বহুল আলোচিত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ১০ বছর পার হয়ে গেলেও শেষ হয়নি বিচার। বর্তমান সরকার ৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও শেষ হয়নি বিচার কাজ।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় সে সময়কার বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় আওয়ামী মহিলা লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হয় শতাধিক।
এই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর হয়ে এসএসপি আব্দুর রশিদ হয়ে মুন্সি আতিকুর রহমানের কাছে যায়।
অভিযোগ আসে মুন্সি আতিক ও আব্দুর রশিদ মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজান। তার কাছ থেকে মিথ্যা জবানবন্দি আদায় করেন। পরিবারকে প্রতিমাসে টাকা দেয়ার কথাও বলে। মাঝে এফবিআই ও ইন্টারপোল মামলার তদন্ত করে।
২০০৮ সালের ১১ জুন প্রথম অভিযোগপত্র দেন সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর। এতে বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, মুফতি হান্নান ছিলেন ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী। তাদের লক্ষ্য ছিলো শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করা। এছাড়াও ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে সে সময়ের স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ভূমিকা ছিলো বলেও বলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ৩ আগষ্ট মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য দায়িত্ব পান পুলিশ সুপার আব্দুল কাহহার আকন্দ। পুন:তদন্ত শেষে ২০১১ সালের বছরের ৩ জুলাই তিনি সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।
২০১২ সালের ১৮ মার্চ হত্যা মামলায় ৫২ জনের বিরুদ্ধে এবং বিস্ফোরক মামলায় ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। বিস্ফোরক মামলায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের সাবেক ১১ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেন আদালত।
আসামিদের মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৯ জন পলাতক। পুলিশের সাবেক ছয় কর্মকর্তা ও বিএনপি-সমর্থিত সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুর রহমান জামিনে আছেন। বাবর, পিন্টু, মুজাহিদসহ ২৬ আসামি কারাগারে আছেন।
সম্পূরক অভিযোগপত্রের আসামিরা হলেন- তারেক রহমান ছাড়াও লুৎফুজ্জামান বাবর, মুজাহিদ, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাংসদ কায়কোবাদ, খালেদা জিয়ার ভাগন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী।
এছাড়াও আছেন- সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি খান সাইদ হাসান ও মো. ওবায়দুর রহমান, জোট সরকারের আমলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আবদুর রশীদকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়াও হুজির ১০ জন নেতা ও হানিফ পরিবহনের মালিককে আসামি করা হয়।
তারেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
নথিপত্রে দেখা যায়, জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নান এ মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের নভেম্বরে প্রথম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে হামলার পরিকল্পনায় সাবেক উপমন্ত্রী পিন্টু ও তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনের নাম বললেও, তারেক রহমান ও বাবরসহ অন্যদের নাম বলেননি। এরপর মুফতি হান্নান ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল দ্বিতীয় দফা জবানবন্দিতে তারেকসহ বাকি রাজনীতিকদের নাম বলেন।
মূলত হান্নানের এই জবানবন্দি এবং ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক সাদিক হাসান রুমি, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মিজানুর রহমান, র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মেজর (অব.) আতিকুর রহমানের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এসব রাজনীতিককে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়।
তাতে বলা হয়, মুফতি হান্নান বনানীর হাওয়া ভবনে গিয়ে তারেক রহমান, মুজাহিদ, বাবর, হারিছ চৌধুরী, রেজ্জাকুল হায়দার, আবদুর রহিমসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য হামলায় অংশগ্রহণকারীদের প্রশাসনিক সহায়তা ও নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দেন তারেক রহমান ও বাবর বলে অভিযোগ আনা হয়।
এই মামলায় ২০১২ সালের ৫মে আদালতে সাক্ষ্য দেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) সাদিক হাসান রুমি। সাক্ষ্যে তিনি বলেন, রেজ্জাকুল হায়দার বিএনপির নেতা তারেক রহমান ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বাবরের নির্দেশ পেয়ে ২১ আগষ্ট ঘটনার রাতেই উদ্ধার হওয়া অবিস্ফোরিত গ্রেনেড দ্রুত ধ্বংস করে আলামত নষ্ট করা হয়।
তারেক রহমান ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমতি নিয়ে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যান। তিনি এখনো সে দেশে আছেন।ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে অস্থায়ী আদালতে অবস্থিত দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ এ মামলার বিচারকার্য চলছে।
রাষ্টপক্ষের প্রধান কৌশুলী সৈয়দ রেজাউর রহমান পরিবর্তনকে জানান, “আগামী বছরের আগষ্ট মাসের মধ্যেই এ মামলার বিচার কাজ শেষ হতে পারে।”
তিনি আরোও বলেন, “এ মামলার অভিযোগপত্রে মোট সাক্ষী সংখ্যা ৪৯১ জন। এ পর্যন্ত ৯৯ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।”
বুধবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. শাহেদ নুর উদ্দিন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা গ্রহণ করে আগামী ২৫ ও ২৬ আগস্ট ফের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেছেন।