ইসলামে অসুস্থ্য কে দেখতে যাওয়ার নিয়ম ও ফজিলত
মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান , ডিভিএম , হাবিপ্রবি দিনাজপুর ।
মহান রব্বুল আলামিন মানুষকে অতি প্রিয় করে সৃস্টি করেছেন । আর শুধু সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেন নি । মানুষ কেমনে চলবে , কি অবস্থায় কি অচরন করবে , সে তার প্রতিবেশীর সাথে কেমন ব্যবহার করবে , অসুস্থ্য মানুষকে কিভাবে দেখবে এই সব কিছুই তিনি তার প্রেরিত মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর মাধ্যমে গোটা দুনিয়ার মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন ।মানুষের জীবন অনেক কিছুর সমষ্টি । এই জীবনে যেমন সুখ আছে , কখনো অবার দুঃখ , সুস্থ্যতা , মাঝে মাঝে অসুস্থ্যতা কিছুটা যায়গা করে নেয় । আর অসুস্থ্য হওয়া দোষের কিছু নয় । এটা হতে পারে গুনাহ মাফ হওয়ার অসিলা , কখনো আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ার মাধ্যম । যেমন মানুষের রোগ হয় তেমনি তার মুক্তির ও ব্যাবস্থা মহান আল্লাহ কারো মাধ্যমে করে থাকেন । এই অসুস্থ্যতা যেমন আল্লাহর প্রিয় হওয়ার উপায় ঠিক তেমনি অসুস্থ্য মানুষের কিছু অধিকার আছে সুস্থ্যদের উপর । আর সুস্থ্যরা তাঁদের এই হক আদায় করে শুধু দ্বায় মুক্ত হয়না , বরং সে অনেক সওয়াবেরও অধিকারি হয় । আল্লাহর অসুস্থ্য বান্দাকে সেবা করা আল্লাহকে সেবা করার এ শামিল তার প্রমান পায় আমরা নিচের এই হাদীসের মাধ্যমে ।
হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ কিয়ামতের দিন বলবেনঃ হে বনী আদম! আমি রোগাক্রান্ত হয়েছিলাম, তুমি আমাকে দেখতে যাওনি! বান্দাহ বলবেঃ হে আমার প্রভু! আমি কেমন করে আপনার রোগের খবর নিব। আপনি যে বিশ্ব-জাহানের প্রভু! তিনি বলবেনঃ তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দাহ রোগাক্রান্ত ছিল? তুমি কি তাকে দেখতে যাওনি? তুমি কি জাননি যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে, তাহলে তুমি আমাকে অবশ্যই তার নিকট পেতে? হে বনী আদম! আমি তোমার নিকট খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাওনি! বান্দাহ বলবেঃ হে আমার প্রভু! আমি কেমন করে আপনাকে খাওয়াব আপনি যে, সমগ্র বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রতিপালক? মহান আল্লাহ বলবেনঃ তুমি কি জাননি আমার অমুক বান্দাহ তোমার নিকট খাবার চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে খাওয়াওনি? তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে খাবার খাওয়াতে তাহলে আমার নিকট তা পেতে। হে বনী আদম! আমি তোমার নিকট পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। বান্দাহ বলবেঃ হে আমার প্রভু! আমি কেমন করে আপনাকে পানি পান করাব, আপনি যে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের প্রভু? মহান আল্লাহ বলবেনঃ আমার অমুক বান্দাহ তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তাকে পানি পান করাওনি! তুমি যদি তখন তাকে পানি পান করাতে তাহলে আজ আমার নিকট তুমি তা পেতে। (মুসলিম)। তাই আসুন আমরা যেনে নি , কিভাবে অসুস্থ্যদের সেবা করা যায় এবং আল্লাহর হুকুম মানা যায় ।
হযরত আবু মূসা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ “রোগীকে দেখতে যাও, অভুক্তকে আহার করাও এবং বন্দীদের মুক্ত কর।” (বুখারী
হযরত সাওবান (রা) নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, মুসলমান যখন তার রুগ্ন মুসলমান ভাইকে দেখতে যায়, সে ফিরে না আসা পর্যন্ত জান্নাতের ফল আহরণ করতে থাকে। জিজ্ঞেস করা হলোঃ হে আল্লাহর রাসূল! জান্নাতের খুরফা কি? জবাব দিলেনঃ তার ফলমূল আহরণ করা। (মুসলিম)
হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে একথা বলতে শুনেছিঃ এমন কোন মুসলমান নেই, যে সকাল বেলা কোন মুসলমান রোগীকে দেখতে যায় এবং সন্ধ্যে পর্যন্ত সত্তর হাজার ফিরিশতা তার জন্য দু’আ না করে, আর সন্ধ্যে বেলা কোন রোগীকে দেখতে যায় এবং সকাল পর্যন্ত তার জন্য সত্তর হাজার ফিরিশতা দু’আ না করে। তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান নির্ধারিত করে দেয়া হয়। (তিরমিযী)
হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একটি ইয়াহূদী ছেলে নবী করীম (সা)-এর খিদমত করতো। সে অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী করীম (সা) তাকে দেখতে গেলেন। তিনি তার মাথার কাছে বসে তাকে বললেনঃ তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। সে তার বাপের দিকে তাকালো। তার বাপ তার নিকটই ছিল। সে (তার বাপ) বললোঃ আবুল কাসেম (সা)-এর আনুগত্য কর। অতঃপর সে ছেলেটি ইসলাম গ্রহণ করলো। নবী করীম (সা) এ কথা বলতে বলতে সেখান থেকে বের হলেনঃ “সমস্ত প্রশংসা সে সত্তার যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন।” (বুখারী)
হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা)-এর নিকট যদি কোন ব্যক্তি কোন ব্যাপারে অভিযোগ করতো অথবা তার শরীরে কোন ফোঁড়া বা জখম হতো, তাহলে নবী করীম (সা) নিজের আঙ্গুল দিয়ে এমন করতেন। এ বর্ণনাকারী সুফিয়ান ইবন উয়াইনাহ নিজের শাহাদাত আঙ্গুল যমীনের ওপর রাখলেন তারপর তাকে উঠালেন এবং বললেন (এ দু’আ পড়লেন) “বিসমিল্লাহি তুরবাতু আরদ্বিনা বিরীকাতে বাদ্বিনা ইউশফা বিহী সাকীমুনা বিইযনি রাব্বিনা-আল্লাহর নামে শুরু করছি, আমাদের এ পৃথিবীর মাটি আমাদের কারো মুখ নিঃসৃত লালা মিশ্রিত, আমাদের রুগ্ন ব্যক্তি রোগমুক্তি লাভ করুক, আমাদের রবের নির্দেশে।” (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা) নিজের পরিবারের কোন রোগীকে দেখতে গেলে তার ওপর ডান হাত বুলাতেন এবং বলতেনঃ “আল্লাহুমা রাব্বান নাস, আযহিবিল বা’স্ ওয়া আশফি আনতাশ শাফী, লা-শিফাআ ইল্লা শিফাউকা শিফাআন লা-ইউগাদিরু সাকামা। হে আল্লাহ! হে মানুষের প্রভু! রোগ দূর করুন, আরোগ্য দান করুন, আপনিই আরোগ্য দানকারী, আপনার আরোগ্য ব্যতীত আর কোন আরোগ্য কার্যকর নয়, এমন আরোগ্য যা কোন রোগকে অবশিষ্ট রাখে না।” (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি সাবিত (র)-কে বলেনঃ তোমাকে কি আমি রাসূলুল্লাহ (সা) যে ঝাড়-ফুঁক করেছিলেন সে ঝাড়-ফুঁক করবো না? হযরত সাবিত (র) বলেনঃ অবশ্যই, করুন। আনাস (রা) বললেনঃ ‘আল্লাহুম্মা রাব্বান নাস, মুযহিবাল বা’স ইশফি আনতাশ শাফী, লা শাফিয়া ইল্লা আনতা শিফাআন লা-ইউগাদিরু সাকামা” –“হে আল্লাহ! মানুষের প্রভু! বিপদ দূরকারী আরোগ্য দান করুন। আপনিই আরোগ্য দানকারী, আপনি ব্যতীত আরোগ্য দানকারী আর কেউ নেই, এমন আরোগ্য যার পর আর কোন রোগ থাকে না।” (বুখারী)
হযরত আবু আবদুল্লাহ উসমান ইবনে আবুল আস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি নিজের শরীরে যে ব্যথা অনুভব করছিলেন সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট অভিযোগ করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে বললেনঃ তোমার শরীরের যে স্থানে ব্যথা অনুভব হচ্ছে সেখানে নিজের হাতটি রাখ এবং তিনবার ‘বিসমিল্লাহ’ পড়। তারপর সাতবার এ দু’আটি পড়, “আউযু বিইযযাতিল্লাহি ওয়া কুদরাতিহী মিন শাররি মা আজিদু ওয়া উহাযিরু” -আমি আল্লাহর মর্যাদা ও কুদরাতের মাধ্যমে আশ্রয় চাচ্ছি সেই জিনিসের অনিষ্ট থেকে যাকে আমি পাচ্ছি এবং যার আধিক্যকে আমি ভয় করছি।” (মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেনঃ যে ব্যক্তি এমন কোন রোগীকে দেখতে যায় যার মৃত্যু নিকটবর্তী নয় (বলে মনে হয়)। তারপর তার কাছে সাতবার এ বাক্যটি বলেঃ “আস আলুল্লাহাল আযীমা রাব্বাল আরশিল আযীম আঁই ইয়াশফিয়াকা-বিশাল আরশের প্রভু মহান আল্লাহর নিকট আমি প্রার্থনা করছি। তিনি তোমাকে আরোগ্য দান করুন।” তবে আল্লাহ তাকে সে রোগ থেকে আরোগ্য দান করবেন। (আবু দাউদ ও তিরমিযী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা) জনৈক ব্যক্তিকে তার অসুস্থাবস্থায় তাকে দেখতে গেলেন। আর তিনি যখনই কোন অসুস্থকে দেখতে যেতেন তখই বলতেনঃ “লা বা’সা তাহরুন ইনশাআল্লাহ”-কোন চিন্তা নেই, ইনশাআল্লাহ এ রোগ গুনাহ থেকে পবিত্র করবে। (বুখারী)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। জিবরাঈল (আ) নবী করীম (সা)-এর নিকট এসে বলেনঃ হে মুহাম্মদ! আপনার কি কোন অভিযোগ আছে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তখন জিবরীল বললেনঃ ‘বিসমিল্লাহ আরকীকা মিন কুল্লি শাইয়িন ইউযীকা ওয়া মিন শাররি কুল্লি নাফসিন আও আইনি হাসিদিন, আল্লাহু ইযাশফীকা, বিসমিল্লাহি আরকীকা’-আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ঝাড়-ফুঁক করছি এমন প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য, যা আপনাকে কষ্ট দেয় এবং প্রত্যেক ব্যক্তির অনিষ্ট ও হিংসুকের নযর থেকে। আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করুন। আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ঝাড়-ফুঁক করছি। (মুসলিম)
আল্লাহ আমদের কে সঠিক ভাবে তার দ্বীনকে বুঝে আমল করার তৌফিক দান করুন আমীন ।