প্রযুক্তির নিত্য নতুন পণ্যের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রযুক্তির বাজার। এসব প্রযুক্তি পণ্যের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে বিশ্বের বড় বড় দেশ। অন্য দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও প্রযুক্তিপণ্যের বাজার বাড়ছে। ফলে প্রযুক্তি পণ্যের বাজারে শীর্ষ দেশের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম।
প্রযুক্তির পথে অনেক বড় অগ্রগতি হলো ইন্টারনেট। আর সেই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে আমাদের মুঠোফোন বা স্মার্টফোনগুলোতে। থ্রিজি সেই ধারায় একটি মাইলফলক। গত বছর বাণিজ্যিকভাবে চালু হয় থ্রিজি সেবা। আর এ সেবা চালু হওয়ার পর দেশে স্মার্টফোনের বিক্রি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আর এই অগ্রগতি আগামী বছর নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০ স্মার্টফোন বাজারের একটি হতে যাচ্ছে বলে মনে করছে খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিএফকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।
একই ধরনের গবেষণা করেছে ভারত ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সাইবার মিডিয়া রিসার্চ (সিএমআর)। এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, স্মার্টফোনের প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে এ খাতের সাথে সামগ্রিক আয়ও বাড়বে। আর ফিচার ফোনের তুলনায় স্মার্টফোনের দাম বেশি হওয়ায় এ আয় বাড়বে। পাশাপাশি তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাবে মুনাফাও। তবে একইসাথে বাজার প্রসারের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে। এতে সুবিধা ভোগ করবেন ক্রেতারা। এই প্রতিষ্ঠানটির করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর শেষে বাংলাদেশের স্মার্টফোনের বাজারে শুধুমাত্র সিম্ফনিরই অংশ দাঁড়িয়েছে ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশ। তালিকায় এর পরের অবস্থানগুলোতে রয়েছে যথাক্রমে ওয়ালটন ও স্যামসাং।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিআইএ) সাধারণ সম্পাদক রেজওয়ানুল হক বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে স্মার্টফোনের বিক্রি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে এবং এই বৃদ্ধির হার অব্যাহত রয়েছে। থ্রিজি সেবা চালু এর পেছনে একটি বড় কারণ। এর সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের ফিচার নিয়ে হাজির হওয়া স্মার্টফোনগুলোর দাম আগের তুলনায় অনেক কমে আসায় গ্রাহকরা স্বল্পমূল্যে নিজেদের পছন্দমতো ডিভাইস কিনতে পারছেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশের ক্রেতারা মূলত বাজেটসাশ্রয়ী হ্যান্ডসেটের কিনেতই বেশি আগ্রহী। বাজারে এ ধরনের স্মার্টফোনের সরবরাহ বেড়েছে। আবার স্মার্টফোনে নানা ধরনের ফিচারের সাথে সাথে তারা বিক্রয়োত্তর সেবাতেও গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এর ফলে কমদামের যেসব ডিভাইসে বিক্রয়োত্তর সেবা রয়েছে, সেগুলো গ্রাহকদের পছন্দের তালিকায় ওপরে উঠে আসছে।
এ বিষয়ে বিএমপিআইএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে দেশে হ্যান্ডসেট বিক্রি হয় দুই কোটির বেশি। এই অগ্রগতি ধরে রাখলে আগামী বছর নাগাদ হ্যান্ডসেটের বিক্রি পাঁচ কোটি ছাড়াবে বলে মনে করছে সংগঠনটি। এদিকে দেশে স্মার্টফোন বাজারের সাথে সাথে ফিচার ফোনের বাজারেও শীর্ষস্থান দখলে রেখেছে সিম্ফনি। জিএসএমএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফিচার ফোনের ক্ষেত্রে সিম্ফনির দখলে রয়েছে বাজারের ৩৪ শতাংশ, ম্যাক্সিমাসের ৭, নকিয়ার ৬, মাইক্রোম্যাক্সের ৫ ও অন্যান্য ব্র্যান্ডের দখলে রয়েছে ৪৩ শতাংশ। অপরদিকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৪২ লাখ, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ৫০ লাখ, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৬৮ লাখ, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৭৮ লাখ, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১ কোটি ২ লাখ, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ কোটি ২৮ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ কোটি ৫০ লাখ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ কোটি ৯৮ লাখ হ্যান্ডসেট আমদানি হয়।
প্রতিবেদন থেকে এটি স্পষ্ট যে কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের বাজারে বাড়ছে হ্যান্ডসেটের আমদানি। মোবাইলের গ্রাহক সংখ্যার প্রবৃদ্ধি হ্যান্ডসেটের প্রবৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে। মূলত ২০০৫ সালের পর থেকে দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ঘটে। ২০০৭ সালে তিন কোটি, ২০০৮ সালে চার কোটি, ২০০৯ সালে পাঁচ কোটি, ২০১০ সালে ৬ কোটি, ২০১১ সালে ৮ কোটি, ২০১২ সালে ৯ কোটি ও ২০১৩ সালে ১১ কোটির অঙ্ক ছুঁয়েছে মোবাইল ফোনের গ্রাহক সংখ্যা। আর গ্রাফ অনুযায়ী আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ এ সংখ্যা ১২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। গত বছরের শেষের দিকে দেশের চার মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল থ্রিজি সেবা চালু করলে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্রুতগতিতে।
দেশের ছয় সেলফোন অপারেটরের টুজি নেটওয়ার্কে এরই মধ্যে ১১ কোটিরও বেশি সংযোগ যুক্ত হয়েছে। আর ভয়েস কলের ট্যারিফ ব্যাপক হারে কমানোর পাশাপাশি মোবাইল হ্যান্ডসেটের দাম কমে আসায় টুজি প্রযুক্তির সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছে অপারেটররা। থ্রিজি প্রযুক্তি মূলত ডাটাভিত্তিক সেবাদানের ক্ষেত্রে সহায়ক। থ্রিজি নেটওয়ার্ক উপযোগী সব হ্যান্ডসেটেই ডাটাভিত্তিক সেবা গ্রহণ করা সম্ভব। তবে শুধু স্মার্টফোনই নয়, আমাদের দেশের বাজার নানা ধরনের প্রযুক্তি পণ্যে ভরে গেছে। আর দিনকে দিন এর আকারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্মার্টফোনের পাশাপাশি কম্পিউটার, ট্যাবলেট পিসি, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ডিজিটাল ক্যামেরা, এলসিডি ও এলইডি টেলিভিশন, প্রিন্টারসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্যের চাহিদা বাড়ছে আমাদের দেশে। ফলে এসব পণ্যের আমদানি ও বিক্রিও বাড়ছে। জার্মান ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিএফকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর শেষে আমাদের দেশে প্রযুক্তিপণ্যের বাজার দাঁড়াবে ৩৩০ কোটি ডলার। আর আগামী বছর নাগাদ এটি ৩৮০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এতে করে প্রযুক্তি পণ্যের এই বাজারের প্রবৃদ্ধির হার ১৩ শতাংশ হবে পূর্বাভাস দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোন বাজারের প্রবৃদ্ধি হবে ১৮ শতাংশ। আর এ প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান বেশ কয়েকটি দেশ। প্রযুক্তির এ অগ্রগতির ধারায় এ সময়ে শীর্ষ ১০ স্মার্টফোন বাজারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে সাতটি নতুন দেশ, যার অন্যতম বাংলাদেশ। তবে জিএফকের সার্বিক প্রযুক্তি পণ্যের বাজারের শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় চলতি বছরেই স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে ছয়ে। এই বাজারে ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি থাকায় সামনের বছরেও এই স্থানের নড়চড় হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই অনুমান করেছে জিএফকে। বহির্বিশ্বের প্রযুক্তির উন্নতির সাথে একই ছন্দে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর আগামী বছরটি আমাদের জন্য বয়ে নিয়ে আসতে যাচ্ছে গৌরব। প্রযুক্তির এ জোয়ারে গা ভাসিয়ে শুধু প্রযুক্তির দিক দিয়েই নয়, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে দেশের আর্থিক ব্যবস্থাও এগিয়ে যাবে একধাপ।