দলের সঙ্গে ঢাকায় ফিরবেন। তারপরই বিদায়। বিসিবির চাকরি ছেড়ে চলে যাবেন বিভব সিং। যাওয়ার আগে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সময়ে বাংলাদেশ দলের খেলা শেষ টেস্টের স্মারক একটা স্টাম্প। পরশু বোশেজো স্টেডিয়ামে সেই স্টাম্প হাতে কয়েকটা ছবিও তুলে নিলেন বাংলাদেশ দলের বিদায়ী ফিজিও।
বিভব সিং তখনো ছবি তুলছেন। ততক্ষণে ড্রেসিংরুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ম্যাচ-পরবর্তী মিটিং। বিভবকে হাতের ইশারায় তাড়াতাড়ি ড্রেসিংরুমের দিকে যেতে বললেন কম্পিউটার বিশ্লেষক নাসির আহমেদ।
কী হয়েছে ড্রেসিংরুমের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে? কোচ কী বলেছেন? অধিনায়ক কী বলেছেন? ব্যাটসম্যানরাই বা কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন বাজে ব্যাটিংয়ের? অন্য সময় হলে রিপোর্টার হিসেবে এগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করার চেষ্টা হতো। কিন্তু পরশু আর তার প্রয়োজন মনে হলো না। ২ উইকেটে ১৫৮ থেকে ১৯২ রানে অলআউট! শেষ ৮ উইকেটের পতন ৩৪ রানে। তৃতীয় উইকেটে তামিম ইকবাল (৬৪) আর মুমিনুলের (৫৬) ১১০ রানের জুটির সৌজন্যে টেস্ট পঞ্চম দিনে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেও চতুর্থ দিনের শেষ ওভারে বাংলাদেশের অলআউট হয়ে যাওয়া। মাত্র একটা সেশনে এত কিছু ঘটে গিয়ে ২৯৬ রানে ম্যাচ হারার পর ড্রেসিংরুমের আলোচনা কী ধরনের হতে পারে, সেটা জানতে অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক হতে হয় না। তা ছাড়া আলোচনা যা-ই হোক না কেন, উপসংহার তো ওই একই—আরও ভালো খেলতে হবে। সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। অতীত ভুলে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে…সবই পুরোনো প্যাঁচাল।
কাল অবশ্য বোশেজো স্টেডিয়ামে এ কথাগুলো সংবাদমাধ্যমের সামনে এসেও বলেছেন মুশফিকুর রহিম। অধিনায়কের কথার ঝাঁজে স্পষ্ট, ব্যাটসম্যানদের খামখেয়ালিপনা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাঁরও। দলের কারও কারও মধ্যে দায়িত্ববোধের অভাব আছে কি না জানতে চাইলে তাঁর সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘সামর্থ্য থাকলেই হয় না। মাঠের মাঝখানে গিয়ে এটা কাজে লাগাতে হবে। আমাদের অনেক খেলোয়াড় প্রতিভাবান হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি প্রতিভা ব্যবহার না করেন, যেকোনো কাজ সুশৃঙ্খলভাবে না করেন, তাহলে ফল আসবে না। এ রকম প্রতিভা আসলে অর্থহীন।’
বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কিছু শেখার জন্য আদর্শ নাম হতে পারেন শিবনারায়ণ চন্দরপল। ৪০ বছর বয়সে এসেও যে রকম একাগ্রচিত্তে ব্যাটিং করেন, তার ধারেকাছে নেই বাংলাদেশ দলের কেউ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সর্বশেষ দুই সিরিজে বাংলাদেশের বিপক্ষে তাঁর রানের গড় ৬২৪! ব্যাপারটা মুশফিকের জানা ছিল না। তার পরও বললেন, ‘সব মিলিয়ে টেস্টে চন্দরপলের রানের গড় ৫০ এর মতো। তার পরও ওর রান করার ক্ষুধাটা দেখেন। এত লম্বা সময় ব্যাটিং করেও কোনো এলোমেলো শট খেলে না। অথচ আমাদের ক্ষেত্রে একটু ভালো কিছু করলেই প্রতিজ্ঞাটা কমে যায়।’
সেন্ট লুসিয়া টেস্টে তামিম-মুমিনুলের লড়াইয়ের পর ব্যাটনটা যে আর কেউই নিতে পারলেন না, সে জন্যও ক্ষোভ অধিনায়কের কথায়, ‘যেভাবে জুটি হচ্ছিল, আশা ছিল ৭-৮ উইকেট হাতে নিয়ে যদি পরের দিনে যেতে পারি তাহলে অন্তত দুটি সেশন খেলার পরিকল্পনা করতে পারব। ব্রেক থ্রু হতেই পারে। তবে একটা অবস্থা পর্যন্ত তো অন্তত থাকা উচিত। এত কষ্ট করে ওরা খেলছিল…! তামিম ৫০ করছে একটা চার আর একটা ছয় মেরে।’
ওয়ানডে-টেস্ট দুটিতেই বাজেভাবে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর ২০১৪ সালটা বাংলাদেশ দলের জন্য এখনো অপয়াই রয়ে গেল। টানা ব্যর্থতার কারণ কি শুধু মাঠে খারাপ খেলা, নাকি অন্য কিছুও আছে এর পেছনে! ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ চলাকালে দলের ভেতর থেকে অনেক ফিসফাস শোনা গেছে। নতুন কোচিং স্টাফের কারও কারও সঙ্গে দু-একজন খেলোয়াড় এবং টিম ম্যানেজমেন্টের কোনো কোনো সদস্যের মনোমালিন্য তার মধ্যে একটা। একাদশ নির্বাচন নিয়ে দ্বিমতও নাকি দু-একবার বড় তর্কে রূপ নিয়েছে! মাঠের ব্যর্থতায় এসবের কোনো প্রভাব নেই তো? অধিনায়ক অবশ্য সরাসরিই নাকচ করে দিতে চাইলেন, ‘মনে হয় না মাঠের বাইরের কোনো সমস্যা এখানে কাজ করেছে। ভালো করার জন্য যা যা করা দরকার আমরা সবই করছি।’ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে এও বললেন, ‘ওপরে (বিসিবি) যাঁরা আছেন তাঁরা যদি মনে করেন আমাদের দিয়ে হবে না, তাঁরা পরিবর্তন আনলে আনতে পারেন। এখানে আমাদের হাত নেই। তবে চেষ্টাটা আমাদের হাতে ছিল।’
মুশফিকের চোখে টানা ব্যর্থতার একটাই কারণ, ‘আমরা ভালো অবস্থায় যাচ্ছি, কিন্তু সেখান থেকে এগোতে পারছি না। যেটা আজকেও (পরশু) হয়েছে। ভালো একটা অবস্থানে যাচ্ছিলাম এবং মনে হচ্ছিল পরদিন সকালে আবার আসতে পারব, অন্তত চেষ্টা করতে পারব। কিন্তু কিছু একটা আমরা ভুল করে ফেলছি, সেটার জন্য হচ্ছে না।’ কথা প্রসঙ্গে অধিনায়ক নিজেই তুলেছেন নাসির হোসেনের নাম। এই সিরিজে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতার প্রতীক বলতে পারেন নাসিরকে। কিন্তু অধিনায়ক সেটা মনে করেন না, ‘দুর্ভাগ্যজনক একটা সফর গেল নাসিরের জন্য। ও যে মানের খেলোয়াড় তার জন্য খুবই খারাপ সফর গেল। তবে ও যে কষ্ট করছে না, তা নয়।’
অধিনায়কের একটা বড় কাজই হলো ছাই থেকেও মুক্তা খোঁজার চেষ্টা করা। শত ব্যর্থতার পরও তাঁকে বলতে হয়, এখানে তো এই এই ইতিবাচক দিকও আছে! ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে যেমন বললেন তামিম-মাহমুদউল্লাহর রানে ফেরা আর পেসারদের ভালো বোলিংয়ের কথা।
কিন্তু এ রকম ছেলে-ভোলানো গান আর কত দিন?
স্কোরকার্ড
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৩৮০ ও ২৬৯/৪ ডি.
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ১৬১ ও
বাংলাদেশ ২য় ইনিংস (লক্ষ্য ৪৮৯ রান)
তামিম ক গ্যাব্রিয়েল ব বেন ৬৪ ১৮১ ২ ১
শামসুর ক এডওয়ার্ডস ব টেলর ৩৯ ২৭ ৪ ২
এনামুল ক রামদিন ব বেন ০ ৮ ০ ০
মুমিনুল ক গ্যাব্রিয়েল ব বেন ৫৬ ১৩৯ ৫ ০
মাহমুদউল্লাহ এলবিডব্লু ব গ্যাব্রিয়েল ০ ৬ ০ ০
মুশফিক ব টেলর ১১ ৫৪ ১ ০
নাসির এলবিডব্লু ব বেন ২ ১০ ০ ০
তাইজুল ক ও ব বেন ৪ ১২ ০ ০
শফিউল ব রোচ ১৪ ২৪ ২ ০
রবিউল এলবিডব্লু ব টেলর ০ ৪ ০ ০
আল আমিন অপরাজিত ০ ১ ০ ০
অতিরিক্ত (লেবা ১, ও ১) ২
মোট (৭৭.৪ ওভারে অলআউট) ১৯২
উইকেট পতন: ১-৪৭ (শামসুর, ৮.৪ ওভার), ২-৪৮ (এনামুল, ১১.৪), ৩-১৫৮ (তামিম, ৫৮.৫), ৪-১৬০ (মাহমুদউল্লাহ, ৫৯.৬), ৫-১৬০ (মুমিনুল, ৬০.১), ৬-১৬৭ (নাসির, ৬২.৫), ৭-১৭৩ (তাইজুল, ৬৮.১), ৮-১৮৮ (মুশফিক, ৭৬.১), ৯-১৮৮ (রবিউল, ৭৬.৫)।
বোলিং: টেলর ১৩-৪-৩৯-৩, রোচ ১৫.৪-১-৪৩-১, বেন ৩২-৬-৭২-৫ (ও ১), ব্ল্যাকউড ২-০-৪-০, গ্যাব্রিয়েল ১১-২-২৪-১, জনসন ৪-০-৯-০।
ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৯৬ রানে জয়ী।
সিরিজ: ২–ম্যাচ সিরিেজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২-০তে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: শিবনারায়ন চন্দরপল।
ম্যান অব দ্য সিরিজ: ক্রেইগ ব্রাফেট।