ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আবারও এক নবজাতক চুরি হয়েছে। হাসপাতালের সিসি ক্যামেরায় এই চুরির ঘটনা ধরা পড়ায় তোলপাড় চলছে। তবে রাজধানীর সবচেয়ে বড় এই সরকারি হাসপাতালে বারবার নবজাতক চুরির ঘটনায় হাসপাতালের অন্যান্য রোগী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে। ঘটনার সময় কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী নাজিমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। হাসপাতালের সিসিইউ ক্যামেরায় নবজাতক চুরির দৃশ্য উদ্ধার করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে নবজাতক চুরির সঙ্গে জড়িত নারীর পরিচয় শনাক্তকরণের চেষ্টা চলছে। এছাড়া, নবজাতক চুরির ঘটনায় গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কেএম শহীদুল্লাহকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে বলে সূত্র জানায়। গতকাল সকাল পৌনে আটটার দিকে ঢামেক হাসপাতালে এই নবজাতক চুরির ঘটনা ঘটে।
সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুর থানাধীন জহুরা মহল্লার কাওসার হোসেন বাবুর স্ত্রী রুনা বেগম বুধবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের দ্বিতীয় তলায় ভর্তি হন। এরপর ভোর পাঁচটার দিকে তিনি যমজ সন্তান প্রসব করেন। এ সময় রুনার মা গুলেনুর বেগমের সঙ্গে অজ্ঞাত নারীর (শিশু চোর) আলাপচারিতা হয়। সেই সুযোগে ওই নারী রুনা পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে। এ সময় নারী শিশু চোর জানায়, তার ভাবীর এক সঙ্গে তিনটি সন্তান হয়েছে। নবজাতক শিশুরা অসুস্থ হওয়ায় পাশের কক্ষের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। প্রতারক নারীর অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি গুলেনুর বেগম। সে নিজেও তার সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন। সেই সুযোগে অজ্ঞাত মহিলা কিছু সময় পর পর গাইনি ওয়ার্ডে এসে রুনার যমজ সন্তানকে দেখতে আসে। বিভিন্ন আলাপ করে আবার উধাও হয়ে যায়। সকালে রুনা হাসপাতালে বেডে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এ সময় একটি শিশু কান্না করতে থাকলে তার মা গুলেনুর কোলে তুলে নিয়ে ওয়ার্ডের ভিতরে হাঁটতে ছিলেন। একই সময়ে অপর শিশুটিও কান্না করে। তার কান্নার শব্দ শুনে হঠাৎ মহিলা চোর গুলেনুর বেগমের কোল থেকে নবজাতককে নিজের কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে। রুনার মা বেডের নাতনিকে কোলে তুলে নিতে গেলে সেই সুযোগে কোলের নবজাতককে নিয়ে সে কেটে পড়ে। ঘুম ভাঙার পর বেডে যমজ সন্তানকে না দেখে রুনা তার মার কাছে সন্তানের কথা জানতে চাইলে সে জানায় ওই মহিলার (প্রতারক) কাছে রয়েছে। এ সময় তিনি গাইনি ওয়ার্ডের অপর প্রান্তে নবজাতককে খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন কোথাও তারা নেই। এ সময় নবজাতক চুরির ঘটনা নিয়ে গোটা হাসপাতালে হৈ চৈ পড়ে যায়। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন রুনার স্বামী কাওসার, শ্বশুর শাহ আলম ও স্বজনেরা। তারা গাইনি ওয়ার্ডের ভিতরে ও হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় নবজাতক ও মহিলার খোঁজ করেন। কিন্তু কোথাও খুঁজে না পাওয়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়েন। রুনা পরিবার ঢামেক হাসপাতালের কর্র্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করার পর কর্র্তৃপক্ষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান গেটসহ অন্যান্য গেটের নিরাপত্তা জোরদার করেন। কিন্তু তার আগেই লোকচক্ষুর অগোচরে নবজাতক চুরি করে পালিয়ে গেছে শিশু চোর নারী। এদিকে নবজাতক চুরির ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিসিইউ ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সূত্র জানায়, নবজাতক চুরির ঘটনার সময় অনুযায়ী সকাল পৌনে আটটার দিকে সাদা ছাপা শাড়ি পরা এক মধ্যবয়সী মহিলা নবজাতককে কোলে নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করে। এ সময় ক্যামেরায় তাকে একা দেখা গেছে। তার সঙ্গে হয়তো অন্য কোন লোক থাকতে পারে বলে তারা সন্দেহ করছেন। অনেকের ধারণা সকালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢিলে থাকার সুযোগে চোর নবজাতককে চুরি করার পর জরুরি বিভাগের পকেট গেট দিয়ে দ্রুত সটকে পড়েছে। ঢামেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মো. মুশফিকুর রহমান জানান, নবজাতক চুরির ঘটনায় তারা শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছেন। ভিডিও দৃশ্য দেখে নারী শিশুচোরকে পুলিশের সহযোগিতায় শনাক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ঘটনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে এবং নিরাপত্তাকর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী নাজিম জানান, প্রতিদিন একজন নিরাপত্তাকর্মীকে আট ঘণ্টা করে ডিউটি করতে হয়। একই নিরাপত্তাকর্মীকে ২১৩ ও ২১৪ নম্বর ওয়ার্ড দেখাশোনা করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় তাদের চরম ঝামেলা পোহাতে হয়। নবজাতক চুরির ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ভোরে একটি ডেলিভারি কেস ২১৩ নম্বর ওয়ার্ডে আসে। এ সময় একজন মহিলা ট্রলি নিয়ে গাইনি ওয়ার্ডে ঢুকেছিল। তার কিছুক্ষণ পরে নবজাতক চুরির ঘটনাটি তিনি জানতে পারেন বলে জানায়। রুনার স্বামী কাওসার হোসেন বাবু বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এর আগেও নবজাতক চুরির ঘটনার খবর তিনি জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই ঘটনা আজ নিজের স্ত্রীর কপালে ঘটবে তা কখনও চিন্তা করেননি। তার অভিযোগ, নবজাতক চুরির ঘটনার পিছনে সরকার, রাষ্ট্র ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। এদিকে প্রসূতি রুনা বলেন, সন্তান ভূমিষ্ঠ করতে এসেছিলাম, সন্তান চুরি হতে নয়। আমার বুক থেকে দুধের শিশু যে নারী চুরি করেছে তাকে আটক করুন। যে করেই হোক কালনাগিনী নারীর কাছ থেকে আমার সন্তানকে উদ্ধার করে আমার বুকে ফিরিয়ে দিন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৬ নম্বর বেডে শুয়ে প্রসূতি মা রুনা আক্তার তার নবজাতক সন্তান চুরি হওয়ার পরে আরেক নবজাতক সন্তান বুকে জড়িয়ে বিলাপ করছিলেন। তার কান্নায় হাসপাতালের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। প্রসূতি মাকে সান্ত্বনা দিতে গাইনি বিভাগের অন্যান্য রোগীর স্বজনেরা এগিয়ে আসেন। কিন্তু কিছুতেই কান্না থামছিল না রুনা আক্তারীর। রুনার শ্বশুর শাহ আলম জানান, সকালে তিনি বাসায় বসে টেলিভিশন দেখছিলেন। এ সময় টেলিভিশনের খবর থেকে নবজাতক চুরির ঘটনা জানতে পারেন। তার দাবি যারা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত। গুলেনুর বেগম জানান, ওই নারীর সঙ্গে তাদের আগে জানাশোনা ছিল না। কিন্তু গাইনি ওয়ার্ডের অন্যান্য রোগীর কাছে আত্মীয় পরিচয় দিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, তার চোখের সামনে এ ঘটনাটি ঘটলেও একবারও তিনি বুঝতে পারেননি ওই নারীর প্রতারণা। ফাঁড়ি ইনচার্জ মোজাম্মেল হোসেন জানান, ঘটনার পর পরই তারা হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মীদের সতর্ক করেছিলেন এবং হাসপাতালের অভ্যন্তরে তল্লাশি চালিয়েছিলেন।