রাজধানীতে গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনা এখন একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু টাকা দিলে ফিরে পাওয়া যাচ্ছে খোয়া যাওয়া গাড়ি। রাজধানীর গোপীবাগে রবিউল ইসলামের দুই বছর সময়ের মধ্যে দুটি গাড়ি চুরি হয়। দুইবারে মোট এক লাখ ৩২ হাজার টাকা চোর-ছিনতাইকারীচক্রকে ‘মুক্তিপণ’ হিসেবে দিয়ে গাড়ি ফেরত আনতে হয়েছে তাঁকে। এ রকম অহরহ ঘটনা রাজধানীতে এখন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীতে গাড়ি চুরি ও ছিনতাইয়ের ৩৩২টি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এগুলোর সদস্যরা ঢাকার বাইরেও তৎপরতা চালায়। তবে ৩০টি চক্র সবচেয়ে বেশি সক্রিয়, কার্যত এরাই নিয়ন্ত্রণ করে এ জগৎ।
রবিউল জানান, গত ১৭ অক্টোবর ধানমণ্ডি এলাকা থেকে তাঁর অটোরিকশার চালক জামান হোসেন বলধা গার্ডেনে যাওয়ার জন্য যাত্রী তোলেন। পথে যাত্রীর অনুরোধে চা পান করে অজ্ঞান হয়ে পড়েন চালক। টঙ্গীতে নিয়ে তাঁকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গাড়ি নিয়ে যায় চোরেরা। ওই দিন রাতেই তাঁর (রবিউল) মোবাইলে ফোন করে চোরের সর্দার। জানায়, ‘চালককে টঙ্গীতে ফালাইয়া আইছি। ঝামেলা কইরেন না। ৯০ হাজার ট্যাকা দেন। গাড়ি পাইয়া যাইবেন।’ রবিউল বলেন, এরপর চলে দরকষাকষি। ১৮ অক্টোবর সমঝোতা হয় ৬২ হাজার টাকায়। চোরের নির্দেশনা অনুযায়ী ওই দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে টিকাটুলীতে এক ব্যক্তির হাতে টাকা বুঝিয়ে দেন তিনি। রাত সাড়ে ৯টায় আবদুল্লাহপুরে একটি পেট্রল পাম্পের সামনে নিজের গাড়িটি পড়ে থাকতে দেখেন রবিউল।
গুলশান এলাকায় থাকেন সিএনজি অটোরিকশাচালক নিজাম উদ্দিন। তিনি জানান, গত বছরের ২৫ জানুয়ারি বিশেষ কৌশলে ছিনতাই করা হয় তাঁর আটোরিকশাটি। গুলশান-১ নম্বর সেকশন থেকে দুই যাত্রী ওঠে তাঁর অটোতে। ৬ নম্বর সড়কে আরো দুই যাত্রী উঠবে বলে জানায় তারা। সেখানে পৌঁছার পর দেখেন লাগেজ নিয়ে দুইজন দাঁড়িয়ে। তারা লাগেজ ওঠানোর জন্য নামতে বলে তাঁকে। তিনি চালকের আসন থেকে নামামাত্র তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে অটো নিয়ে পালিয়ে যায় চক্রটি। ঘটনার পরই গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন নিজাম। থানা থেকে বের হতেই তাঁর মোবাইল ফোনে কল আসে। তাঁকে বলা হয়, ৭০ হাজার টাকা দিলে সিএনজিটি ফেরত দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘টাকা নিয়ে দরকষাকষি চলে সপ্তাহজুড়ে। পরে পুলিশকে বিষয়টি জানাই। এতে বিপত্তি ঘটে। চক্রের সদস্যরা মোবাইল ফোন বন্ধ কইরা দেয়। পুলিশকে জানাইয়া ঝামেলা করছি বইলা গাড়িটা আর পাই নাই।’
খোজ নিয়ে জানা গেছে এমন কয়েক শ ঘটনার কথা। রাজধানীতেই গাড়ি চুরি বা ছিনতাই করছে এবং ‘মুক্তিপণ’ আদায় করছে ৩৩২টি চক্র। ঢাকার বাইরেও সক্রিয় আছে তাদের সহযোগীরা। পুলিশ-র্যাবের কাছে তাদের প্রোফাইল আছে। প্রতিবছর শত শত গাড়ি চুরি, ছিনতাই করছে ওরা। ঝামেলা এড়াতে টাকা দিয়েই গাড়ি নিয়ে আসছেন মালিকরা। ঝক্কি-হয়রানির আশঙ্কায় পুলিশের দ্বারস্ত হতে চান না তাঁরা; গণমাধ্যমকেও কিছু জানান না।
সূত্রে জানা যায়, ‘মুক্তিপণ’ মিললে গোপনে গাড়ি ফেরত দিয়ে দিচ্ছে চোর-ছিনতাইকারীরা। আর টাকা না পেলে গাড়ির বহিরাঙ্গ ও রং বদলে বেচে দেওয়া হচ্ছে। কখনো ধোলাইখালে খুচরা যন্ত্রাংশ হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। অনেক গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার বাইরে। আবার চোর-ছিনতাইকারীচক্রই হয়তো গাড়িটি ব্যবহার করছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে সিএনজি অটোরিকশা চুরি করে ‘মুক্তিপণ’ আদায় চলছে। ইদানীং প্রাইভেট কারও চুরি, ছিনতাই করে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা আদায় করা হচ্ছে। অনেকে টাকা দিয়েও গাড়ি ফেরত পাননি। পুলিশে জানালে তারা সারাক্ষণ ঝামেলা করে। পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, গাড়ি চুরি, ছিনতাই করে টাকা আদায়ের অনেক অভিযোগ আছে তাঁদের কাছে। তদন্তে কয়েকটি চক্রকে শনাক্ত করে সদস্যদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। কিন্তু জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার অপকর্ম করছে। এখনো তিন শতাধিক চোর-ছিনতাইকারীচক্র সক্রিয় রয়েছে।
এ ব্যাপারে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ‘ছিনতাইকারীচক্র গাড়ির মালিকের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। এসব ক্ষেত্রে গাড়ির মালিক গাড়ি উদ্ধারের পর বিষয়টি থানা পুলিশকে জানান না। রাজধানীতে বেশির ভাগ সিএনজি অটোরিকশাই কোনো না কোনোভাবে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে। আমরা চক্রগুলোকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।’
জানা যায়,টঙ্গী এলাকার মজিবুর ওরফে বড় মজিবুর একটি চোরচক্রের সর্দার। সে টঙ্গী, আবদুল্লাহপুর, উত্তরখান ও দক্ষিণখান এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। তার দলের সদস্যরা রাতে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে। নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার আগে তাদের সিন্ডিকেটের ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ড্রাইভারকে নিয়ে চা পান করে। চা খেয়ে চালক অচেতন হয়ে পড়লে তারা গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়।
মজিবুর বলেন, তার ৩০টি সিএনজি অটোরিকশা ঢাকার রাস্তায় চলাচল করে। পুলিশকে নিয়মিত টাকা দিতে হচ্ছে। তার গ্রুপের সদস্যরা সিএনজি চুরি করে। ঢাকার বাইরে থেকেও চুরি করা হয়। ‘মুক্তিপণ’ ছাড়া কোনো সিএনজি ছাড়া হয় না।
নারায়ণগঞ্জের পোস্তগোলার মন্টু শাহবাগ, চানখাঁরপুল, বাংলামোটর, কাঁটাবন ও নীলক্ষেত এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা ছিনতাই করে। যাত্রাবাড়ী এলাকার দুই চক্রের নেতা তরিকুল ও শামীম। কেরানীগঞ্জের খোলমুড়া এলাকার লিটনের গ্রুপ কেরানীগঞ্জ থেকে বাবুবাজার হয়ে পুরান ঢাকার কিছু এলাকায় ছিনতাইয়ে সক্রিয়। বরিশাইল্যা মজিবর গ্রুপ মতিঝিল, শাজাহানপুর, খিলগাঁও, সবুজবাগ, বাসাবো এলাকায় সিএনজি ছিনতাই করে। দক্ষিণখানের কানা শহিদ নিয়ন্ত্রণ করছে গুলশান, বারিধারা, বাড্ডা ও রামপুরা এলাকা।
গত ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা থেকে অজ্ঞান পার্টির আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তারা চালককে অজ্ঞান করে অটোরিকশা ও পিকআপ ছিনতাই করত। এই চক্রের নেতা আনোয়ার, সেলিম ও বুলু। সেলিম ও বুলুকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গ্র্রেপ্তারকৃতদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এ ব্যাপারে ডিবির (পশ্চিম) সহকারী কমিশনার মাহমুদ নাসের জনি বলেন, ‘চক্রটি গাড়ি ছিনতাইয়ের পর মালিকদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করেছে। চক্রটির বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিটি গ্রুপে একজন সিএনজি চালক থাকে। এই গ্রুপে জাহিদ শেখ নামে একজন সিএনজিচালক ছিল।’ তিনি জানান, অটোরিকশা ও গাড়ি ফেরত দিয়ে টাকা আদায়ের অনেক অভিযোগ আছে ডিবির কাছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গাড়ি চুরি করে বিক্রি করে এমন ৩৩২টি গ্রুপকে শনাক্ত করা হয়েছে। চোর সর্দারদের মধ্যে জামান, আক্কাছ মোল্লা, রিপন, হাবিল, হাফেজ বাবুল, বাশার, রাসেল, মিজান, আমির, শাহিন, বিশাল, আসাদুল, জুয়েল, বড় মজিবুর, নজরুল, মিরাজ, খোকন, কাজল, বাবু, রনি, লম্বু শহীদ, কানা শহীদ, পারভেজ, রাজ, শাহ আলম, জহির, রাজু, সিরাজ, ফিরোজ, রফিক উল্লেখযোগ্য। সংঘবদ্ধ এসব চক্রের সদস্য বারবার গ্রেপ্তার হচ্ছে। কিন্তু কিছুদিন কারাগারে থেকে জামিন পেয়ে আবারও গাড়ি ছিনতাইয়ে লিপ্ত হচ্ছে।