মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া পলাতক ১০ জঙ্গি এবং ৪১ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থাকে (এনআইএ) দিয়েছে বাংলাদেশ। এসব সন্ত্রাসী ভারতে অবস্থান করছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তর, একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের সঙ্গে এনআইএর পৃথক বৈঠকে এ তালিকা দেওয়া হয়।
এদিকে ভারতের বর্ধমানে বিস্ফোরণের ঘটনায় সন্দেহভাজন পলাতক ১১ জঙ্গির তালিকা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে র্যাব ও পুলিশ। গত সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে এ তালিকা দেয় এনআইএ।
বর্ধমান বিস্ফোরণের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহে এনআইএর চার সদস্যের একটি দল সোমবার ঢাকায় এসেছে। এনআইএর মহাপরিচালক শারদ কুমার এই দলের প্রধান। এনআইএর মহাপরিদর্শক সঞ্জীব কুমার সিং ও ডিআইজি অনুরাগ তানখা ছাড়াও সংস্থার আরও এক সদস্য তাঁদের সঙ্গে আছেন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ছয় সদস্যের একটি কমিটি করেছে বাংলাদেশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদ এর প্রধান।
ভারতের এই তদন্ত সংস্থার দলটির সদস্যরা সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। গতকাল সকালে তাঁরা একটি গোয়েন্দা সংস্থা, দুপুরে পুলিশ সদর দপ্তর ও সন্ধ্যায় র্যাবের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের দুজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। জঙ্গি দমনে দুই পক্ষ একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ২ অক্টোবর বর্ধমানের খাগড়াগড়ের একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় শাকিল আহমেদ ও সুবহান মণ্ডল নামের দুজন মারা যান ও একজন আহত হন। এনআইএ এই ঘটনার তদন্তে নেমে রাজিয়া বিবি ও আমেনা বিবি নামের দুই নারীকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৭ নভেম্বর আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে সুজানা নামের আরও এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হত্যার ছক কষেছিল জঙ্গিরা। ৮ নভেম্বর কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের কাছ থেকে সাজিদ নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে এনআইএ। জিজ্ঞাসাবাদে সাজিদ জানান, তাঁর আসল নাম শেখ রহমত উল্লাহ মাসুম। বাবার নাম সিদ্দিকুর রহমান। নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার ফরাজিকান্দায় বাড়ি। সুজানা হুন্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা টাকাপয়সা জঙ্গিদের কাছে পৌঁছে দিতেন। বর্ধমান বিস্ফোরণের মূল হোতা রহমত উল্লাহ পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই আজাদি থেকে অস্ত্র-বোমা তৈরির ব্যাপারে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
বৈঠকের আরেকটি সূত্র জানায়, রহমত উল্লাহর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য এনআইএকে জানানো হয়। এতে বলা হয়, মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা রহমত উল্লাহ ২০০০ সালে জেএমবিতে যোগ দেন। জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। ২০০৩ সালে তিনি বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী ফাতেমাও জঙ্গি। ২০০৪ সালে নারায়ণগঞ্জে ব্র্যার্যাক অফিসে ডাকাতির ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন। এই মামলায় তাঁর ১৭ বছরের সাজা হয়। সাত বছর সাজা খাটার পর ২০১১ সালে জামিনে বের হয়ে ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে জেএমবির আমির সোহেল মাহফুজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে এসে জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। ওই সময় র্যাবের হাতে ধরা পড়েন। এরপর তিনি জামিনে বের হয়ে আবার ভারতে চলে যান।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, রহমত উল্লাহর সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি সালাউদ্দিন ওরফে সালেহিন ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজানের যোগাযোগ ছিল। এই দুই জঙ্গি ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশকে গুলি করে প্রিজন ভ্যান থেকে পালিয়ে যান। এর পর থেকে তাঁদের কোনো খোঁজ নেই। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও আট জঙ্গির বিস্তারিত তথ্য এনআইএকে জানানো হয়। তাঁরা হলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জেএমবির সদস্য আবু সাঈদ শেখ, হুজির মাওলানা তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান ও মুফতি আবদুল হাই। পলাতক জঙ্গিরা হলেন তরিকুল ইসলাম, সোহেল মাহফুজ ও আনোয়ারুল ইসলাম শাখাওয়াত।
জানতে চাইলে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল হক সাংবাদিকদের বলেন, ভারত যে তালিকা দিয়েছে, তার মধ্যে চারজনের ব্যাপারে তথ্য আছে র্যাবের কাছে। এসব তথ্য তদন্ত সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে। অন্যদের ব্যাপারে খোঁজ করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, এনআইএর সদস্যরা দুপুরে পুলিশ সদর দপ্তরে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ত্রিশালে পুলিশ হত্যা করে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পলাতক জেএমবি সদস্য সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজান এবং ওই ঘটনার সন্দেহভাজন পরিকল্পনাকারী ফারুক হোসেনকে এনআইএ খুঁজছে। বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় সন্দেহভাজনদের যে তালিকা এনআইএ কর্মকর্তারা সোমবারের বৈঠকে দিয়েছেন, তাতে সানি, মিজান ও ফারুকের কথা রয়েছে। আর বাংলাদেশের তদন্ত সংস্থাগুলোও এদের খুঁজছে। পলাতক বোমারু মিজান ও সালেহীন এবং এ ঘটনার পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহভাজন ফারুক হোসেন ওরফে জামাই ফারুকের ক্ষেত্রে এনআইএর দেওয়া তথ্যের মিল রয়েছে।
ভারতের তালিকা: বৈঠকে ভারতীয় তদন্ত সংস্থার সদস্যরা জানান, বর্ধমানে বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত ১১ জনকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। বৈঠকে এই ১১ জঙ্গির তালিকা দেয় ভারত। ১১ জনের মধ্যে কাওসার ও তালহা শেখ নামের দুই ব্যক্তিকে বাংলাদেশি নাগরিক বলে দাবি করছে ভারত। তাঁদের ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
তালিকার অন্য জঙ্গিরা হলেন পশ্চিমবঙ্গের মাওলানা ইউসুফ শেখ, রেজাউল করিম, আমজাদ আলী শেখ, আবুল কালাম, বুরহান শেখ, হাবিবুর রহমান শেখ, জহিরুল শেখ, নসরুল্লাহ এবং আসামের বাসিন্দা শাহিনুর আলম। তাঁদের সবার জন্য তিন থেকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে ভারত।
৪১ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা: বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ৪১ সন্ত্রাসীর তালিকা দিয়ে বলা হয়, এঁরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতে অবস্থান করছেন। এঁদের ধরিয়ে দিতে তদন্ত সংস্থার সহায়তা চাওয়া হয়। এঁরা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ও কারাগারে রয়েছেন বলে র্যাবের কাছে তথ্য আছে। এঁরা হলেন মিরপুরের শাহাদাৎ হোসেন (বর্তমানে ভারতের মুর্শিদাবাদে), কুষ্টিয়ার আমিনুল ইসলাম ওরফে মুকুল ওরফে বিজয় (কারাগারে), কুষ্টিয়ার শাহীন ওরফে রুমি, নরোত্তম সাহা ওরফে আশিক ওরফে রবিন ওরফে আশিষ, নয়াটোলার জিসান (কলকাতায়), শাহীন শিকদার (আগরতলায়), খন্দকার তানভীর ইসলাম ওরফে ফার্মগেটের জয় (কলকাতায়), মোহাম্মদপুরের নবীন হোসেন ওরফে নবী, কুষ্টিয়ার আনোয়ার হোসেন আনু (ভারতের গোবিন্দপুরে), কুষ্টিয়ার কালু, যশোরের আনিসুর রহমান লিটন ওরফে ফিঙে লিটন (বনগাঁয়), রাজবাড়ীর পাংশার অমল কৃষ্ণ মণ্ডল (বনগাঁয়), তৌফিকুল আলম খান ওরফে তৌফিক আলম ওরফে পিয়াল খান (বনগাঁয়), চট্টগ্রামের মামুনুর রশীদ (ত্রিপুরায়), চট্টগ্রামের সুনীল কান্তি দে, নওগাঁর গৌতম চন্দ্র শীলাল ওরফে গৌতম চেয়ারম্যান, ঢাকার মিরপুরের প্রকাশ বিশ্বাস, বিকাশ বিশ্বাস, রমনার মোল্লা মাসুদ, পুরান ঢাকার আগা শামীম, নওগাঁর চপল, মহাখালীর মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে মুকুল, মিরপুরের বাবু, আগারগাঁওয়ের মিন্টু, তেজগাঁওয়ের আতাউর রহমান আতা, রাজবাড়ীর হালিম, শাহজাহানপুরের জাফর আহমেদ ওরফে মানিক, পল্লবীর কালা চান, মেহেরপুরের মিনহাজউদ্দীন দুখু, মেহেরপুরের এনামুল হক, মেহেরপুরের সিদ্দিক, চট্টগ্রামের এইচ এম আবু তৈয়ব, চট্টগ্রামের মোর্শেদ খান, চট্টগ্রামের নুরুল আলম ওরফে এতিম আলম, চট্টগ্রামের রাজীব দত্ত ওরফে রিংকু, চট্টগ্রামের সাজ্জাদ খান, কুমিল্লার শহীদুল ইসলাম ওরফে সুব ওরফে সব্বা, ভাষানটেকের ইব্রাহিম খলিল, রাজবাড়ীর ছামাদ মোল্যা ওরফে ছামাদ মেম্বার ওরফে আজিজ কমান্ডার এবং রাজধানীর ত্রিমতি সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী (বর্তমানে নেপাল)।
পশ্চিমবঙ্গে আটক: ভারতের এনআইএ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের বিস্ফোরণে জড়িত সন্দেহে মিয়ানমারের এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে। হায়দরাবাদ থেকে সোমবার খালিদ মোহাম্মদ (২৮) নামের ওই নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয় বলে গতকাল জি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রতিবেদনে এনআইএর বিবৃতির উল্লেখ করে বলা হয়, খালিদের কাছ থেকে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জিহাদি বইপত্র, ভিডিও, বোমা তৈরির বই পাওয়া গেছে। জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা মুসলিম সলিডারিটি গ্রুপের সঙ্গে খালিদের সম্পৃক্ততার সন্দেহ করছেন এনআইএর গোয়েন্দারা। তিনি মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগ গোয়েন্দাদের।