সরকারি পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনে (বিআরটিসি) যাত্রী হয়রানি আর ভাড়া নৈরাজ্যে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। আদায় করা হচ্ছে গলাকাটা ভাড়া। সীমাহীন অনিয়মের কারণে যাত্রীদের দেয়া ভাড়ার বড় অংশই জমা হচ্ছে না সরকারের কোষাগারে। গলাকাটা ভাড়া আদায় নিয়ে প্রতিনিয়ত বাসের হেলপার, কন্ডাক্টরদের সঙ্গে যাত্রীদের বাদানুবাদ হচ্ছে। নিয়মানুযায়ী সরকার নির্ধারিত কিলোমিটারে ভাড়া আদায়ের নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ রুটেই তা মানা হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিআরটিসির অধিকাংশ বাস ইজারায় চলার কারণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে প্রতিটি রুটের যাত্রীদের কাছ থেকে। ফলে মহাজোট সরকার সময়ে বিআরটিসির জন্য সাড়ে ৯০০ বাস কেনা হলেও কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না যাত্রীরা। বেশি অভিযোগ রয়েছে বিআরটিসির সিটি সার্ভিস নিয়ে। অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে রাজধানীতে বিআরটিসির যাত্রীসেবা প্রায় হারাতে বসেছে। এসব বাসে যাতায়াত করা যাত্রীদের অসংখ্য অভিযোগ থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা যাত্রীভাড়া চলে যাচ্ছে বিআরটিসির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার পকেটে। বিআরটিসি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে রাজধানীর মতিঝিল, কল্যাণপুর, মিরপুর (দ্বিতল বাস), জোয়ার সাহারা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও উথলী (গাবতলী) বাস ডিপো থেকে বিআরটিসির বাস চলাচল করছে। মতিঝিল থেকে ৩৯ রুটে ১৪৭টি বাস প্রতিদিন চলাচল করছে। কল্যাণপুর থেকে ৬৮টি রুটে ২২০টি, মিরপুর ডিপো থেকে ৬০টি রুটে ১৮৮টি বাস, জোয়ার সাহারা থেকে ৪৮টি রুটে ১৬৩টি বাস, গাজীপুর থেকে তিনটি রুটে ৬৯টি, নারায়ণগঞ্জ থেকে আটটি রুটে ৮৫টি বাস এবং গাবতলী-আবদুল্লাহপুরসহ মোট ছয়টি রুটে ৪৮টি বাস চলাচল করছে আর এসব রুটের প্রতিটি বাসেই আদায় করা হচ্ছে নিয়মবহির্ভূত ভাড়া। যার পুরোটাই চলে যাচ্ছে চালক, হেল্পার ও কন্ডাক্টরদের পকেটে।
রাজধানীর শাহবাগে বিআরটিসির একাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় ভাড়া নৈরাজ্যের কথা। ক্যান্টনমেন্ট বালুঘাট এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান স্বপন শাহবাগে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালান। ব্যবসার কাজে নিয়মিত তাকে বালুঘাট থেকে শাহবাগে আসতে হয়। তিনি জানান, বালুঘাট রুটে নির্দিষ্ট দু’একটি বাস চলাচল করায় তিনি নিয়মিত বিআরটিসি বাস সার্ভিসেই চলাচল করেন। তিনি বলেন, কোম্পানির বাসে ভাড়া ও নানা রকম যাত্রী হয়রানির কারণে সরকারি বাসে চড়ি। কিন্তু এখানেও একই সমস্যা। এমন কোনো দিন নেই যে দিন বাসের চালক, হেলপার কন্ডাক্টরের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের বচসা হয় না। তিনি এ সময় উদাহরণ দিয়ে বলেন, মতিঝিল থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা নেয়া হচ্ছে; কিন্তু এর জন্য কোনো টিকিট দিচ্ছে না অথচ একই রুটে বেসরকারিভাবে চলাচলকারী নিউ ভিশন গাড়ি ১০ টাকা ভাড়া নিলেও তারা একই গন্তব্যে যেতে কোথাও দাঁড়াচ্ছে না; কিন্তু বিআরটিসির বাসে সব আসন পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত চালক বাস ছাড়তে চান না, যার কারণে বাসযাত্রীরা প্রতিবাদ করেন সবসময়।
এভাবে প্রতিদিন যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তার কথা, মতিঝিল থেকে ক্যান্টনমেন্ট বালুঘাট পর্যন্ত যেতে নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়াও যেখানে সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর ভেতরে বর্তমানে বিআরটিসির এসি বাস উত্তরা থেকে ফার্মগেট, শাহবাগ হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত এই একটি রুটে চলছে। এই রুটে নন-এসি সিঙ্গেল ডেকার এবং ডাবল ডেকারও চলছে।
গত ৭ নভেম্বর এই রুটের একটি বাসে ভ্রমণ করে দেখা যায়, এসি বাসে মাত্র ৩৫ ও ৫০ টাকা মূল্যের টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে যেসব যাত্রী মতিঝিল, গুলিস্তান কিংবা শাহবাগ থেকে উঠবেন তাদের মহাখালী পর্যন্ত যেতে ৩৫ টাকা ভাড়া দিতে হয়। অন্যদিকে যারা উত্তরা, খিলক্ষেত, জোয়ার সাহারা কিংবা বনানী থেকে উঠছেন তাদের ফার্মগেট পর্যন্ত ৩৫ টাকা এবং মতিঝিল পর্যন্ত ৫০ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে অথচ খিলক্ষেত থেকে ফার্মগেটে নন-এসি বাসের ভাড়া ১০ টাকা সেখানে এসি বাসে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৩৫ টাকা আর ফার্মগেট পার হয়ে শাহবাগ বা প্রেসক্লাব নামলেই ভাড়া ৫০ টাকা দিতে হচ্ছে অথচ একই দূরত্বে নন-এসি বাসে ফার্মগেট পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা, শাহবাগ পর্যন্ত ১৫ টাকা এবং মতিঝিল ২০ টাকা।
যাত্রীরা জানান, আসলে বিআরটিসির বাস ইজারা দেয়ার কারণেই তারা বেশি ভাড়া আদায় করছেন। তবে কোনো রুটেই বিআরটিসির বাসে কম যাত্রী থাকছে না। তাহলে বাসে বেশি ভাড়া আদায় কেন করা হচ্ছে এমন প্রশ্নও রয়েছে অনেকের কাছে। অনেক যাত্রী জানান, রাজধানীতে গণপরিবহনের সংকটের কারণে বিআরটিসি বাস তিনগুণেরও বেশি ভাড়া আদায় করছে। দূরত্বভেদে ভাড়ার হার নির্ণয় না করে ভাড়া নেয়া হচ্ছে বিআরটিসির বেঁধে দেয়া দুটি ভাড়ার হার অনুযায়ী।
অন্যদিকে বহু যাত্রী অভিযোগ করে জানান, বিভিন্ন সময় যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কোনো রশিদ প্রদান করেন না বিআরটিসির কন্ডাক্টররা। এক্ষেত্রে টিকিট ছাড়াই যাত্রীদের কাছ থেকে টিকিটের সমপরিমাণ ভাড়া আদায় করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে মতিঝিলে কর্মরত ব্যাংক কর্মকর্তা শামিমা মিতু বলেন, বিআরটিসির এসি বাসেও রাস্তা থেকে যাত্রী ওঠানোর জন্য প্রায়ই দরজা খোলা রাখা হয়। লোকাল বাসের মতো গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা হয়। দরজা খোলা রাখার একপর্যায়ে বাসটি নন-এসি হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে এসি বন্ধ করে দিয়েও চালক জানান, এসি কাজ করছে না কিংবা কম কাজ করছে।
বিআরটিসির নতুন আসা আর্টিকুলেটেড বাস নিয়েও রয়েছে যাত্রীদের নানা অভিযোগ। সরেজমিনে আর্টিকুলেটেড বাসে উত্তরা পর্যন্ত ভ্রমণ করে জানা যায়, এসব বাসে সরাসরি গাজীপুর, শিমুলতলী পর্যন্ত যাওয়ার জন্য যাত্রীদের বলা হয়। কিন্তু পথে পথে টিকিট ছাড়াও যাত্রী ওঠানো হচ্ছে।
শাহবাগে মতিঝিল-আবদুল্লাহপুর রুটের এসি বাসের চালক শাহিন বলেন, বাসভাড়া বেশি নেয়ার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা কন্ডাক্টর ও হেলপাররা ভালো বলতে পারবে।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে বিআরটিসির পরিচালক (অপারেশন) নিখিল রঞ্জন রায় বলেন, রাজধানীতে যে সংখ্যক যাত্রীদের বিআরটিসি বাসে সেবা দেয়া হচ্ছে তা অন্য কোনো বাস দিচ্ছে না। তিনি বলেন, রাজধানীর জনসংখ্যার তুলনায় বাসের সংখ্যা অনেক কম। এরপরও আমরা এই বাস দিয়েই যাত্রী সার্ভিস দিচ্ছি।
যাত্রীর ভোগান্তি কমানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোনো বাসের চালক বা হেলপার কন্ডাক্টররা যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য চিফ সিকিউরিটি অফিসারের নেতৃত্বে আলাদা টিম গঠন করে মনিটরিং টিম গঠন করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সেই টিম যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট দিচ্ছে আর তাদের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কোনো যাত্রী অতিরিক্ত বাসভাড়ার অভিযোগ করলেই কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ওই ডিপোর ম্যানেজারকে শোকজ করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সম্প্রতি মতিঝিল ডিপোর ম্যানেজারকে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগে তাৎক্ষণিক শোকজ করা হয়।