ব্রাজিলে এবারের বিশ্বকাপ আসর বসতে দেখে আলাদা কৌতূহল ছিল ফুটবল ব্যক্তিত্ব ও বোদ্ধা বিশ্লেষকদেরও। বিশ্বকাপে সর্বাধিক পাঁচবারের শিরোপার গৌরব সাম্বা ছন্দের দেশ ব্রাজিলের। আর ফুটবলপাগল জাতি হিসেবে ব্রাজিলিয়ানদের আলাদা পরিচিতি। ২০১৪’র বিশ্বকাপ শেষ। এবার আপনি কি দেখলেন? আসর শেষে ফুটবলপ্রেমীদের হতাশ করেনি এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপ। অঘটন, হাসি-কান্না, চমকপ্রদ গোল, নতুন সব রেকর্ড এবারের বিশ্বকাপকে করেছে অনন্য। ব্রাজিলের ১২ শহরে বিশ্বকাপ ভেন্যুর গ্যালারিগুলোয় দর্শকের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে আসরের প্রতি ম্যাচেই। এতে দর্শক দেখেছেন এবার রেকর্ড সংখ্যক গোলও। জার্মানির এবারের সাফল্যে এ পর্যন্ত ২০ আসরে ১১ বার বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব দেখালো ইউরোপ। আমেরিকানরা বিশ্বকাপ জিতেছে বাকি ৯ বার। সুইডেনে ১৯৫৮’র আসরে বিশ্বকাপ জেতে লাতিন আমেরিকার ফুটবল শক্তি ব্রাজিল। তবে আমেরিকার মাটিতে ইউরোপিয়ানদের বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব ছিল না আগে। এবার ব্রাজিলের মাটিতে জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ে রচিত হলো নতুন ইতিহাস। এ নিয়ে টানা তিন বিশ্বকাপ জিতল ইউরোপ। এটাও রেকর্ড। এর আগে ২০০৬-এ ইতালি ও গতবার বিশ্বকাপ শিরোপা হাতে তোলে স্পেন। পাঠকের সামনে রইলো এবারের বিশ্বকাপের এমন কিছু টুকরো গল্প:
সাম্রাজ্যের পতন
নিজেদের টিকি-টাকা পাসিং ফুটবলে টানা অর্ধযুগ ফুটবল সৌকর্য দেখিয়েছে স্প্যানিয়ার্ডরা। ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত টানা দুই ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ ও একবারের বিশ্বকাপ জিতে নিয়ে ফুটবলে রাজত্ব গড়েছিল স্পেন। ব্রাজিলে এবারের বিশ্বকাপে ফুটবল দর্শকরা দেখলেন স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের পতন। গ্রুপের প্রথম ম্যাচে শিরোপাধারী স্পেন ৫-১ গোলে বিধ্বস্ত হয় নেদারল্যান্ডসের কাছে। এ ধাক্কা আর সামাল দিতে পারেনি স্প্যানিয়ার্ড। পরের ম্যাচে চিলির কাছে হার নিয়ে গ্রপ পর্ব থেকেই বিদায় নিশ্চিত হয় স্পেনের। বিশ্বকাপে এর আগে শিরোপধারী দলকে পরপর দুই ম্যাচে হারতে দেখা যায়নি। দলের বিদায়ে স্পেনের ইউরো ও বিশ্বকাপজয়ী কোচ দেল বস্ক বলেন, এবারের বিশ্বকাপে আমরা প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়েছি। দলের আমাদের সবাইকে দোষ দিন।
দুর্বার ‘টিকোস’
অন্যবারের মতো ব্রাজিল বিশ্বকাপেও শিরোপার লড়াইটা সীমাবদ্ধ ছিল ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার মধ্যেই। তবে এবার অন্য মহাদেশের দলগুলোর নৈপুণ্যও ছিল ইতিহাস গড়া। বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো দু’টি আফ্রিকান দেশ দ্বিতীয় রাউন্ডের যোগ্যতা দেখায় এবার। দ্বিতীয় রাউন্ডে ফ্রান্সের কাছে যাত্রা থামে আফ্রিকার সুপার ঈগল নাইজেরিয়ানদের। তবে আফ্রিকার অপর দল আলজেরিয়ার নৈপুণ্যটা ছিল আলোকিত। গ্রুপ ম্যাচে তারা দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারায় ৪-২ গোলে। বিশ্বকাপে ম্যাচে আফ্রিকান কোন দলের চার গোলের কৃতিত্ব ছিল না আগে। আর এবারের সেরা চমকটা মধ্য আমেরিকার দল কোস্টারিকার। তিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড, ইতালি ও উরুগুয়েকে পেছনে ফেলে গ্রুপ সেরার মর্যাদা নিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় টিকোস খ্যাত কোস্টারিকা। পরে তারা প্রথমবারের মতো পৌঁছে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। এখানে শক্তিধর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তারা হার মানে টাইব্রেকারে।
গোলির গ্লোরি
ফ্রান্সে ১৯৯৮’র পর বিশ্বকাপে সর্বাধিক ১৭১ গোল দেখা গেল এবার। তবে গোলবন্যার এ বিশ্বকাপে চমকপ্রদ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন এবারের গোলরক্ষকরাও। কোস্টারিকার কেইলর নাভাস, মেক্সিকোর গিলার্মো ওচোয়া, যুক্তরাষ্ট্রের টিম হাওয়ার্ড, জার্মানির ম্যানুয়েল নয়্যার, আর্জেন্টিনার সার্জিও রোমেরোরা আসর জুড়ে দেখিয়েছেন দারুণ সব সেভ। এতে মাঠের খেলায় দলে সুযোগ না পেয়েও টাইব্রেকারের ১০ মিনিটে নায়ক হয়ে ওঠেন নেদারল্যান্ডস গোলরক্ষক টিম ক্রুল। টাইব্রেকারে কোস্টারিকার দুই শট রুখে দিয়ে ক্রুল ডাচদের তুলে নেন সেমিফাইনালে। আর ৪৩ বছর বয়সে বিশ্বকাপ খেলে রেকর্ড গড়েন কলম্বিয়ান গোলরক্ষক ফরিদ মন্দ্রাগন ।
হিরো থেকে জিরো
ইনজুরি কাটিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জোড়া গোল নিয়ে জয়ের নায়ক হয়ে ওঠেন উরুগুয়ে স্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজ। তবে গ্রুপের শেষ ম্যাচে ইতালি ডিফেন্ডার জর্জিও কিয়েলিনিকে কামড়ের দায়ে ফিফা কর্তৃক ৯ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা পোহাচ্ছেন এ উরুগুইয়ান। এতে বিপর্যস্ত উরুগুয়ে দল দ্বিতীয় রাউন্ডে কলম্বিয়ার কাছে দেখায় ২-০ গোলের সহজ আত্মসমর্পণ।
স্কিল ও স্পোর্টসম্যানশিপ
৬ গোল নিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার এবারের গোল্ডেন বুট জিতেছেন কলম্বিয়ার হামেস রদ্রিগেস। দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিলের বিপক্ষে লড়াই শেষে ২-১ গোলে হার মানে কলম্বিয়া। এতে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যাচ্ছিল হামেসকে। এসময় হামেসকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এলেন ব্রাজিল তারকা ডেভিড লু্ইস। ব্রাজিল ডিফেন্ডার এসময় হামেসকে সান্ত্বনা দিতে আহ্বান রাখেন ফোর্তালেজা মাঠের গ্যালারির প্রতিও। আর স্বাগতিক সমর্থকে সয়লাব গ্যালারিও সাড়া দেন উৎফুল্ল করতালিতে।
সেলেসাওদের দুঃস্বপ্ন
সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হার মানে ব্রাজিল। পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ফুটবল ইতিহাসে বড় হারের রেকর্ড এটি। উরুগুয়ের কাছে ৬-০ গোলে হেরেছিল তারা ৯৪ বছর আগে। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচেও নেদারল্যান্ডসের কাছে ব্রাজিল হেরে যায় ৩-০ গোলে। এতে তারা স্পর্শ করে ৭৪ বছর আগের এক রেকর্ড। নিজ মাটিতে টানা দুই ম্যাচ হেরেছিল ব্রাজিল ১৯৪০ সালে। সেবার আর্জেন্টিনার কাছে ৩-০ ও পরের ম্যাচে উরুগুয়ের কাছে ব্রাজিল হার মানে ৪-৩ গোলে। এবারের বিশ্বকাপে মোট ১৪ গোল হজম করে ব্রাজিল। বিশ্বকাপে এর আগে তাদের সর্বাধিক ১১ গোল খেতে দেখা গিয়েছিল ১৯৩৮-এ।