প্রতিটিমানুষেরই কমবেশি শখ আছে। খ্যাতিমানরাও এর বাইরে নন। আমাদের এমন ধারণা হতে পারে যে, বিখ্যাত মানুষগুলো বুঝি সারাদিন টেবিলে মুখ গুঁজে কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তাদের বুঝি শখ মেটানোর ফুরসতই মেলে না। দিন-রাত-সন্ধ্যা নেই শুধু কাজ আর কাজ। আসলে তা কিন্তু নয়।
তাদেরও ব্যক্তিগত জীবন রয়েছে। তাদেরও রয়েছে কিছু স্বভাব, যা দিয়ে অন্যদের থেকে তাদের আলাদা করা যায়। তারা হয়তো অন্য সকলের মতো একেবারেই নন, তাদের শখগুলো হয়তো অন্যরকম কিন্তু সেখান থেকেই পাওয়া যায় তাদের জীবনবোধ বা রুচির পরিচয়।
যেমন আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, অনেকেই শখ করে ডাকটিকিট জমাত। এখন শিশু-কিশোর এমনকি তরুণদেরও শখ আটকে গেছে সেল ফোনে। ক্যাসেট এবং সিডি সংগ্রহের দিনও শেষ হয়ে এলো। শখ করে ঘড়ি বা টুপি সংগ্রহের খবরও আর পাওয়া যায় না।
কিন্তু তাই বলে শখের সংগ্রহ যে একেবারে কেউ করেন না তা নয়। ডাকটিকিট জমানোর শখ নিয়ে আমেরিকার ৩২তম রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ যৌবনে যে উৎসাহ, উদ্দীপনা আনে তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়। কোনো কিছু সংগ্রহের মানসিকতা দৃষ্টিকে প্রসারিত করে। এই শখ জীবনকে জ্ঞানসমৃদ্ধ করে সুনাগরিক হতে সাহায্য করে।
আর এ জন্যই বুঝি শখের এত মূল্য! যে কারণে লোকে বলে ‘শখের তোলা আশি টাকা।’ যাই হোক, পাঠক চলুন জেনে নেই বিখ্যাত ব্যক্তিদের শখের কথা।
সম্রাট আকবরের ছিল অনেকগুলো পোষা শিকারি চিতা। তিনি শিকার করতে ভালোবাসতেন। শিকারে গিয়ে চিতাগুলো জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে কৌশলে কৃষ্ণসার হরিণ শিকার করতেন। বাবরের ছিল গণ্ডার শিকারের শখ। ওদিকে বাদশা জাহাঙ্গীরের শখ ছিল মাছ ধরে নাকে নোলক পরিয়ে সেই মাছগুলো পুনরায় পানিতে ছেড়ে দেয়া।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল অভিনয় আর ভ্রমণের শখ। তিনি চিঠি লিখতেও ভালোবাসতেন। এই অবসরে একটি কথা জানিয়ে রাখি, কিছুদিন পরপর বাড়ি বদল করাও ছিল তার আরেকটি স্বভাব। এক বাড়িতে তিনি বেশিদিন থাকতে চাইতেন না। আর এ কারণেই শুধু শান্তিনিকেতনেই কবির জন্য অনেকগুলো বাড়ি বানাতে হয়েছিল।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের শখ ছিল বিভিন্ন ধরনের রুমাল সংগ্রহ করা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শখ সম্পর্কে বেশ সুন্দর তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাইতে ভালোবাসতেন। মুজাফফর আহমেদ স্মৃতিকথায় লিখেছেন :
‘এত বেশি রবীন্দ্রসংগীত সে কী করে মুখস্থ করেছিল তা ভেবে আমরা আশ্চর্য হতাম!’
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যও রবীন্দ্রসংগীত শুনতেন। আপনি হয়তো ভাবছেন, রবীন্দ্রসংগীত তো অনেকেই শোনেন। এ আর এমন কী! তাহলে বলছি, কবি সুকান্ত কানের কাছে রেডিও নিয়ে রাতভর বসে থাকতেন। কারণ তিনি তো আর জানতেন না, কখন রবীন্দ্রসংগীত প্রচার হবে। সেজন্যই এ ব্যবস্থা।
ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের ছিল কুকুর পোষার শখ। কুকুর তিনি খুব ভালোবাসতেন। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ধরুন পরজন্মে আপনাকে একটা জন্তু হতে বলা হলো। কোন জন্তু হতে আপনার ভালো লাগবে? ইন্দিরা চটপট উত্তর দেন, কৃষ্ণসার হরিণ।
অনেকের ধারণা, তিনি হরিণ পছন্দ করতেন, কারণ হরিণের মতোই তিনি দৌড়াতে পারতেন। বইয়ের মধ্যে অভিধান ছিল তার খুব প্রিয়। আর খুব বৃষ্টিতে ভিজতে চাইতেন। তিনি উপভোগ করতেন, প্রথম বর্ষায় ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ, বৃষ্টি ধোয়া রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, গাছের পাতায় লেগে থাকা জলবিন্দুর ঝিকিমিকি, শান্ত নদী এবং ডালপালা ছড়িয়ে দেয়া অতি প্রাচীন গাছের ছায়া।
গ্রীষ্মকালে বরফ গলা পানিতে ডুব দেয়া, সাঁতার কাটা, শহর ছাড়িয়ে দূরে চলে যাওয়া, তাঁবু খাঁটিয়ে থাকা আর শীতের সকালে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর খালি পায়ে হাঁটতে ইন্দিরা গান্ধী পছন্দ করতেন। কোথাও সফরে গেলে তিনি পুরনো কেল্লা খুঁজে বেড়াতেন। যত রকম প্রিয় শব্দ আছে তার মধ্যে নদীর কলকল, বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তার ভালো লাগত।
সাহিত্যিক প্রেসিডেন্ট লেলিনের ছিল চারটি সুন্দর বিড়াল। এগুলো তিনি নিজেই দেখাশোনা করতেন। ভিয়েতনামের নেতা হো চি মিনের শখ ছিল দীর্ঘ রোজ নামচা লেখা। ডাকটিকিট জমাতেন সুইডেনের রাজা গুস্তভ, স্পেনের রাজা আলফানসো, মিসরের নেতা রাজা ফুয়াদ, রুমানিয়ার রাজা ক্যারোল, বিজ্ঞানী আইনস্টাইনসহ বিশ্ববিখ্যাত অনেকেই। আর এ কারণে বিষয়টিকে ‘রাজকীয় শখ’ বলা যেতেই পারে।
অনেকের আবার খেলাধুলার শখ থাকে। পৃথিবীখ্যাত সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি ছিলেন পাকা দাবারু। দাবা পেলে তিনি অনেক কিছুই ভুলে যেতেন। সাহিত্যিক ওস্কার ওয়াইল্ডের শখ ছিল কাঠবিড়ালী পোষা। অনেক কুকুর পুষতেন রুশ লেখক দস্তয়েভস্কি। লিও টলস্টয়ের ছিল প্রতিদিন ডায়েরি লেখার অভ্যাস। ঔপন্যাসিক হেনরি জেমস জমাতেন বিভিন্ন রকম পাথর। কবি হুইট ম্যানের ছিল বিভিন্ন ধরনের কলমে কবিতা লেখার অভ্যাস।
এক রকম কলম দিয়ে তিনি একেবারেই লিখতে পারতেন না। কবি লর্ড বায়রনের অবশ্য এসব ছিল না। তিনি সময় পেলেই ঘোড়ায় চড়তেন আর মজা করে সাঁতার কাটতেন। ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগোর বাড়িতে ছিল একপাল রাজহাঁস। এগুলো লালন-পালনে তিনি ভীষণ আনন্দ পেতেন। কবি শেলীর নৌকা ভ্রমণের শখ এতটাই ছিল যে, তার ভক্তরাও সেটা জানতেন।
উর্দু কবি মির্জা গালিবের ছিল অসংখ্য ময়ূর। ভিক্টর হুগোর মতোই তিনি নিজেই ময়ূরগুলো নিয়মিত দেখভাল করতেন। ফরাসি সার্থক ছোট গল্পকার মোপাসার শখ ছিল নৌকা বাইচ দেয়া আর সাঁতার কাটা। সাহিত্যিক আনাতোলা ফ্রাঁস জীবনে যতটুকু ঘুমিয়েছেন তার দ্বিগুণ সময় বই পড়ে কাটিয়েছেন। কারণ বই পড়া ছিল তার প্রধানতম শখ। বই পড়া শেষে তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। দুই চোখ ভরে দেখতেন নদী, ফুল, পাখি আর জোছনা।
তিনি বলেছেন, পৃথিবীতে সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছু সত্য নয়। সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় কাটিয়েছেন নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরে। এই লেখক আফ্রিকার জঙ্গলে বন্দুক নিয়ে শিকার করতেন। তিনি ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই করতেও ভালোবাসতেন। লেখক আলেকজান্ডার দ্যুমার লেখার ব্যাপারে ছিল আশ্চর্য শখ। তিনি পত্রিকার নিবন্ধ লিখতেন গোলাপি কাগজে, কবিতা লিখতেন হলুদ কাগজে আর নীল রঙের কাগজে লিখতেন উপন্যাস।
তার আরেকটি বাতিক ছিল, তিনি যখন অনুভব করতেন পুরো লেখাটাই তার মাথায় চলে এসেছে তখনই তিনি লেখার টেবিলে বসতেন। গল্প না গুছিয়ে তিনি লিখতে পারতেন না। এই ব্যাপারটি কমবেশি এডগার অ্যালেন পোর ছিল। তিনিও গল্পের চরিত্রগুলো কেমন হবে, তারা কী কী বলবে এসব ভেবে নিয়ে তবেই লেখা শুরু করতেন। এ জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতেও দ্বিধা করতেন না।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও এ কথা বলা যায়। লেখার উপকরণ আহরণের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা জঙ্গলে বসে থাকতেন ‘পথের পাঁচালী’র এই লেখক।
Posted by Ab Emon