বপ্নের মায়াঞ্জন এঁকে ব্রাজিলে পা রাখেনি তারা। তবে কোয়ার্টার ফাইনাল দ্বৈরথের আগে সেমি-ফাইনালের স্বপ্ন কেন দেখবে না? না হয় তাদের দলে একজন লিওনেল মেসি নেই। কিন্তু ভিনসেন্ট কম্পানি, এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রুইন, রোমেলু লুকাকু, টমাস ভারমিলেন, থিবো কর্তোয়াদের নামে অনেকে তো আছেন। দল হিসেবে যাদের শক্তি সমীহ জাগানিয়া। আর আর্জেন্টিনার মতো চলতি বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম চার ম্যাচ জয়ের শতভাগ রেকর্ড বেলজিয়ামেরও। অঘটনের স্বপ্ন বুকে পুষে তাই আজ মাঠে নামবে মার্ক উইলমটসের শিষ্যরা।
লড়াইটা তবে কি মেসির সঙ্গে বেলজিয়ামের? প্রসঙ্গটি সামনে আসছে সেই মারাদোনার জন্যই। ‘আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর’-এর বাঁ পায়ে বল; তাঁর সামনে ছয়-ছয়জন বেলজিয়ামের ফুটবলার। বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ছবিগুলোর একটি। ১৯৮২ আসরে ক্যামেরাবন্দী হয়েছিল যে অনন্য মুহূর্তটি। ৩২ বছর পর সেই দিয়েগো মারাদোনার জাতিস্মর হয়ে আছেন লিওনেল মেসি। সামনে আবার সেই বেলজিয়াম। বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত দশটায় ব্রাজিলিয়ার জাতীয় স্টেডিয়ামে কোয়ার্টার-ফাইনালে তাদের মুখোমুখি হচ্ছে যে আর্জেন্টিনা! সেখানে পূর্বসুরির মতো অমন কোন অবিস্মরণীয় ছবির জন্ম দিতে পারবেন মেসি?
১৯৮২ সালের গ্রুপপর্বের সেই ম্যাচটি কিন্তু জেতেনি আর্জেন্টিনা। জিতেছিল চার বছর পরের সেমি-ফাইনালে। ২-০ ব্যবধানে জেতা ম্যাচে দুটি গোলই মারাদোনার। এর মধ্যে দ্বিতীয় গোলটি তো টুর্নামেন্টসেরাই হতে পারত, যদি না ঠিক আগের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অপার্থিব গোলটি করতেন তিনি। তাই বিরাশির মারাদোনার ওই টুকরো ছবি না, ১৯৮৬ সালের মারাদোনার এই পূর্ণ ছবির উদ্ভাসিত রূপের প্রতিফলনই আজ মেসিতে দেখতে চাইবে আর্জেন্টিনা। ২৮ বছর বাদে বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের স্বপ্নপূরণের পথে সেটি বড্ড প্রয়োজনও।
তবে দল হিসেবে বেলজিয়াম বেশ শক্তিশালী। কোনো কোনো বিশ্লেষকের চোখে এমনকি আর্জেন্টিনার চেয়েও। কিন্তু ব্যক্তিনৈপুণ্যের ঝলকে যে অনেক এগিয়ে দু’বারের চ্যাম্পিয়নরা! সেই ঝলক দিয়েই তো বিশ্বকাপে গড়পড়তা খেলেও চারটি ম্যাচে পার পেয়ে গেছে আর্জেন্টিনা। ম্যাচের পর ম্যাচ তাদের ত্রাতা হয়ে উদ্ধার করেছেন মেসি। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে গোল দিয়ে আর দ্বিতীয় রাউন্ডে জাদুকরী পাসে গোলমুখ খুলে দিয়ে। এ যেন সেই ’৮৬-র ম্যারাডোনার প্রতিফলন। আর্জেন্টিনার ওই দলটি ছিল ‘মারাদোনা ও সাদামাটা ১০ জন’। আর্জেন্টিনার এ দলটিও তেমনি ‘মেসি ও ১০ জন’! বেলজিয়াম যদি তাই আজ মেসিকে আটকাতে পারে, তাহলে দুবারের চ্যাম্পিয়নদের জয়রথ আটকে দেওয়াও সম্ভব। খুবই সম্ভব।
সাধারণে ধারণাটা এমন হলে কী হবে, মার্ক উইলমটস কিন্তু সেই তত্ত্বে মাথা ঘামাচ্ছেন না। শুধু মেসিকে নিয়ে না ভেবে পুরো আর্জেন্টিনা দল নিয়েই তাঁর চিন্তা। এক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে মেসিদের খেলা থেকে অনুপ্রেরণার অনেক উপাদান পাচ্ছেন বেলজিয়াম কোচ, “আমরা শুধু মেসিকে নিয়ে ভাবছি না। ভাবছি পুরো আর্জেন্টিনা দলকে কিভাবে ঠেকানো যায়। আর সুইসরা তো দেখিয়েছেই, তাদের বিপক্ষে কিভাবে ভালো খেলতে হয়।” মেসিকে সমীহ করলেও প্রতিপক্ষ দলের ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন আছে উইলমটমের, যেটি প্রকারান্তরে তার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক, “তিন সেন্টারব্যাক আর দুই ফুলব্যাক নিয়ে উপরে উঠে হাই প্রেসিং গেম খেলতে দেখেছি আর্জেন্টিনাকে। সেখানে দি মারিয়াকে দেওয়া থাকে ওপর-নীচে নামার অবাধ স্বাধীনতা। তবে এই দলটির খেলায় কখনো-কখনো ভারসাম্যের অভাবও দেখেছি আমি।” আজ সেই ‘ভারসাম্যহীনতা’র সুযোগ কাজে লাগাতে নিশ্চয়ই ছক কাটছেন বেলজিয়াম কোচ।
আর আর্জেন্টিনা কোচের বাজির ঘোড়া সেই মেসি। তার উপর ম্যাচের পর ম্যাচ যে নির্ভর করতে হচ্ছে, এটি নিয়েও নির্ভার আলেহান্দ্রো সাবেইয়া, “আগেও বলেছি, আবার বলছি- মেসির মতো একজনের উপর দল সবসময় নির্ভর করেই। কেননা ও বিশ্বসেরা ফুটবলার। তবে আমরা দল হিসেবেও ভালো করার চেষ্টা করছি।” কোয়ার্টার-ফাইনালের প্রতিপক্ষ বেলজিয়াম যে দল হিসেবে দুর্দান্ত, সেটি মানেন তিনি। জানেন ’৮২-র ইতিহাসও, “এই বেলজিয়াম দলটি সত্যি ভালো। রীতিমতো ওদের দেশের সোনালী প্রজন্ম। ১৯৮২ বিশ্বকাপেও ওদের ছিল সোনালী প্রজন্ম এবং সেখানে আর্জেন্টিনাকে ওরা হারিয়েছিল।”
আর্জেন্টিনার বর্তমান দলটি তাদের সোনালী প্রজন্ম হয়তো নয়। কিন্তু ‘সোনার ছেলে’ মেসি যে আছেন এই দলের প্রানভোমরা হয়ে! যার মধ্যে মারাদোনার বিশ্বকাপ জয়ের সিংহাসনের উত্তরাধিকার খোঁজে আর্জেন্টিনা।
আজ দেশের জার্সি গায়ে মেসি খেলতে নামবেন ৯১তম ম্যাচ, যা হবে মারাদোনার খেলা ম্যাচের সমান। বেলজিয়ামের বিপক্ষে জিতলে আন্তর্জাতিক ম্যাচ সংখ্যায় ওই কিংবদন্তিকে এই বিশ্বকাপেই ছাড়িয়ে যাবেন মেসি। মারাদোনার সিংহাসনে বসার পাশেও কি আরেকধাপ এগোবেন না