বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের উত্তরণের সম্ভাবনাকে এখন আর অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। অনেক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞের কাছে দুর্জ্ঞেয় মনে হলেও সবাইকে স্বীকার করতে হচ্ছে যে দুই দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে গতিশীলতা সঞ্চারিত হয়েছে, তাতে বিশ্বের ‘নিম্ন-মধ্যম মাথাপিছু আয়ের’ দেশ হিসেবে ঘোষিত হওয়ার যেসব শর্ত রয়েছে, সেগুলো পূরণের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বাংলাদেশ।এই গতিশীলতা অর্জনের পেছনে যে চারটি বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, সেগুলো হচ্ছে: ১. বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে, বিশেষত ধান উৎপাদনে চমকপ্রদ সফলতা; ২. রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের দ্রুত বিকাশ; ৩. বিদেশে অভিবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স-প্রবাহের প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধির হার এবং ৪. অধ্যাপক ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক প্রবর্তিত ক্ষুদ্রঋণের ধারণাটি গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে এনজিওগুলোর অংশগ্রহণে ক্ষুদ্রঋণের দ্রুত বিস্তার।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সাফল্যের এ চারটি প্রধান ডাইমেনশনের কোনটা বেশি কৃতিত্বের দাবিদার, তা নিয়ে বেফজুল বিতর্ক আমার কাছে একেবারেই অপছন্দনীয়। তবে যে কথাটি নির্দ্বিধায় বলা চলে তাহলো, এই চারটি অর্জনের প্রতিটির মূল নায়ক বাংলাদেশের শ্রমজীবী জনগণ। সে জন্য যখন কিছু কিছু বিদেশি খ্যাতনামা উন্নয়ন-চিন্তাবিদ বাংলাদেশের অর্জনকে ‘প্যারাডক্স’, রহস্যজনক বা অবিশ্বাস্য বলে মন্তব্য করে বসেন এবং আমাদের দেশের কিছু কিছু নামজাদা অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞকে তাতে সায় দিতে দেখি, তখন ক্ষুব্ধ না হয়ে পারি না। কারণ, এই চমকপ্রদ অর্জনগুলোর পেছনে কোনো রহস্য নেই, কিংবা এ ক্ষেত্রে প্যারাডক্সও নেই। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি এবং পুঁজি লুণ্ঠনের তাণ্ডব সত্ত্বেও এই ইতিবাচক প্রবণতাগুলো ক্রমেই জোরদার হয়ে চলেছে। এর মানে হলো, যদি এ দেশের শাসক মহল ও আমলাদের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যেত, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে এত দিনে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারত।
বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের গবেষণালব্ধ ও প্রকাশিত র্যাঙ্কিংয়ে ২০০১ সাল থেকে পর পর পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কুখ্যাতি অর্জন করেছিল, যার মধ্যে একবার শেখ হাসিনার আমলে এবং বাকি চারবার খালেদা জিয়ার আমলে। এরপর ২০০৬ সাল থেকে এই দুর্ভাগ্যজনক তকমাটা আমাদের কপালে আর না জুটলেও গত আট বছরে এ দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও আত্মীয়তোষণ, পুঁজি লুটেরাদের লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, মাস্তানি বেড়ে যে আরও অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে, তা কি অস্বীকার করা যাবে? আমাদের কৃষকসমাজ কৃষি উৎপাদনে, বিশেষত ধান উৎপাদনে যে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করে ‘খাদ্যশস্য স্বয়ম্ভরতার’ দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন, তা স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকে তথাকথিত ‘তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি’ হিসেবে পরিচিত এই দেশটিকে ওই চরম অপমানজনক অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছে। এই সাফল্যের পেছনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সৎ, মেধাবী ও নিরলস প্রয়াসকেও প্রশংসা করতেই হবে এবং দেশবাসী এই স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করছেন না বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু বাকি তিনটি বিষয়ে জনগণ নিজেদের জীবন ও জীবিকার তাগিদেই প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে সাফল্যকে ধরা দিতে বাধ্য করেছেন বলা চলে। শুধু ক্ষুদ্রঋণের সহায়তায় দারিদ্র্য দূর করা যাবে না, এটা মেনে নিয়েও বলতেই হবে ‘দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী বাংলাদেশের জনসংখ্যার হার’ প্রশংসনীয়ভাবে কমে আসার পেছনে ক্ষুদ্রঋণের অবদানকে যাঁরা খাটো করতে চাইছেন, তাঁরা নেহাতই জ্ঞানপাপী। ওই একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায়, পোশাকশিল্পে উন্নত বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এ দেশের নারী শ্রমিকদের নিষ্ঠুর শোষণের (সুপার এক্সপ্লয়টেশন) ব্যবস্থা কায়েম করে মুনাফাবাজির ক্ল্যাসিক নজির স্থাপন করলেও সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র প্রায় ৪০ লাখ নারীর কর্মসংস্থানের এই বিরাট আয়োজনটিকে দারিদ্র্যের করাল থাবা ও মানবেতর জীবনের মরণফাঁদ থেকে বাংলাদেশের এই নারী শ্রমিকদের রক্ষা পাওয়ার মহা সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তেমনিভাবে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি অভিবাসী শ্রমিক ও পেশাজীবীর বিদেশে অভিগমনের ব্যাপারটিতেও সরকারের কৃতিত্ব তেমন নেই। নিজেদের জীবন-জীবিকার তাগিদে যে যেভাবে পেরেছেন বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, তাঁদের সিংহভাগ, কিন্তু মা-বাবা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-ভাইবোনদের ভরণপোষণের জন্য পাঠানো তাঁদের রেমিট্যান্সই গত দুই দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের এই অগ্রগতির পথে সবচেয়ে দুর্লঙ্ঘ্য বাধার পাহাড় দুর্নীতি ও লুটপাট। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার করছি আমরা, অথচ এই দুর্নীতি ও লুটপাটের ক্রমবর্ধমান দৌরাত্ম্য থেকে পরিত্রাণের কোনো আলামত এখনো দেখা যাচ্ছে না। নব্বই দশকের শেষ দিকে বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবছর ১ শতাংশ