বাইরে থেকে মিষ্টি সুরে আওয়াজ এলো, বাবু/ ডেকেছিস কেনে/ বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া/সাঁওতাল মেয়ের কানে/ কালো গালের ওপর আলো করেছে/সে আবার জিগেস করলে, ‘ডেকেছিস কেনে’/ আমি বললেম, এই জন্যেই/ তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়… বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতার লাইন এটি।
১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা, যখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষবারের মতো ঢাকায় আসেন। তখন বলধা গার্ডেনসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন তিনি। বলধা গার্ডেনে বেড়াতে এসে কবি এখানকার জয় হাউজে উঠেছিলেন।
এক রাত কাটিয়েছিলেনও। হাজারো উদ্ভিদের ভিড়ে ক্যামেলিয়া কবিকে দারুণ আকৃষ্ট করেছিল। তাই এ ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কলকাতা ফিরে গিয়ে লিখেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘ক্যামেলিয়া’, যা পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। পরে এ কবিতা নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে।
পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেনের সিবিলি অংশে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে ‘ক্যামেলিয়া হাউজ’। এখানে বিভিন্ন ধরনের ক্যামেলিয়া ফুলগাছ দিয়ে ভরা।
ডিসেম্বর মাস এলেই গাছে ঝেঁপে আসে ক্যামেলিয়া ফুল। এর পাতা গাঢ় সবুজ। ক্যামেলিয়া ফুল লাল, সাদা, গোলাপিসহ বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। দেখতে অনেকটা গোলাপ ফুলের মতো হলেও সৌন্দর্যে ক্যামেলিয়ার তুলনা শুধু ক্যামেলিয়াই। বলধা গার্ডেন দেখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, পৃথিবীর বহু রাজা-মহারাজার বাড়িতে কত রকম ফুলের বাগানই তো দেখলাম কিন্তু বলধা গার্ডেনের মতো বাগান কোথাও দেখিনি।
বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ৩ দশমিক ৩৮ একর জমির ওপর ১৯০৯ ইংরেজি সালে উদ্যানটির নির্মাণকাজ শুরু করেন, যা শেষ হতে সময় লাগে প্রায় আট বছর। বিরল প্রজাতির ৮০০ গাছসহ বাগানটিতে প্রায় ১৮ হাজার গাছ রয়েছে। বর্তমানে এখানে ৬৭২ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।
বাগানটিতে এমনও অনেক দুর্লভ প্রজাতির গাছ রয়েছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোথাও নেই। এখানে শুধু ক্যাকটাসই রয়েছে ৭০ প্রজাতির। এ ছাড়া যেসব প্রজাতির গাছ নিয়ে গড়ে উঠেছে এ বাগান তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ অর্কিড, জলজ উদ্ভিদ, শিলালগ্ন প্রজাতি, দেয়াল লতা, বৃশালা ও বিবিধ গাছপালা।
জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ ওয়ারী, টিকাটুলী ও নারিন্দার ঠিক মাঝখানে দু’টি ভাগে বলধা গার্ডেন তৈরি করেন। বলধা গার্ডেনের এক পাশের নাম সাইকি এবং অপর পাশের নাম সিবিলি। ‘সাইকি’ অর্থ আত্মা এবং ‘সিবিলি’ ছিল গ্রিকের প্রকৃতি দেবীর নাম। বলধা গার্ডেনের সাইকি অংশটিতে সবার যাওয়ার অনুমতি নেই। এটা বন্ধ করে রাখা হয়।
কারণ এমন কিছু দুর্লভ প্রজাতির গাছ আছে যা মানুষের আনাগোনায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু গবেষকেরা এখানে যেতে পারেন। সাইকিতে রয়েছে নীল, লাল ও সাদা শাপলাসহ রঙিন পদ্মা, তলা জবা, অপরাজিতা, ক্যাকটাস, পামগাছ, জবা প্রভৃতি। এখানে আরো রয়েছে ‘সেঞ্চুরি প্লান্ট’ নামক শতবর্ষে একবার ফোটা ফুলের গাছ। আরো রয়েছে বাওবাব নামে একধরনের গাছ।
এ গাছের খোড়লের মধ্যে আফ্রিকার আদিবাসীরা মিসরের ফারাওদের বহু আগেই মৃতদেহ রেখে মমি বানিয়ে রাখত। এ অংশের দু’টি গ্রিন হাউজের একটিতে আছে বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিড এবং অপরটিতে রয়েছে ওষুধি ও ইনডোর উদ্ভিদ। এখানেই ছিল বলধার জমিদারবাড়ি। বলধা গার্ডেনের সিবিলি অংশ সবার জন্য উন্মুক্ত।
বাগানের এ অংশে রয়েছে সূর্যঘড়ি, যার মাধ্যমে সূর্য নিজেই সময় বলে দেয়। এ ছাড়া এখানে শঙ্খনদ নামে একটি দৃষ্টিনন্দন পুকুর রয়েছে।
সিবিলিতে বিরল প্রজাতির পদ্মফুল রয়েছে, যা জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ আফ্রিকা থেকে এনেছিলেন। এখানে আরো রয়েছে ক্যামেলিয়া, পারুল, কনক, সাদা অপরাজিতা, নীল শাপলা, আমাজন লিলি, কদম, চালতা, ঝুমকো লতা, ছায়াতরু, শতমূলী, এলাচি ফুল, কনকসুধা, আফ্রিকান টিউলিপ, অর্কিড, এনথুরিয়াম, স্বর্ণ অশোকসহ অনেক দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদ।
১৯৪৩ সালে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর বাগানটির দায়িত্ব নেয় কলকাতা হাইকোর্ট। সে সময় হাইকোর্ট সরাসরি বাগানটির তত্ত্বাবধানে ছিল। পরে ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের ‘কোর্ট অব ওয়ার্ডস’ বলধা গার্ডেনের দায়িত্ব নেয়। স্বাধীনতার পর বন বিভাগ এর তদারকি ও উন্নয়নের দায়িত্ব পায়।
বর্তমানে বন বিভাগ গার্ডেনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর ৪১ নম্বর (সাবেক ৭৭ নম্বর) ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আবুল হোসেনের প্রতিষ্ঠান টেন্ডারের মাধ্যমে গার্ডেনটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকা দেয়ার শর্তে এ কাজ পেয়েছেন তিনি।
তার ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আনিসুর রহমান অপু, কাদের, স্বপন পার্কটি আবুল হোসেনের পক্ষে দেখাশোনা করেন। অভিযোগ রয়েছে গার্ডেনটিকে বেসরকারি তত্ত্বাবধানে দেয়ায় অনেক মূল্যবান গাছ বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
বলধা গার্ডেনকে অভিহিত করা হয় ফুল ও উদ্ভিদের মিউজিয়াম বা জাদুঘর হিসেবে। নগরজীবনের ব্যস্ততা ভুলে একটু প্রশান্তির আশায় একান্তে সময় কাটাতে অনেকেই একসময় এখানে ছুটে আসতেন।
দেশী-বিদেশী প্রকৃতিপ্রেমীরা এখানে ভিড় করতেন নির্মল হাওয়ায় নির্জনে একটু সময় কাটাতে। এখন বলধা গার্ডেনের সে পরিবেশটি নির্বাসিতপ্রায়। বলধা গার্ডেনের সিবিলি অংশ চলে গেছে বিকৃতমনা তরুণ-তরুণীদের দখলে।
গত সোম ও মঙ্গলবার সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, রাজধানীর অন্যতম ঐতিহ্যবাহী উদ্ভিদ পার্কটি পরিণত হয়েছে অশ্লীলতা, নোংরামি আর মাদকসেবীদের আখড়ায়। এখন আর কোনো ভদ্র, রুচিশীল মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে আসার সাহস করেন না। পার্কটিতে প্রবেশ করলে যে-কাউকেই পড়তে হবে বিব্রতকর অবস্থায়।
এমন দৃশ্য চোখে পড়বে যা হয়তো বাইরে প্রকাশ করতেও বিব্রত বোধ করবেন অনেকে। গার্ডেনের ভেতর যেখানে একসময় সব বয়সী মানুষের ভিড় থাকত, ভোর হলেই শরীরচর্চার জন্য ছুটে আসত শিশু থেকে বয়সীরা। সেখানে এখন শুধু তরুণ-তরুণীদের আড্ডা। সবার বয়স পনেরো থেকে ত্রিশের মধ্যে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখা মিলবে স্কুলড্রেস পরা ছাত্রীদের।
চোখে পড়বে হাতে হাত ধরে তরুণ-তরুণীদের চুম্বনদৃশ্য বা এর চেয়েও বেশি কিছু! পুকুরপাড়, শতায়ু উদ্ভিদের আড়াল, গোলাপ বাগান, আঙুর বাগান বা বাঁশঝাড়ের আড়ালে জোড়া জোড়া তরুণ-তরুণীকে নিজ সংস্কৃতি, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অকাতরে বিলিয়ে দিতে দেখা যাবে।
বলধা গার্ডেনের পুরোটাই উঁচু দেয়ালঘেরা। দেয়ালে লেখা ‘পার্কে …শালীন কোনো আচরণ করবেন না’। লেখাটা পড়ে খটকা লাগতে পারে। লাগারই কথা! কে বা কারা ‘অ’ অক্ষরটি কালি দিয়ে মুছে ফেলায় এই দশা।
লেখা ছিল, পার্কে অশালীন কোনো আচরণ করবেন না’। প্রবেশ গেট থেকে সামনের দিকে পা বাড়ালেই দেয়ালের শব্দগুলোর সত্যতা মিলবে। গেট পার হয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে আপত্তিকর দৃশ্য। পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে ঘুরতে আসার রেওয়াজ এ কারণেই হারিয়ে যাচ্ছে।
গার্ডেনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হাফিজ নামের এক স্কুলশিার্থী জানায়, তার বন্ধুদের মধ্যে যারা প্রেম করেন তারা এখানে নিয়মিত আসেন। কারণ এখানে কোনো অভিভাবক আসেন না। এটি প্রেমের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। অভিভাবকেরা কেন আসেন না জানতে চাইলে সে জানায়, বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার ভয়ে বয়স্ক কেউ এখানে আর আসতে চান না।
ওয়ারীর স্থানীয় এক অধিবাসী জানান, এক সময় তিনি বাবা-মাকে সাথে নিয়ে এখানে আসতেন। কিন্তু এখন তিনি তাদের সাথে নিয়ে আসার সাহস পান না। আগের সেই পরিবেশ এখন নেই বলে জানান তিনি।
চাকরিজীবী আব্দুর রহিম জানান, এখানে তিনি প্রায়ই আসেন, একটু প্রশান্তির আশায়। কিন্তু দিন দিন বাগানের পরিস্থিতি এমনপর্যায়ে যাচ্ছে, আর এখানে আসা যাবে না। রাজধানীর এক সময়ের অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র পার্কটির চরিত্র হননের পেছনে প্রশাসনের দুর্নীতি ও অবহেলাকেই দায়ী করছেন এলাকাবাসী।
পার্কে প্রবেশের জন্য দু’টি শিফট রাখা হয়েছে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বেলা ২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা। কিন্তু পার্ক কর্তৃপক্ষ সে নিয়ম মানেন না। সন্ধ্যার পরও বেশ সময় পার্কটি খোলা রাখা হয়। প্রবেশমূল্য জনপ্রতি রাখার কথা ১০ টাকা। কিন্তু রাখা হয় ২০ টাকা করে।
দিনের পর দিন চোখের সামনে দিনদুপুরে এসব অসামাজিক কর্মকাণ্ড চলে এলেও কর্তৃপ এ ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নিশ্চুপ রয়েছে। উল্টো পার্ক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অসামাজিক কাজ করার সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
গত মঙ্গলবার পুলিশের ওয়ারী জোনের ডিসি মোস্তাক আহমেদ এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বলধা গার্ডেন সরেজমিন দেখতে যান। কিন্তু তারা আসার খবরটি আগেই পৌঁছে যায় পার্কের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে। তারা হয়ে ওঠেন সতর্ক। পার্কের সামনে থাকা দু’টি ভ্রাম্যমাণ দোকান সরিয়ে ফেলেন তারা। টিকিটমূল্য ২০ টাকার পরিবর্তে সরকার নির্ধারিত ১০ টাকা রাখা হয়।
পার্কে আসা তরুণ-তরুণীদেরও সতর্ক করে দেয়া হয়, যাতে প্রশাসনের সামনে কোনো অনিয়ম চোখে না পড়ে।
এলাকাবাসীর দাবি, এ গার্ডেনে তরুণ-তরুণীদের প্রবেশের ব্যাপারে কঠোর নিয়ম করা এখন সময়ের দাবি। বলধা গার্ডেন আবারো হয়ে উঠুক সামাজিক বিনোদনকেন্দ্র। এ ব্যাপারে ডিসি মোস্তাক আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, পার্কটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে।
এ জন্য পুলিশ সরাসরি তরুণ-তরুণীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তবে আগামীতে পার্কটি সবার প্রবেশের উপযুক্ত করতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ জন্যই আমি সেখানে সরেজমিন দেখতে গিয়েছিলাম। পার্ক কর্তৃপক্ষের সাথে বসে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও তিনি জানান