একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কবে কার্যকর করা হবে তা নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি আইনি সিদ্ধান্তের সাথে সর্ম্পকিত বলে আইনমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং কামারুজ্জামানের আইনজীবীর নানামুখি বক্তব্যে এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
গত বছরের ৯ মে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে পরে তিনি সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেন। সুপ্রিমকোর্ট তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন গত ৩ নভেম্বর। ৪ নভেম্বর এ আসামিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এরপর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে শুরু হয় নানা গুঞ্জন।
৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গুলশানে তার বাসভবনে সাংবাদিকদের বলেন, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রস্তুতি নিতে কারা কর্তৃ?পক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কামারুজ্জামানকে আপিল বিভাগের রায় জানানো হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সেদিন আনিসুল হক বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে কিনা, সে প্রশ্ন আমি আইজি প্রিজন সাহেবকে করি নাই, কিন্তু আমি যতটুকু জানি তাকে (কামারুজ্জামান) জানানো হয়েছে, আপিল বিভাগে খারিজ হয়েছে এবং তার মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে।
তিনি আরও জানান, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার জন্য ৭ দিন সময় পাবেন। যে মুহূর্ত থেকে তিনি ফাঁসির খবর জেনেছেন সে মুহূর্ত থেকে ওই সাত দিন গণনা শুরু হয়েছে। কামারুজ্জামানের প্রাণভিক্ষার সময় রোববার শেষ হচ্ছে, এখন কী হবে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শনিবার দুপুরে মন্ত্রী বলেন, “প্রকাশিত যে রায় আছে তার ওপরই আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। কারাবিধির ৯৯১ ধারাটি দেখেন, যখন আসামির মৃত্যুদণ্ড হয় তখন লেখা ছিল হাইকোর্ট এখন আপিল বিভাগ। তাকে এটা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সাত দিন সময় দিতে হয়। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তাকে মার্সি চাওয়ার জন্য সেই সময় দেয়া হয়েছে।”
রায়ের পর গত বৃহস্পতিবার নিজ কার্যলয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের অনুলিপি প্রকাশের পর এটা সরকার যেদিন ঠিক করবে, সেদিন দণ্ড কার্যকর হবে। আর সংক্ষিপ্ত আদেশ নাকি পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাঠানো হবে সেটা আপিল বিভাগের বিষয়। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি দিয়েই তার সাজা কার্যকর করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন। আপিল আদালত যে রায় দেন, সেটা ট্রায়াল কোর্টে (ট্রাইব্যুনালে) যায়। ট্রায়াল কোর্ট সে অনুসারে সিদ্ধান্ত নেন, মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন।
মাহবুবে আলম এর মতে, সংবিধানের ৪৭(ক) ধারা অনুযায়ী এ মামলায় রিভিউ চলবে না।
এদিকে রায় ঘোষণার দিনেই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের প্রধান গোলাম আরিফ টিপু সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন। এরপর সরকারের আদেশে তা কার্যকর করা হবে।
অন্যদিকে কামারুজ্জামানের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী জেল কোডের ‘অপব্যাখ্যা’ করেছেন বলে দাবি আসামিপক্ষের আইনজীবীর। গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন আইনজীবী মুহম্মাদ শিশির মনির। এ সময় অ্যাডভোকেট মো. নজরুল ইসলাম, সাইফুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আপিল বিভাগ থেকে এখনও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়নি। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রী যে সময়সীমার কথা উল্লেখ করেছেন, তা বিভ্রান্তিকর।
তার মতে, আইনমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের একজন ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ হয়েও জেল কোডের ৯৯১ ধারার অপব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, কামারুজ্জামান রায়ের সার্টিফায়েড কপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ আবেদন করবেন। এ আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়প্রাপ্তির ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হলে কিছুটা সময় লাগতে পারে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাদের মতে, সংক্ষিপ্ত রায়ের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে নাও হতে পারে।একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ বহাল রাখেন।
দেশের সর্বস্তরে জেএসসি পরীক্ষা চলছে এবং আগামী ২৩ নভেম্বর থেকে পিএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। এক্ষেত্রে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়া এবং তার পরবর্তী জামায়াতের কর্মসূচি নিয়ে চিন্তা করে বিষয়টি নিয়ে সমাজের নানা মহল চিন্তিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।