প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পড়ার ইচ্ছে প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীই মনে-প্রাণে লালন করে। উচ্চমাধ্যমিকের স্তর পেরিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পড়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে তারা। এক্ষেত্রে অনেকে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে পরের বছর ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটির এক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থীরা আর দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ পাবে না। হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই বিপদে পড়েছেন।
বছরের পর বছর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার নিয়ম চলে আসছে। অনেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়বে বলে অন্য কোথাও ভর্তি ফরম তোলে না এবং পরের বছর ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দেয়। কিন্তু এবার হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় যারা এবছর কোথাও ফরম তোলেনি, তাদের কী হবে? তারা তো জানতো না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথটাকেই বন্ধ করে দিবে।
এরই মধ্যে আজ শুক্রবার প্রায় কয়েকশ’ শিক্ষার্থী এই নিয়ম বাতিলের দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ করছে। বিক্ষোভ করাটাই স্বাভাবিক এবং তাদের দাবি মেনে নেওয়া উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্তে হইহই পড়ে গেছে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে। হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া ঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অনেক শিক্ষাবিদই। তারা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত নিলেও অন্তত এক বছর সময় শিক্ষার্থীদের দেওয়া উচিত।
এছাড়া গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রথম আলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিক সিদ্দিকের ভাষ্য এসেছে এরকম,
‘‘যারা ভর্তি পরীক্ষায় নিজেদের মেধার প্রমাণ রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখবে, তাদের জানাই অগ্রিম অভিনন্দন। আর যারা পারবে না, তারা হতাশ হয়ো না, নিজেদের স্বপ্ন সফল করতে তোমরা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিজেদের প্রতিভার ছাপ রাখো। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই যদি হয় তোমার স্বপ্ন, সে ক্ষেত্রে আরেকবার সুযোগ তো তোমরা পাচ্ছই।’’ (বিশেষ ক্রোড়পত্র ‘স্বপ্ন নিয়ে’ থেকে)
কিন্তু গত ১৪ অক্টোবর উপাচার্য মহোদয় জানালেন, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে দ্বিতীয়বার আর ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকছে না। এমন সংবাদে শিক্ষার্থীদের আকাশ থেকে পড়ার মতো হলো। কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্নকে হত্যা করা হলোই, সঙ্গে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়া সুযোগটিকেও হত্যা করা হলো। কারণ আগামী বছরের প্রস্তুতির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আশ্বাসের পর অনেক শিক্ষার্থীই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফরম তুলেনি। তারা কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে বলেই স্বপ্ন লালন করে যাচ্ছে। কিন্তু এখন তাদের কী হবে? অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ফরম তোলার সময়ও তো শেষ।
নতুন এই সিদ্ধান্তে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্নকেই হত্যা করা হলো না, সঙ্গে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগটাকেই যেন টুঁটি চেপে হত্যা করা হলো। এটি করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণায় নেতৃত্ব দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজে। তিনি নিজে শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয়বারের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন, আবার এক মাস পর তিনি নিজেই ঘোষণা দিলেন পরের বছর থেকে শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিতে পারবে না। এমন প্রতারণা করার অধিকার কী কারো আছে? যেসব শিক্ষার্থী এই প্রতারণার শিকার হলেন, তাদের এখন কী হবে? সেই সঙ্গে যদি সব বিশ্ববিদ্যালয় এখন এই নিয়ম করে, তাহলে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কথায় কোথাও ফরম তুলেনি, তারা কী করবে? তারা কী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে না? এর সমাধান কী?
নতুন নিয়ম করতে যুক্তি দেখানো হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে অপেক্ষাকৃত যারা দুর্বল বিষয়ে ভর্তি হয়, তারা আবারও ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বিষয় পরিবর্তন করে। ফলে প্রতিবছর কিছু আসন ফাঁকা হয়ে যায়।
কিন্তু এই জন্য লাখ লাখ শিক্ষার্থী কেন তাদের সুযোগ হারাবে? এক্ষেত্রে নিয়ম করতে পারে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, তারা আর ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। যদি নিতে চায়, তাহলে সে দুর্বল বিষয়ে ভর্তি না হয়ে পরের বছর পরীক্ষা দিতে পারে। তাহলে আর আসনটি খালি হবে না।
আরেকটি যুক্তি দেখানো হয়েছে, কোচিং বাণিজ্যের বিষয়। এক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন, কোচিং বাণিজ্য কী এবার থেমে ছিল? পরীক্ষার পর ফলাফল দিতে দুই মাস এবং ভর্তি কার্যক্রমের জন্য আরও একমাস মোট তিন মাসে তো কোচিং ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা ঠিকই করেছে। এই ব্যবসা বন্ধের জন্য বিকল্প চিন্তা করতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? একমাস সময় পেলেও কোচিং ব্যবসায়ীরা মডেল টেস্টের নামে কোচিং করে যাবে।
অন্যদিকে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি পরিবর্তন করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়। আমি এর বিরোধিতা করছি না। কিন্তু সেক্ষেত্রে একটু সময় নিয়ে করা যেতে পারে। এতে এত তাড়াহুড়োর কী আছে? নতুন নিয়মটি আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য না করে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের জন্য কার্যকর হতে পারে। তাহলে এবার যেসব শিক্ষার্থী স্বপ্নভঙ্গ হতে যাচ্ছে, সে দায় থেকে মুক্ত থাকতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয়।
অন্তত যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরম তুলেনি, তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হবে। না হলে তারা এই অভিযোগ আজীবন করে যাবে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা নেওয়া হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের স্বপ্নকে গলা চেপে ধরে হত্যা করেছে। আর তাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এটা মেনে নিতে আমার খুবই কষ্ট হবে। আমি মানতে পারব না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে আমি অস্বীকার করতে পারব না যে, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই তোমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছে, আবার সেই স্বপ্নকে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, তোমাদের উচ্চ শিক্ষা নিতে বাধা সৃষ্টি করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই তোমরা কোথাও ফরম তুলোনি, উচ্চ শিক্ষা নিতে পারোনি। তোমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। আমি নিজে তার স্বাক্ষী। তবে আমাকে তোমরা ক্ষমা করো।
ইতোমধ্যে কয়েকজন শিক্ষার্থীই আমাকে এমনটা প্রশ্ন করেছে যে, তাহলে কগত ৭ সেপ্টেম্বর উপাচার্য মহোদয় কেন দ্বিতীয়বার প্রস্তুত নিতে বললেন? এই কথা না বললে হয়তো অন্য জায়গায় ফরম তুলতো তারা। আমি জানি, আমার মতো আরও অনেককেই এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, হচ্ছে।
কিন্তু আবারও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আমাকে কিংবা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি কিংবা যারা আমাদের শিক্ষক আছেন, তাদের কাউকে যেন না হতে হয় সেই অপেক্ষায় আছি। আমি অপেক্ষায় আছি, উপাচার্য মহোদয় এরই মধ্যে বিষয়টি চিন্তা করে দেখবেন। ভর্তি কমিটিতে যারা আছেন, তারাও বিষয়টি ভাববেন। একটি ব্যাচের হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের স্বপ্নকে সত্যি করে দেওয়ার সুযোগ দেবেন। নতুন নিয়মটি ২/১ বছর পর থেকে কার্যকর হবে।
কিন্তু আমার এই অপেক্ষা কী সত্যি হবে? নাকি শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হতে হবে?
বি.দ্র. আমি বরাবরই আমার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গর্বিত। গত পাঁচ বছরে দেশের প্রায় সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করেছে। বিভিন্ন কারণে দিনের পর দিন বন্ধ থেকেছে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু কেবল একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই কোনো অস্থিরতা তৈরি হয়নি। একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি এই বিশ্ববিদ্যালয়। এটা কেবল সম্ভব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের জন্যই। বিভিন্ন সময় অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হলেও সফলতা পায়নি সেই মহল। এই জন্য আমি গর্ব করি উপাচার্য স্যারকে নিয়েও। কিন্তু আমার এই গর্ব যেন আজীবন করতে পারি, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে তিনি উদ্যোগ নিবেন বলেই আশা করি।