এ অবস্থায় সরকারি কলেজগুলো সংকটে আর বেসরকারিগুলো মহাসংকটে। সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা এখন ২৯ আর বেসরকারি ৫৬। বেসরকারি খাতে সর্বশেষ যোগ হয়েছে আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামান ভূইয়ার মেডিকেল কলেজও।
এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুমোদন পায় সরকারি পাবনা, নোয়াখালীর আবদুল মালেক ও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, গাজীপুরের তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গোপালগঞ্জের সৈয়দা সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়। এগুলোও সরকারি খাতে।
অন্তত ১০টি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্ররা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক পাচ্ছেন না। কোথাও কোথাও শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১:২০০। মৌলিক বিজ্ঞানের কমপক্ষে ১০ জন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেছেন, এমবিবিএস প্রথম বর্ষ হলো একজন শিক্ষার্থীর পেশাগত জীবনের প্রবেশদ্বার। আর মৌলিক বিজ্ঞান এর ভিত্তি। একজন শিক্ষার্থী মেডিকেল কলেজে ঢুকেই যদি দেখেন ক্লাস হচ্ছে না, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই তখন তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ভিত্তি মজবুত না হওয়ায় অন্য বিষয়গুলোও তিনি আর ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারেন না। সুচিকিৎসক হওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে যায়।
সংকটের তীব্রতা: ৬৪ জেলার বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ২৯। একদিকে মেডিকেল কলেজ বাড়ছে, ছাত্রদের আসনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে অনুমোদিত পদের তুলনায় শিক্ষক কম।
অপেক্ষাকৃত নতুন মেডিকেল কলেজগুলোর একটি নোয়াখালীর আবদুল মালেক মেডিকেল কলেজ। পাঁচ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত কলেজটিতে এখন পর্যন্ত ফরেনসিক মেডিসিনের কোনো শিক্ষক নেই। একজন প্রভাষক বিভাগটি চালান। কখনো স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা, কখনো শল্যচিকিৎসকদের সহযোগিতা নেওয়া হয়।
খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ আল মাহবুব জানান, তাঁর কলেজে সব বিষয়ে শিক্ষকসংকট। ৫০ আসনের জনবল চাওয়া হয়েছিল। সেই জনবলই পাওয়া যায়নি। তার তিন গুণ ছাত্র এখন ভর্তি হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অনুমোদন পাওয়া ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত অ্যানাটমি বিভাগ চালিয়েছেন অর্থোপেডিকসের সার্জন আ স ম জাহাঙ্গীর চৌধুরী। তিনি এখন কলেজটির অধ্যক্ষ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এখনো তাঁর কলেজে অ্যানাটমি, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেনসিক মেডিসিন ও কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপকের পদ শূন্য। কমিউনিটি মেডিসিনে আছেন একজন সহকারী অধ্যাপক। প্রায় একই সময়ে চালু হওয়া দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের চিত্রও একই। অ্যানাটমি বিভাগে অধ্যাপক আছেন একজন, সহযোগী-সহকারী অধ্যাপক নেই। প্রভাষকের সাতটি পদও শূন্য।
সংকট ছড়িয়ে পড়েছে: নতুন মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি এখন পুরোনোগুলোতেও শিক্ষকসংকট দেখা দিচ্ছে। এ তালিকায় আছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহের মতো মেডিকেল কলেজগুলো। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, এখানে অ্যানাটমির একজন মাত্র অধ্যাপক আছেন। এই একজন অধ্যাপক প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ৪০০, স্নাতকোত্তরের ১০০ ও ডেন্টালের ৭০ অর্থাৎ ৫৭০ জন ছাত্র পড়ান। কলেজে সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক নেই। কখনো শল্যবিদ্যা বিশেষজ্ঞ (সার্জন), কখনো অ্যানাটমির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অনুরোধ করে ক্লাসে নিয়ে আসা হয়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষে কমিউনিটি মেডিসিন পড়ান জোহা এম এম খান। তাঁর বিভাগেও একজন অধ্যাপক, দুজন প্রভাষক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কমিউনিটি মেডিসিন বা জনস্বাস্থ্য হাল আমলে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় বিষয়। কিন্তু একজন শিক্ষককে যখন একসঙ্গে ২০০ জনের ক্লাস নিতে হয় তিনি ছাত্রদের প্রতি মনোযোগ দিতে পারেন না। টিউটোরিয়ালে একজন শিক্ষকের বিপরীতে ছাত্র ৪০ জন। টিউটোরিয়ালে ছাত্রসংখ্যা ১০ জনের বেশি হওয়া উচিত নয়।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ চলছে দুজন প্রভাষক দিয়ে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বলেন, এই দুজন প্রভাষককে ক্লাস নিতে হয়। ধর্ষণের শিকার নারীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে হয় তাঁদের, অস্বাভাবিক কারণে মৃত্যু হলে মৃতদেহের ময়নাতদন্তও করতে হয়, নিয়মিত আদালতে হাজিরাও দিতে হয়।
অনুমোদন ৩৭টির: বিএমডিসি সূত্রে জানা যায়, সরকার ৫৬টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিলেও বিএমডিসির অনুমোদন আছে ৩৭টির। বিএমডিসি বলছে, অনুমোদন নেওয়ার সময় মেডিকেল কলেজগুলো শিক্ষকদের যে তালিকা দিচ্ছে পরিদর্শনে গিয়ে সে তালিকার সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে না। একই শিক্ষককে চারটি মেডিকেল কলেজের পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে দেখানো হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, মৌলিক বিজ্ঞানে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় যে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে, সেসব কোর্সে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের জন্য কোটার সুযোগ রাখতে হবে।
ঢাকা, বগুড়া, কুমিল্লার অন্তত তিনটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে খোঁজ নিয়ে শিক্ষকসংকটের একই রকম চিত্র পাওয়া গেছে। বগুড়ার টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর থেকে শিক্ষক ধার করে এনে মেডিকেল কলেজ চালাচ্ছে। কুমিল্লার ময়নামতি মেডিকেল কলেজে মৌলিক বিজ্ঞানের আটটি বিষয়ের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পদগুলোর একটিতেও শিক্ষক নেই।
ঢাকার নর্দান মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্র বলেন, অ্যানাটমিতে তাঁদের অধ্যাপক আছেন। সহযোগী, সহকারী অধ্যাপক নেই। অধ্যাপক শুধু হাড়গোড় পড়ান, এর বাইরে ভিসেরা, হৃদ্যন্ত্র, ফুসফুস—এগুলো চেনানোর মানুষ নেই। বায়োকেমিস্ট্রির শিক্ষক খুব নামকরা। তিনি মাঝেমধ্যে কলেজে আসেন। নিয়মিত ক্লাস হয় না।
সংকট কেন? মৌলিক বিজ্ঞানের আটটি বিষয়ের মধ্যে প্যাথলজি, ফার্মাকোলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি ছাড়া অন্য বিষয়গুলোয় বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই। ফলে বেশির ভাগ চিকিৎসকই ক্লিনিক্যাল বিষয় বেছে নেন।
মেডিকেল কলেজগুলোয় এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সংকট ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসকের। ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে সারা দেশে অধ্যাপকের পদ আছে ১৭টি, আছেন একজন। মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি সেলিম রেজা বলেন, কোনটি স্বাভাবিক মৃত্যু, কোনটি আঘাতজনিত/অস্বাভাবিক মৃত্যু এ বিষয়গুলো নির্ণয়ে ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসক অপরিহার্য। এ বিভাগের চিকিৎসকদের অনেক কাজ। কিন্তু সে তুলনায় আয়-রোজগার কম।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এম ইকবাল আর্সালান বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে মৌলিক বিজ্ঞানের শিক্ষকদের প্রণোদনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে শিক্ষকসংকট কাটাতে প্রণোদনা দেওয়া জরুরি।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব আইয়ুবুর রহমান জানিয়েছেন, মৌলিক বিজ্ঞানের শিক্ষকদের মূল বেতনের ১০০ ভাগ ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।