যোগ্যরাই যেখানে সকাল-সন্ধ্যা ভিমরি খাচ্ছেন, সেখানে যোগ্য উত্তরসূরি নিয়ে ভাবনার অবকাশ কোথায়? তার ওপর সেটা যদি হয় মুখ থুবড়ে পড়া মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে, তবে তো এ নিয়ে কথাই চলে না। ঠিক এমন একটি সময়ে অন্ধকার টানেলের শেষ প্রান্তে নতুন আলোর রেখা দেখালেন আইয়ুব বাচ্চু এবং আহনাফ তাজোয়ার আইয়ুব। একজন বাংলাদেশ গিটার অধ্যায়ের জীবন্ত কিংবদন্তি। অন্যজন তারই যোগ্য উত্তরসূরি। রক্তের বিচারে দু’জন পিতা-পুত্র। রক্ত সব সময় কথা বলে না। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি রয়েছে এই সংগীতাঙ্গনে। তবে রক্ত এবার কথা বলেছে। জবাব দিয়েছে মুখে নয়, গিটার মূর্ছনায়। কিশোর পুত্র তাজোয়ারের গিটার বাদনে কিংবা মঞ্চ অভিষেকে পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদেছেন পাহাড়সম পিতা আইয়ুব বাচ্চু। পুত্রের অভিষেকে অনুভূতি প্রকাশে ভেজাকণ্ঠে এই গিটার কিংবদন্তি বার বার বলতে চেয়েছেন এই দেশে সংগীতের পথ কতটা নির্মম। কতটা যন্ত্রণা বুকে চেপে তিনি আজও মুখ বুঁজে বাজিয়ে চলেছেন নিরন্তর। পিতার পাশে দাঁড়িয়ে গিটার হাতে পুত্রের অভিষেকে পুরো বাংলাদেশ যখন মন্ত্রমুগ্ধ, যখন অনেকেই স্বস্তি নিয়ে ভাবছেন গিটার কিংবদন্তির জাদুর হাত হস্তান্তর হচ্ছে জুনিয়র জাদুকরের হাতে। ঠিক তক্ষুণি আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে বেজেছে পুত্রের প্রতি প্রফেশনাল মিউজিকের নিষেধাজ্ঞা বার্তা। আইয়ুব বাচ্চু বেশ আবেগি কণ্ঠে বলেন, আমি চাই না তাজো প্রফেশনাল মিউজিক করুক। আমি চাই না আমার পুত্র আগুনে ঝাঁপ দিক। একজন পিতা হিসেবে আমি চাই না আমার বুকের আগুন ওর বুকেও জ্বলুক। কারণ, এই ইন্ডাস্ট্রি শিল্পী-মিউজিশিয়ানদের কিছু দিতে পারে না। পারে শুধু দুস্থ শিল্পীর সার্টিফিকেট দিতে। গান থামিয়ে পিনপতন নীরবতার মধ্যে তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে আজ আমার পাশে দাঁড়িয়ে বাজিয়ে যাচ্ছে অনর্গল। একজন পিতা হিসেবে এর চেয়ে সুখের ঘটনা কি হতে পারে? এই সুখানুভূতি পিতা না হলে কেউ আঁচ করতে পারবেন না। আজ সত্যিই আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখি বাবা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আপনাদের সামনে। তবুও আমি চাই না ও প্রফেশনালি মিউজিক করুক, যতদিন এই ইন্ডাস্ট্রি নিয়মের মধ্যে না আসে। তিন দিনব্যাপী বামবা-যমুনা ঈদ কনসার্টের সমাপনী আয়োজন ছিল শনিবার। আর সমাপনী ব্যান্ড হিসেবে ছিল এলআরবি। এই সমাপনী আয়োজনে গান-গিটারের অসাধারণ পারফরমেন্সের ফাঁকে পিতার এমন আবেগি-অভিমানী কথায় পুত্র কিছু বলেননি। শুধু পিতার কাঁধে হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করেছেন। হয়তো মনে মনে বলেছেন, বাবা ডোন্ট ওরি। ভরসা রাখো। উই শ্যাল ওভারকাম সাম ডে। মাত্র ১৬ বছর বয়সী এবি পুত্র আহনাফ এখন পড়াশোনা করছেন ও’ লেভেলে। পাশাপাশি গেল প্রায় আট বছর ধরেই বাবার কাছ থেকে তালিম নিচ্ছেন গিটারে। গিটার শিক্ষায় তাকে আরও সহযোগিতা করছেন এলআরবি’র আরেক মেধাবী গিটারিস্ট মাসুদ। যমুনা-বামবা কনসার্টে পিতা-পুত্রের অনবদ্য গিটার রসায়ন শেষেও পুত্রকে নিয়ে আইয়ুব বাচ্চুর সিদ্ধান্ত বেশ স্পষ্ট। তিনি বলেন, আমার প্রথম এবং প্রধান চাওয়া আহনাফ আগে পড়াশোনায় বেশি প্রাধান্য দেবে। পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে শিল্পীদের অধিকার যেভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে বাংলাদেশে যদি সেই পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন সংগীতকে পেশা হিসেবে নিতে চাইলে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। তবে এখন মাঝে মধ্যে এলআরবি’র বিশেষ শোগুলোতে ও চাইলে বাজাতে পারবে। নীতিতে অটল আইয়ুব বাচ্চু আরও বলেন, আমি চাইনি আমার ছেলে বলেই এলআরবি’র মতো বড় ব্যান্ডে বাজানোর সুযোগ পেয়ে যাক। যত দিন না আমার পাশে দাঁড়িয়ে ও বাজানোর মতো যোগ্য হবে, ততদিন আমি অপেক্ষা করতে চেয়েছি। আমার মনে হচ্ছে, তাজো (আহনাফ-এর ডাকনাম) এলআরবি’র সঙ্গে বাজানোর জন্য এখন যোগ্য। যদি মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির পরিবেশ ঠিক হয় তবে গিটারিস্ট হিসেবে ও আমাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর যাবে। পিতা হিসেবে এটুকু স্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এখন।