ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রশাসনকে এড়িয়ে শিক্ষার্থী তোলা, হল থেকে ইচ্ছেমতো শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ হলে তা দমনের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
ছাত্রলীগের সূত্রগুলো বলছে, চলতি বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ১২টি হলে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া মোট ছাত্রের প্রায় ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে হলে উঠিয়েছে ছাত্রলীগ। প্রশাসনিকভাবে সাধারণত প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থীদের হলে সিট দেওয়া হয় না। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত মে পর্যন্ত এক বছরে অন্তত ৯৪ জনকে বিভিন্ন অজুহাতে হল থেকে বের করে দিয়েছে ছাত্রলীগ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের নেতাদের অভিযোগ, হল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ব্যবহার করে ছাত্রলীগ কার্যত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপরই নানামুখী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। গত দুই সপ্তাহে তিনটি ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় ছাত্রলীগের সহায়তা নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নাম আসায় গত এক বছরে শাহবাগ থানায় ২১টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। তবে পুলিশ এই জিডিগুলোর তদন্ত করেনি।
গত দুই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা অন্য কোনো অভিযোগে ছাত্রলীগ যাদের দোষী বলে গণ্য করছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসন নিজেরা তদন্ত পর্যন্ত করছে না। এমনকি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কারা কী ধরনের কর্মসূচি পালন করতে পারবে, সে ব্যাপারেও ছাত্রলীগ প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপ করছে।
অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে প্রশাসন কখনো কঠোর আবার কখনো নমনীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনার জন্য কর্তৃপক্ষের ছাত্রলীগের কোনো প্রয়োজন নেই।
তবে বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। ৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক পদমর্যাদার দুজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনোভাবেই আন্দোলনকারীদের সরাতে পারছিল না। পুলিশকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে—এই আশঙ্কায় তারাও উদ্যোগী হচ্ছিল না। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চাওয়া অনুযায়ী ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিয়েছে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি দারুস সালামের নেতৃত্বে ওই দিন তাঁদের ওপর হামলা হয়। এঁদের অভিযোগ, সেদিন দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারাও শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের ভয় দেখান।
এত অভিযোগের পরও এ হামলার ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো তদন্ত করেনি, ব্যবস্থা নেয়নি।
অবশ্য ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর এম আমজাদ আলী গত সোমবার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, এটি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরাই ঘটিয়েছে। এর সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত ছিল না।
আর গতকাল উপাচার্যও দাবি করেছেন, ওখানে ছাত্রলীগের কেউ ছিল বলে তাঁর জানা নেই। ছাত্রলীগও এ ধরনের কোনো দাবি করেনি।
৫ নভেম্বর বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ হলের পুকুরঘাটে বসায় আলোকচিত্রী ইমতিয়াজ আলম বেগকে মেরে রক্তাক্ত করেন ছাত্রলীগের কর্মীরা।
গণমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ঘটনার এক দিন পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। তবে হামলাকারী শনাক্ত করতে প্রশাসন ছাত্রলীগের দ্বারস্থ হয়। এরপর শহীদুল্লাহ্ হলের ছাত্রলীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সংগঠনের চার কর্মীর নামের একটি তালিকা দেন প্রক্টরের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গত সোমবার ওই চারজনকে বহিষ্কার করে।
তবে এ চারজনের মধ্যে দুজনের পুরো নাম পাওয়া যায়নি। মাসুম নামে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজনকে বহিষ্কার করা হলেও ওই বিভাগে প্রথম বর্ষে এ নামে কারও খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিভাগের প্রথম বর্ষের কয়েকজন ছাত্রও জানিয়েছেন, এ নামে তাঁরা কাউকে চেনেন না।
গত ২০ অক্টোবর শিবিরের কর্মী সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এফ রহমান হল থেকে আট শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পুলিশ সাতজনকে ছেড়ে দেয়। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, আটককৃতদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টরও বলেছেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর কাছে আটককৃতদের ব্যাপারে তথ্যপ্রমাণ হাজির করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। তাঁরা তা দেননি, পুলিশও কিছু খুঁজে পায়নি।
হলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এঁরা সবাই ওই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তাঁদের সিটে এখন ছাত্রলীগ তাদের কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করেছে।
সর্বশেষ গত সোমবার শহীদুল্লাহ্ হলে আলোকচিত্রীর ওপর হামলার প্রতিবাদে ব্রতী নামে একটি সংগঠনের প্রতিবাদ কর্মসূচিতেও বাধা দেওয়া হয়। যদিও কর্মসূচি পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের অনুমতি দিয়েছিল। ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু অভিযোগ আছে, সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে সেখানে পাল্টা কর্মসূচি পালন করে ছাত্রলীগ। তারা শহীদ মিনারের চত্বরে জুতা উঁচিয়ে মিছিল করে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পর্যায়ের কয়েকজন নেতাকেও দেখা গেছে। অথচ আলোকচিত্রীর ওপর হামলার ওই ঘটনায় ছাত্রলীগই তাদের সংগঠনের চারজনকে চিহ্নিত করেছিল।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে সহায়তা করে। তাঁর মতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসক কখনো কোনো ধরনের সহযোগিতা চাইলে ছাত্রলীগ সেই সহযোগিতা দিয়ে থাকে। তা ছাড়া তাঁদের সংগঠনের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো খারাপ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শাস্তির বিষয়ে ছাত্রলীগ বাধা সৃষ্টি করে না।