ঈদুল ফিতরের আগে নৌপরিবহনমন্ত্রী বলেছিলেন, বর্ষা মৌসুমে দুর্ঘটনা এড়াতে ঈদ-পরবর্তী আরও সাত দিন মুন্সিগঞ্জের মাওয়া রুটে ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় বিশেষ তদারক দল কাজ করবে। যাতে কোনো লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী বা পণ্য বহন করতে না পারে। তদারক দল সেসব লঞ্চের লোকদের শক্ত হাতে দমন করবে।
কিন্তু গত সোমবার মাওয়ায় মর্মান্তিক লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটার আগে মাওয়া বা অপর পারের কাওড়াকান্দিতে (মাদারীপুর) কোনো তদারক দল ছিল না।
গতকাল মঙ্গলবার নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনবলের কারণেও অতিরিক্ত যাত্রী বহন ঠেকানো যাচ্ছে না। আর তদারক দল কেন থাকেনি, তা তিনি দেখবেন। যেসব মালিকের লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্য বহন করেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলেও জানান তিনি।
এমএল পিনাক-৬ দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যায় নৌমন্ত্রী মাওয়া সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, এমএল পিনাক-৬-এ অতিরিক্ত যাত্রী খুব বেশি ছিল না। কারণ, সরকারিভাবেই লঞ্চটির যাত্রী ধারণক্ষমতা ১৫০।
প্রকৃতপক্ষে লঞ্চটির ধারণক্ষমতা ছিল ৮৫ জনের। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী প্রমাণ চান। প্রমাণ দেখালে সেখানে উপস্থিত আওয়ামী লীগদলীয় সাংসদ (শরীয়তপুর) বি এম মোজাম্মেল এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি অন্য লঞ্চের যাত্রীসংখ্যা দেখাচ্ছেন না তো, অনেক সাংবাদিক সত্য লিখে না।’ এমএল পিনাক-৬-এর নাম দেখালে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে বোধ হয় অফিসার বিভ্রান্ত করেছেন।’
গতকাল এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এমএল পিনাকের লোকজন বদমাইশি করে আমাকে ভুয়া একটি যাত্রীসংখ্যার কাগজ দেখিয়েছে। যেখানে যাত্রীধারণে ক্ষমতা দেখানো ছিল দেড় শ জন। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
নৌযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শাজাহান খান অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বলেছিলেন, সমুদ্র পরিবহন মন্ত্রণালয়ের জনবলকাঠামো বাড়ানো হবে। লঞ্চের প্রকৃত অবস্থা নির্ণয়ে বাস্তব জরিপকাজের জন্য জরিপকারকের সংখ্যা ২১ জন করা হবে। বর্তমানে জরিপকারকের স্থায়ী পদে আছেন মাত্র তিনজন। বলেছিলেন, নৌ দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে নিয়মিত তদারকির জন্য বিআইডব্লিউটিএর ২০ জন উপপরিচালককে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের পরিদর্শকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হবে। কোনো প্রতিশ্রুতিই তিনি পালন করেননি।
এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে গেছি। আসলেই তিন বছর ধরে আমি চেষ্টা করছি।’
গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে নৌ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক সভায় মন্ত্রী বলেছিলেন, বিভিন্ন লঞ্চ দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। নৌমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিভিন্ন নৌযানের নকশাগুলো পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো রিসার্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারে (বিআরটিসি) পাঠানো হবে। বাস্তবে তা হয়নি।
এ ছাড়া বিভিন লঞ্চ দুর্ঘটনার পর তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মন্ত্রী। যেমন: চলাচলের অনুপযোগী নৌযানগুলোকে শনাক্ত করে পর্যায়ক্রমে সুবিধাজনক স্থানে জরিপ করা, ঢাকা, বরিশাল ও খুলনায় নৌযান পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণকাজের জন্য বিশেষ দল গঠন করা, নৌযানের প্ল্যান, নকশা ও নির্মাণ তদারকির জন্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি নিয়োগ করা, রাতের বেলায় চলাচলের জন্য যাত্রীবাহী লঞ্চে রাডার সংযোগ করা, নৌযানের মাস্টার ও আনসারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, মাস্টার ও চালকদের সনদ নৌযানেই প্রদর্শনে বাধ্য করা, শুধু ঈদ বা বিশেষ সময়ে নয়, সারা বছরই নৌবন্দর বা টার্মিনালগুলোতে লঞ্চ তদারকি করা, যাত্রীদের শনাক্ত করার জন্য নৌবন্দরগুলোতে নাম-ঠিকানাসংবলিত রেজিস্ট্রার বক্স স্থাপন ইত্যাদি।
নৌমন্ত্রী শুধু বলেই যাচ্ছেন, করেননি কিছুই। গতকাল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন, কীর্তনখোলাসহ বেশ কিছু লঞ্চে রাডার বসানো হয়েছে। আরও হবে। আমি তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ বিষয়ে বিস্তারিত তালিকা চেয়েছি। কাজ শুরু করব।’