কোরবানির পশুর হাটকে ঘিরে নারায়ণগঞ্জে বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে গরু সন্ত্রাসীরা। নারায়ণগঞ্জের হাটগুলোতে প্রবেশের প্রধান নৌপথ শীতলক্ষ্যা নদীপথও ওই গরু সন্ত্রাসীদের দখলে চলে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামমাত্র তৎপরতায় ইতিমধ্যে হাটে গরু উঠানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া একটি বিনোদন পার্কের জায়গা দখল করে হাট সম্প্রসারণ করেছে আওয়ামী লীগ নেতারা। এখানেই শেষ নয়, গরু সন্ত্রাসীদের হামলায় মঙ্গলবার ১১টি বোবা প্রাণী (গরু) নদীতে ডুবে মারা যায়। এ ঘটনার পর চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে গরুর বেপারিদের মাঝে। অভিযোগ রয়েছে, এবার নারায়ণগঞ্জের সকল হাট পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। লোক দেখানোভাবে সাধারণ বা দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে হাট ইজারা নিলেও পর্দার অন্তরালে বসে হাট নিয়ন্ত্রণ করছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের ক্যাডাররা। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, রাজপথে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিরোধ থাকলেও একাধিক পশুর হাটে বিএনপির নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে হাট পরিচালনা করছে। হালুয়া-রুটির ভাগ নিতে তারা এখন কোরবানির হাটে এক কাতারে অবস্থান করছে। তবে পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ট্রলার ডুবে ১১টি গরুর মৃত্যুর ঘটনায় আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করায়, এবং আমাদের মধ্যস্থতায় গরিব বেপারিরা ক্ষতিপূরণ বাবদ দশ লাখ টাকা পেয়েছে। আর যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেজন্য পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ গরুর হাটগুলোর ইজারাদারদের নাম কাগজ কলমে থাকলেও এসব হাট পরিচালনার নেপথ্যে রয়েছেন সরকারি দলের পরিচয়ে একাধিক ব্যক্তি। আর প্রভাবশালী এসব নেতার পক্ষ হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে গরু নিয়ে টানাহেঁচড়া করছে গরু সন্ত্রাসীরা। আর পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়েন ওই নেতারা। সূত্র মতে, নদীর দু’পাশ জুড়ে বেশ কয়েকটি হাট থাকায় বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রলারে করেই গরু নিয়ে বেপারিরা হাটে আসেন। আর প্রতিটি হাটের ইজারাদাররা চান নিজ নিজ হাটে বেশি গরুর সমাগম। এ জন্য তারা নদীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে নিজ নিজ দলের সন্ত্রাসীদের দায়িত্বে রেখেছেন নদী পাহারায়, যেন গরুবাহী ট্রলার তাদের ঘাটে ভিড়াতে পারেন। এই গরু শিকারিদের নির্মমতায় প্রায় প্রতি বছরই র্দুঘটনা ঘটে। প্রাণ হারায় বোবা প্রাণী গরু। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার স্থায়ী-অস্থায়ী হাটগুলো উপজেলা প্রশাসক ও সিটি কর্পোরেশন থেকে ইজারা দেয়া হয়। এ হাটগুলোর মধ্যে প্রতি বছরই দরপত্রের সময় বেশ আলোচনায় আশে সিটি কর্পোরেশন থেকে ইজারাকৃত ১নং খেয়া ঘাট ও বরফ কল মাঠ। দরপত্রের মূল্যানুসারে মাঠ সরগরম রাখে- ১নং খেয়াঘাট সংলগ্ন রাস্তা, বরফকল মাঠ, জিমখানা আলাউদ্দিন খান স্টেডিয়াম মাঠ, শীতলক্ষ্যা কোল্ড স্টোর সংলগ্ন সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ভূমি, জামাল সোপ খেয়াঘাট সংলগ্ন খালি জায়গা, নবীগঞ্জ অস্থায়ী পশুর হাট, সোনাকান্দা অস্থায়ী পশুর হাট। তবে বেশির ভাগ গরুর হাটের ইজারাদারের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এক সময়ের সন্ত্রাসী, বিতর্কিত সমালোচিত নেতারা জড়িত। কাগজ পত্রে ব্যবসায়ীদের নাম ব্যবহার করলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মূলত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাদের অর্থ লগ্নি থাকে। সূত্র জানায়, জেলার এবারের সবচেয়ে আলোচিত বন্দর ১নং খেয়া ঘাটের হাট, যা গত বারের চাইতে প্রায় ১৫ লাখ টাকা বেশি দরপত্র দাখিল হয়। আবুল কালাম আজাদের নামে ৭০ লাখ টাকায় ইজারা পাওয়া এই হাটের পেছনে রয়েছে একটি বড় সিন্ডিকেট। বরফ কল মাঠের ইজারাদার মো. মনির হোসেন হলেও তার সঙ্গে খানপুর, তল্লার আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়িত। ইতিমধ্যে এই হাটের লোকজন নির্মাণাধীন একটি বিনোদন পার্কের জায়গা দখল করে হাটের সম্প্রসারণ করেছে। বিএনপি নেতা রিয়াদ হাসান হাট ইজারা পান জিমখানা আলাউদ্দিন খান স্টেডিয়াম মাঠের। এ হাটেও রয়েছে শহর যুবলীগের ওই শীর্ষ নেতার শেয়ার। গত কয়েকদিন অন্য হাটের ইজারাদারদের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে এই হাটের সন্ত্রাসীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় বেশ কয়েকজন আহত হয়। তাদের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ সব সময় নদীর পারে টহলরত। জাপা নেতা আবদুর রশিদ ইজারা পান শীতলক্ষ্যা কোল্ড স্টোর সংলগ্ন সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ভূমির হাটে। তার সঙ্গে রয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন ও মহানগর শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামরুল হাসান মুন্না।
পার্কের জমি দখল করে পশুর হাট: এদিকে শহরের খানপুর বরফ কল মাঠ গরুর হাট ইজারাদার আওয়ামী লীগ নেতা মনির হোসেন। ২৬শে সেপ্টেম্বর হাটের লোকজন নির্মাণাধীন বিনোদন পার্কের জমি দখল করে কোরবানির পশুর হাট সম্প্রসারণ করেছে। এ সময় তারা পার্কের কাঁটাতারের বেড়া কেটে দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে। এবং সাইট অফিসের ৬০/৭০টি চেয়ার লুটে নেয় ও পার্কের বাগান লণ্ডভণ্ড করে সেখানে বাঁশের খুঁটি গেড়ে গরু বেঁধে রাখে বলে জানিয়েছেন পার্কের মালিক আবদুস সাত্তার। তিনি জানান, বিআইডব্লিউটিএ’র কাছ থেকে খানপুর বরফকল মাঠ সংলগ্ন শীতলক্ষ্যার তীরে ২ একর ৯ শতাংশ জমি লিজ নিয়ে চৌরঙ্গী ফ্যান্টাসি পার্ক নির্মাণ কাজ শুরু করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন তার কাছে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করে আসছিল। চাঁদা না পেয়ে তারা পার্কের জমি দখল করে গরুর হাট বসিয়েছে বলে জানান আবদুস সাত্তার।
সিটি করেপারেশন এলাকার ১৮টি হাটের ইজারাদার যারা: সূত্রমতে, নারায়ণগঞ্জ শহরের বরফকল মাঠ ও খেয়াঘাট সংলগ্ন রাস্তার উপরে বসা পশুর হাটের ইজারা পান আওয়ামী লীগ নেতা মো. মনির হোসেন। শহরের জিমখানা আলাউদ্দিন খান স্টেডিয়াম মাঠের শহর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান আহমেদ। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে শীতলক্ষ্যা কোল্ডস্টোর সংলগ্ন সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ভূমির হাটের ইজারাদার আব্দুর রশিদ। শহরের নবাব সলিমুল্লাহ রোডস্থ মেডিস্টার ক্লিনিক সংলগ্ন মাঠের ইজাদার আনিছুর রহমান। শহরের চারুকলা ইন্সটিটিউট সংলগ্ন খালী মাঠের ইজারাদার মহানগর বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন মন্টি। বন্দর ১নং খেয়াঘাট সংলগ্ন অস্থায়ী পশুর হাটের ইজাদার আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ। জামাল সোপ খেয়াঘাট সংলগ্ন খালি জায়গায় অস্থায়ী পশুর হাটের ইজারাদার জামান। নবীগঞ্জ অস্থায়ী পশুর হাটের ইজারাদার আওয়ামী লীগ নেতা ফয়সাল। উত্তর লক্ষণ খোলা খেয়াঘাট সংলগ্ন অস্থায়ী পশুর হাটের ইজাদার আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম চৌধুরী। সোনাকান্দা অস্থায়ী পশুর হাটের ইজাদার জাপা নেতা তাওলাদ হোসেন। চৌড়াপাড়া অস্থায়ী পশুর হাটের ইজাদার আওয়ামী লীগ নেতা শাহজালাল মেম্বার। সিদ্ধিরগঞ্জের নিউ লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশনের খালি জায়গায় পশুর হাটের ইজারাদার মনির হোসেন। মিজমিজি পূর্ব পাড়া ডিএনরোড সংলগ্ন খালি জায়গায় অস্থায়ী পশুর হাটের ইজাদার আবদুল কাদের খোকন। গোদনাইল ধনকুন্ডাস্থ ইব্রাহিম টেক্সটাইল মিলসের মাঠে অস্থায়ী পশুর হাটের ইজাদার আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আলম। জালকুড়ি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের ইজারাদার রেজাউল করিম। গোদনাইল শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়, এসও রোড সংলগ্ন সফর আলী ভূইয়া বালুর মাঠ হাটের ইজারাদার যুবলীগ নেতা শাহ আলম মানিক। নিউ রাখী টেক্সটাইল মিলস্ লিঃ এর উত্তর পার্শ্বে আইয়ুুব নগর মাঠ হাটের ইজারাদার বাহাদুর উদ্দিন। আটি এলাকাস্থ মনোয়ারা জুট মিলস্ প্রাঃ লিঃ এর পূর্ব পার্শ্বের খালি মাঠ হাটের ইজাদার আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম।