ভয়াবহ অবস্থা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের! দায়িত্ব নিয়ে কী বিপদেই না পড়েছেন লুই ফন গাল! দলকে যেখানে গত মৌসুমের দুঃস্বপ্ন ভুলিয়ে দিতে একের পর এক সাফল্য উপহার দেওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, সেখানে তিনি নিজেই রয়েছেন দুঃসহ এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের প্রথম দুই ম্যাচে একটিতে হার অপরটিতে ড্র দিয়ে শুরু করার পর গত পরশু ক্যাপিটাল ওয়ান কাপে তৃতীয় বিভাগের এক অখ্যাত দলের কাছে হেরে গেছে ইউনাইটেড। ফন গালের এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। সুদীর্ঘ মৌসুম পড়ে আছে সামনে। তিনি এখন রাতে ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছেন, মনের অজান্তেই প্রমাদ গুনছেন, সামনে কপালে না জানি কত কিছুই অপেক্ষা করছে।
ফন গাল হাতড়ে বেড়াচ্ছেন এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়। নতুন নতুন ছক কষছেন। কিন্তু মনের অজান্তেই তিনি চলে যাচ্ছেন অতীতের দিনগুলোতে। ২০১৩ সালেই যে দল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতেছে, সে দল হঠাত্ করেই কেন অন্ধকারের পথে হাঁটা শুরু করল। খবরে প্রকাশ, অতীতের দিকে তাকিয়েই নাকি চাঞ্চল্যকর অনেক কিছুই খুঁজে পেয়েছেন ফন গাল। মূল গলদ নাকি ওই অতীতেই। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের স্বর্ণ সময়ে দল নগদ সাফল্য নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর ফুরসতই পায়নি—এটা একটা কারণ। কিন্তু তার চেয়ে বড় কারণ হচ্ছেন ফার্গুসন নিজেই!
সর্বশেষ লাইনটি চমকে দিতে পারে অনেককেই। যে লোকটি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে এত সাফল্য এনে দিয়েছেন, যে লোকটি ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের দলটিকে পরিণত করেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাবে, সেই লোকটিই কিনা ক্লাবের বর্তমান অবস্থার অন্যতম কারণ! এমন মন্তব্য করাও তো রীতিমতো অন্যায়। কিন্তু ব্রিটিশ গণমাধ্যমেই বলা হয়েছে, এই অবস্থার জন্য ফার্গুসন কম দায়ী নন।
ফন গাল একটি ব্যাপার খুব করে বলা শুরু করেছেন যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ভালোমানের খেলোয়াড়ের খুব অভাব। ভালো মানের খেলোয়াড় বলতে ওই মান, যা ক্লাবকে লিগ বিজয়ের মতো সাফল্য উপহার দিতে পারে, ক্লাবকে নিয়ে যেতে পারে বিশ্বসেরাদের কাতারে। এই জায়গাটিতেই দায়ভার চাপছে ফার্গুসনের ওপর। তিনি তাঁর দায়িত্বের শেষ ছয় বছরে ক্লাব ম্যানেজমেন্টকে ১৬০ মিলিয়ন পাউন্ড এমন কিছু খেলোয়াড়ের পেছনে খরচ করতে বাধ্য করেছেন, যাঁদের তিনি ভেবেছিলেন ভবিষ্যতের সম্পদ হিসেবে। কিন্তু ওই খেলোয়াড়েরা ভবিষ্যতের সম্পদ না হয়ে অনেকেই ক্লাবের বোঝায় পরিণত হয়েছেন। ফন গাল এই ব্যাপারটি লক্ষ করে দৃষ্টিগোচর করেছেন ক্লাব-কর্তাদের। ক্লাবের কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে ফন গালের সঙ্গে নাকি একমত। ক্লাবের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাও এ বিষয়টি নাকি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু ফার্গুসনের ব্যক্তিত্বের কাছে তাঁরা ছিলেন অসহায়। ২০১৩ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যখন শেষবারের মতো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতে গেল, ক্লাবের অনেক কর্তাই নাকি তাতে যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন। মোটকথা, যেকোনোভাবেই হোক নিজেদের উতরে গিয়ে ২০১৩ সালে লিগ জিতে গেলেও ফার্গুসনের ভবিষ্যত্ সম্পদেরা যে দীর্ঘ দৌড়ে সক্ষম নন, সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে ডেভিড ময়েসের জমানার এক মৌসুমেই। ফন গাল উত্তরাধিকার সূত্রে হাতে যা পেয়েছেন, তা ময়েস জমানারই খড়কুটো। এসব দিয়ে টেকসই কিছু তৈরি করা যে একেবারেই অসম্ভব, সেটা ইতিমধ্যেই বুঝে গেছেন ফন গাল। সে জন্যই তিনি ‘তারকা’ খেলোয়াড়দের দলে ভিড়িয়ে দলকে নিজের মতো করে তৈরি করতে এতটাই মরিয়া।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দায়িত্ব নিয়ে এই প্রাথমিক দিনগুলোতেই বিশ্বকাপে তাঁর ব্যবহূত সেই বিখ্যাত ৩-৪-১-৩ ফর্মেশন মুখ থুবড়ে পড়েছে। কারণ, একটাই—যোগ্য খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতি। বৃহস্পতিবারের বিব্রতকর হার তাঁর মধ্যে এক ধরনের আত্মোপলব্ধি এনে দিয়েছে। বিশ্বকাপের সেই ট্যাকটিকস যদি ওপর থেকে এই দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি। তিনি তো সাদা চোখেই দেখেছেন তাঁর ফর্মেশনে ইউনাইটেডের রক্ষণব্যূহ কতটা অসহায় হয়ে পড়ছে। যেটা ক্যাপিটাল ওয়ান কাপে চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ হয়ে গেছে। তিনি এখন চাইছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তিনি বুঝতে পেরেছেন, তাঁর বিখ্যাত ফর্মেশন এখন প্রয়োগ করতে হবে ক্যারিংটন ট্রেনিং সেন্টার থেকেই। যেখানে তৈরি হয় ইউনাইটেডের ভবিষ্যত্ খেলোয়াড়েরা। আপাতত তিনি হাতে নিতে চান ৪-৩-৩ ফর্মেশনই। যে ফর্মেশনে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়ার মতো কার্যকর ফুটবলার একেবারে প্রকৃতি-প্রদত্তভাবেই মিশে যেতে পারেন।
সাদা চোখে দেখলে ইউনাইটেডের প্রথম একাদশ কিন্তু একেবারে খারাপ নয়। সেদিন ক্যাপিটাল ওয়ান কাপে ৪ গোলের লজ্জায় দ্বিতীয় সারির যে দলটি খেলেছিল, ওটাকেও কেউ খারাপ বলতে পারবে না। কিন্তু সমস্যাটা হলো উত্তরাধিকারসূত্রে ফন গাল এমন একটি দল হাতে পেয়েছেন, যা প্রকৃতিগতভাবেই রক্ষণাত্মক মানসিকতা-বিবর্জিত। যতই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠুক দল, প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকানোর ক্ষমতা না থাকলে বিপদে দলকে পড়তেই হবে। ফন গাল এটা বুঝতে পারছেন হাড়ে হাড়েই।
তিনি এটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন ডি মারিয়ার মতো দুই-একজন তারকা ফুটবলারের অন্তর্ভুক্তিতেও এই দল রাতারাতি পাল্টে যাবে না। তাঁকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে ফার্গুসনের শেষ ছয় বছরের ভুল পরিকল্পনার মাশুলও। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁকে ভুল শোধরানোর সময় দেওয়া হবে, নাকি ময়েসের মতো দেখিয়ে দেওয়া হবে দখিন দুয়ার। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্তিটা সব সময় সুখকর না-ও হতে পারে—ফন গালই এই মুহূর্তে ব্যাপারটি সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারছেন। সূত্র: ডেইলি মেইল।