‘সবিনয় নিবেদন’ বুদ্ধদেব গুহর একটি পত্র-উপন্যাস। উপন্যাসের আলোচিত প্রধান দুটি চরিত্র রাজর্ষী এবং ঋতিরায়। ঋতিরায়ের মন খারাপ। মন ভালো করবার জন্য রাজর্ষী ঋতিকে কুমিরের গল্প শোনায়। কুমিরের সে গল্পটি আমাদের সবার জানা। শিক্ষক ছাত্রকে যাই পড়ান ছাত্র শেষ পর্যন্ত সেখানে কুমিরের অস্তিত্ব খু্ঁজে বের করে। একটা কুমিল দুতো কুমিল অনেক কুমিল…মাত্তা মশাই!
কুমিরের সেই গল্পটি খুব মনে ধরে ছিল। তবে সে অর্থে কুমির নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না কোনোকালে। এটা ঠিক কুমির আমি ঢাকা চিড়িয়াখানাতেই প্রথম দেখেছিলাম। জিওগ্রাফি ও ডিস্কভারি চ্যানেলে স্টিভ আরউনের অনুষ্ঠানও একসময় খুব মনোযোগ সহকারে দেখতাম। এভাবেই একদিন দৈনিক প্রথম আলোতে কুমির নিয়ে একটি প্রতিবেদন পড়ার পর নিজের মধ্যে আমি কেমন যেন উৎসাহ অনুভব করি। তারপর একদিন ঘুরে আসি বাংলাদেশের প্রথম কুমিরের খামার র্যাপটেইলস ফার্ম লিমিটেড থেকে।
চলছে ভাদ্র মাস। তার মানে এখন শরৎকাল। ভালুকার উথুরা গ্রামে কুমির বাড়ি র্যাপটেইলস ফার্ম লিমিটেড-এর অবস্থান। শরতের এক ভোরে একদল হয়ে বের হলাম ভালুকার উদ্দেশে। ভালুকায় নেমে ভরাডোবার পথে সিএনজিচালিত অটোরিকসায় চড়ে বসতেই ভরাডোবার মাদকতা পেয়ে বসল। ভরাডোবা নামেই কি এক যাদু! কেমন ভালো লাগার আবেশে মাখামাখি। অটোরিকশা যখন ভালুকার রাস্তা ছেড়ে ভরাডোবার পথ ধরলো তখন দুচোখ স্নিগ্ধতায় ভরে উঠল। অটো রিকসা ছুটে চলেছে, ঠান্ডা হাওয়ার ঝাঁপটা লাগছে চোখে-মুখে। চারপাশটা খুব সুন্দর। অসাধারণ প্রকৃতিতে যেন আনন্দের ছোঁয়া লেগেছে। এমন সুন্দর পথে অটোরিকসা মানায় না। আমরা অটোরিকসা ছেড়ে ভ্যান গাড়ি ধরলাম। প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে চলেছি পিচ্ পথে। পিচঢালা সে পথের ডান-বামে কখনো কখনো লাল মাটির পথ। বাম দিকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ডোবা চোখে পড়লো সাথে কিছু পুকুরও। জানি না, হয়ত কখনো পুরো এলাকা জুঁড়েই ডোবায় পুর্ণ ছিল সে জন্যই এলাকার নাম ভরাডোবা। এর সবই আমার অনুমান নির্ভর। তবে এমন চমৎকার প্রকৃতিময় পিচ্ পথ শুধু হেঁটে চলা আর ভ্যানগাড়িতে চড়ে চলাই মানানসই। এখানকার মানুষ হেঁটেই পথ চলছে। তবে ভ্যানগাড়ি আর টেম্পু এখানে প্রধান বাহন, কদাচিৎ চোখে পড়বে বাস!
এখানকার প্রকৃতি মনে রং ধরিয়ে দেবার মতো। শক্ত লাল মাটির কারণেই মাটিঘেরা টিনের চালা ঘর খুব বেশি। কাছে পিঠে ইটের দালান খুব একটা চোখে পড়লো না। তবে লাল মাটির ঘরগুলো ঠিক যেন একেকটা বাধাঁই করা ছবি। সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিকে নিজ হাতে সাজিয়েছেন, আমরা সেখানে কোনো প্রলেপই দিতে পারি না। আলাদা সৌন্দর্য তো দূরে থাক! ইতোমধ্যে একটা সেতুর কাছে চলে এসেছি। এবার ঢাল বেয়ে উঠতে হবে ভ্যানগাড়িকে। আমরা ভ্যানগাড়ি থেকে নামলাম, তারপর সেতুর নীচ দিয়ে বয়ে চলা সরু খালের মতো নদীটির নাম জানতে চাইলাম। ভ্যান চালকের উত্তর- এর নাম মরা নদী। পরে জেনেছিলাম সেই মরা নদী খিরু নদীর একটি অংশ। একসময় এর প্রমত্তা রূপ ছিল। এখন সরু আর মরা নদী হয়ে গেছে। এভাবইে ঠিক এক ঘণ্টা পর উথুরা পৌঁছালাম। এবার পায়ে হাঁটা পথ। আমরা হেঁটে চলেছি এখন লাল মাটির পথ ধরে। এখানে ঝরাপাতা-ঝরাফুল অসাধারণ ভালো লাগার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কতগুলো কবুতর রাস্তা দখল করে দাঁড়িয়েছিল, কাছে যেতেই উড়ে আশ্রয় নিল পাশের খেঁজুর গাছে। এখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাদের দেখে তাকালো বিস্ময় নিয়ে। নারীরা লম্বা ঘোমটা টেনে আড়াল নিলো। হাঁটতে খুব ভালো লাগছিল আমাদের। তবু একসময় থমকে দাঁড়াতে হলো বিশাল এক লৌহ ফটকের সামনে, এটাই কুমিরবাড়ি। এখানে আমাদের স্বাগত জানালেন ফার্ম ম্যানেজার চিকিৎসক আবু সায়েম মো. আরিফ।
কুমিরবাড়ির ইতিবৃত্ত
র্যাপটাইলস ফার্ম লিমিটেড বাংলাদেশের প্রথম কুমিরের খামার। একমাত্র বলা গেল না কারণ বর্তমানে আর একটি খামার গড়ে উঠেছে। তবে এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুমিরের চাষ হওয়া প্রথম খামার র্যাপটাইলস ফার্ম লিমিটেড শুধু বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়াতেও প্রথম। ইতোমধ্যে খামার থেকে জার্মানিতে কুমির রপ্তানি করা হয়ে গেছে। যা কিনা আমার দেশের জন্য বিশাল অর্জন। ২০০৪ সালের মে মাসে যখন এই প্রজেক্ট যাত্রা শুরু করে তখনই এর উদ্যোক্তা মেজবা-উল হক বেশ আশাবাদী ছিলেন। তাদের সেই আশা বাস্তব রূপ পাওয়াতে তারা খুব খুশি। কিছুদিন হয় মেজবা-উল হকের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন পিরোজপুরের প্রশান্ত কুমার হালদার। প্রায় পনেরো একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে খামারটি। বড় কুমিরের জন্য ৩২টি বিশাল চৌবাচ্চা। বাচ্চা কুমিরের জন্য ৫টি অত্যাধুনিক হ্যাচারি সাথে ১টি উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন ইনকিউবেটর রয়েছে। অষ্ট্রেলিয়ান কন্সালটেন্ট জিওফ ম্যাকলোর প্রতি বছর এসে এর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন। এখানে বড় কুমিরদের প্রতি সপ্তাহে খেতে দেয়া হয় পনেরো থেকে ত্রিশ কেজি গরুর কিমা কিম্বা মুরগির মাংস। বাচ্চাদের শুধু কিমা দেয়া হয় প্রতিদিন। চিকিৎসক আরিফ জানান, কুমিরের রোগ-বালাই বলতে তেমন কিছু নেই। বিষণ্নতা এদের বড় অসুখ। চামড়া রপ্তানি মূল লক্ষ্য হলেও কুমির, কুমিরের মাংস, হাড়, দাত, কঙ্কালসহ ডিমের খোসাও রপ্তানি করার ইচ্ছে রয়েছে র্যাপটাইলস ফার্ম লিমিটেড কর্তৃপক্ষের। প্রায় এক ঘণ্টা কুমির বিষয় নিয়ে কথা বলে আমরা আরিফ সাহেবের সাথে বের হলাম কুমির দেখার জন্য। তারপর সবগুলো চৌবাচ্চার কুমির ঘুরে-ঘুরে দেখলাম।
এবার তাহলে আমি যাই
সারাদিন কুমিরের খামারে কাটিয়ে পড়ন্ত বিকেলে বের হলাম কুমিরের খামার থেকে। যখন উথুরা বাজারে পৌঁছালাম তখন গোঁধুলি বেলা। উথুরা বাজার খুব বেশি জমজমাট। আমরা প্রচণ্ড ভীড়ে দাঁড়িয়ে হালিমের চায়ের দোকানের গরুর খাঁটি দুধের চা পান করে আবার সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে বসলাম। তখন অস্তগামী সূর্যের শেষ কিরণ রাঙিয়ে দিয়েছে উথুরার রাজপথ!