বাবার হত্যাকারীদের বিচার এই বছরই দেখতে চাই। আমার মতো যেন আর কাউকে বাবা হারাতে না হয়। বাবা না থাকার কষ্ট যে কেমন লাগে তা আমরা ৫ ভাই-বোন ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। মায়ের মুখের দিকে তাকানো যায় না। সারাক্ষণ কি যেন চিন্তা করে। হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে মা চিন্তিত। আমি সবার বড়। অনেক ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করে একদিন অনেক বড় হব। সংসারের জন্য চাকরি করে আয় করব। কিন্তু বাবাকে মেরে ফেলার মধ্য দিয়ে আমাদের স্বপ্নকেও তারা মেরে ফেলেছে। জানি না আর কতদিন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারব। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে খানিকটা চুপ করে থাকে ইসমাইল হাসান রনি। সে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডারের ঘটনায় নিহত আইনজীবীর গাড়িচালক ইব্রাহিমের ছেলে। সোনারগাঁয়ের বারদী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ছে। সোমবার বিকালে রনির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এ সময় রনি স্থানীয় মাঠে বল খেলছিল। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে খেলা ছেড়ে কথা বলে সে। রনি আরও বলে, বাবাকে ছাড়া দুটি ঈদ আমাদের কাছে কোন ঈদই মনে হয়নি। গতবার কোরবানি দিয়েছিলাম। বাবার সঙ্গে হাটে গিয়ে গুরু কিনেছি। এবার কোরবানি দিই নাই। রজানের ঈদের জামা-কাপড় দিয়েই এবার ঈদ করেছি। ওই জামা-কাপড় গত ঈদে মামারা দিয়েছিল। কিন্তু বাবা যার (নিহত চন্দন সরকার) চাকরি করতো সেখান থেকে কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। বাবা মারা যাওয়ার পর মন্ত্রী (কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী) এসেছিলেন। আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন আমাদের পাশে থাকবেন। বাবার হত্যার বিচার করবেন। কিন্তু এখনও তো বিচার শুরু হয় নাই? রনি বলেন, আমাদের একটা ভটভটি ছিল। বাবার মৃত্যুর পর সেটা বিক্রি করে দিয়েছি আর্থিক সংকটের কারণে। ৫ ভাই বোনের মধ্যে আমি আর আমার এক ছোট বোন লেখাপড়া করি। বাকিরা ছোট। আমি ৭ম শ্রেণী আর সীমা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। হয়তো একদিন লেখাপড়া বন্ধ করে আমাকে উপার্জনের জন্য নামতে হবে। জীবিত থাকা অবস্থায় ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চান আবুল খায়ের। সেভেন মার্ডারের ঘটনায় নিহত তাজুল ইসলামের বাবা তিনি। সেভেন মার্ডারের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি রীতিমতো শঙ্কিত। অনেকটা আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ৬ মাস হয়ে গেল অথচ নূর হোসেনকে এখনও ফিরিয়ে আনা হয়নি। তাছাড়া পুলিশ, র্যাব ও নূর হোসেন ইস্যুতেই সময় পার করছে। কিন্তু এজাহারভুক্ত বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার করছে না। আসামিদের স্বজনরা এলাকায় এসে কোরবানি দিয়ে চলে গেছে। আর আমরা চোখের পানি ফেলছি। আমার সন্তানসহ ৭ জনকে যারা হত্যা করেছে তাদের উপযুক্ত বিচার হলেই সন্ত্রাস কমে যাবে। অপরাধীরা ভয় পাবে। এক প্রশ্নের জবাবে আবুল খায়ের কষ্টের হাসি দিয়ে বলেন, সন্তান হারিয়ে আমি মানসিক ও আর্থিক সব দিক দিয়ে বিপর্যস্ত। গত ৬ মাসে কেউ সহায়তার আশ্বাস দেয়নি। হয়তো দিবেও না। কিন্তু তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। অন্তত ছেলে হত্যার বিচারটা দ্রুত শুরু হলেই স্বস্তি পাবো। নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বলেন, যেভাবে মামলা ও তদন্ত চলছে তাতে আমরা হতাশ। মামলার বাদী হিসেবে নয় দেশের মানুষও এতে হতাশ। সবার প্রত্যাশা দ্রুত তদন্ত শেষ করে যেন বিচার করা হয়। নিহত সিরাজুল ইসলাম লিটনের বড় ভাই রফিকুল ইসলাম জানান, গত ৬ মাসে আমরা শুধু সান্ত্বনা পেয়েছি। কৃষিমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ডেকে নিয়ে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে। এটাই আমাদের পুঁজি। তিনি অনেকটা কষ্ট নিয়ে বলেন, হত্যাকা-ের শিকার সাতজনের মধ্যে দু’জন গাড়িচালকের পরিবারের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। দয়া করে তাদের নিয়ে কিছু লিখেন। আমাদের ভাগ্য আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছি। এক পর্যায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রফিকুল বলেন, আমি শতভাগ হতাশ এই বিচার নিয়ে। আদৌ ভাই হত্যার বিচার দেখে যেতে পারব কি না জানি না। কারণ, নুর হোসেনকে ধরার জন্য ইন্টারপোলে রেড এলাট জারি করা হলো। তাকে ধরাও হলো। অথচ দেশে ফিরিয়ে আনতে পারছে না সরকার। তাহলে কি নূর হোসেন সরকারের চেয়ে বড়? তাছাড়া র্যাব তো শিকার করেছে তারা কিভাবে সাতজনকে অপহরণ ও হত্যার পর লাশ গুম করেছে। তাহলে নূর হোসেনের জন্য এত অপেক্ষা কেন? নূর হোসেনের কথায় যদি সাতজনকে মারা হয় তাহলে নূর হোসেন হুকমের আসামি হবে। কিন্তু সামান্য একজন সন্ত্রাসী নূর হোসেনের কথায় সরকারের পদস্থ র্যাব কর্মকর্তারা টাকার জন্য সাতজন মানুষকে মেরে ফেললো? তাদের এত টাকার প্রয়োজন? তারা টাকার জন্য একের পর এক অপকর্ম করে আসছিল। কিন্তু তাদের পাপ সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ৭ খুনের ঘটনায় ধরা খেয়েছে। এখন হতাশার মাঝেও আশাবাদী বিচারটা শেষ পর্যন্ত পাবো তো? নিহত নজরুল ইসলামের ছোট আব্দুস সালাম কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, নূর হোসেনকেই এখনও দেশে ফিরিয়ে আনা হলো না। গ্রেপ্তার করা হয়নি এজারহারভুক্ত আসামিদের। তাহলে কিভাবে বুঝবো দ্রুত বিচার শুরু হবে। অথচ ডিসি-এসপি বলেছিলেন দ্রুত নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু ৬ মাস পেরিয়ে গেছে। আমরা এজাহারভুক্ত বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার দাবি জানচ্ছি সংশ্লিষ্টদের কাছে। ওদিকে সাত খুনের বিচারের ব্যাপারে নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি কিছুটা হতাশার সুরে জানান, হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আগে তদন্ত কর্মকর্তারা বলতেন, শিগগিরই নিয়ে আসা হবে। এখন বলছেন, আনার চেষ্টা হচ্ছে। তাকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত বিচার হবে না বলে মনে করছি। অন্যান্য পরিবার সম্পর্কে সেলিনা ইসলাম বলেন, সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের পরিবার। জাহাঙ্গীর মারা যাওয়ার পর ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তান নিয়ে তার স্ত্রী নিরুপায়। শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি চলে গেছেন। একইভাবে বিপদাপন্ন মনিরুল ইসলাম স্বপনের পরিবারও। এখন পর্যন্ত সরকার বা কোন সংগঠন তাদের কোন সহায়তা করেনি। এদিকে চন্দন সরকারের পরিবারের বিষয়টি নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা নিজেদের বিষয় হিসেবে নিয়েছেন। এদিকে সাত খুনের ঘটনার ৬ মাস অতিবাহিত হয়েছে সোমবার। এ পর্যন্ত ১১ জন র্যাব সদস্যসহ ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ১০ জন র্যাব সদস্যসহ ১২ জন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সর্বশেষ র্যাব সদস্য রুহুল আমিনকে তৃতীয় দফায় ৮ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঈদুল আজহার পরদিন পটুয়াখালী থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ওই ঘটনার সময় নৌকায় উপস্থিত ছিলেন। আর অপহরণ ও খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন ৯ জন র্যাব সদস্যসহ মোট ১৪ জন। উল্লেখ্য, গত ২৭শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহৃত হন। পরে ৩০শে এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬ জনের ও ১লা মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।