কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ) থেকে সুবল চন্দ্র দাস ঃ শীতে অভয়ারণ্য হিসেবে পাখি ভিড় জমিয়েছে হাওরের ইটনা উপজেলার পশ্চিমগ্রাম বানিয়াহাটিতে। গ্রামে হাজারো পাখির কোলাহল দেখে পথিক থমকে যায়। শীতে হাওরের অতিথি পাখিরা যখন রাতযাপনে ফিরে আসে তখন ওই গ্রামের প্রয়াত কুদরত উল্লাহ চেয়ারম্যানের বাড়ির গাছপালা, এমনকি পাতাঝরা গাছের অসংখ্য ডালপালা হয়ে ওঠে তাদের নিবাস। সন্ধ্যায় যখন নিড়ে ফিরে তখন পাখির ডানার ঝাপটায় আকাশ হয়ে ওঠে আরও কালো। সন্ধ্যায় পাখির কিচির-মিচির শব্দে পুরো গ্রামে আলোড়ন ওঠে। দেখলে মনে হয় ‘পাখিস্বর্গ’। সরেজমিনে দেখা গেছে, পাখিপ্রেমী কুদরত উল্লাহর পরিবারের বংশধরদের সহায়তায় ইটনা উপজেলা সদরের পশ্চিমগ্রাম বানিয়াহাটিতে নিড় গড়ে তুলেছে হাজার পানকৌড়ি। অতিথি হিসেবে এসে এখন সবকিছু দখল করে রীতিমতো বিশাল ভিটির মালিক বনে গেছে তারা। যাদের ভিটায় পাখিরা দখলদারিত্ব কায়েম করেছে সেই সব পরিবারের লোকজন পাখিদের কাছে হেরে গিয়েও মহাখুশি। বাড়ির মালিক ইসমাঈল মাস্টার, মঞ্জিল মিয়া, শামীম মিয়া, এএমপি পরশ কয়েক হাজার পাখির সঙ্গে দুই বছর ধরে বাস করতে করতে তাদের পরিবারের সবাই পাখিবন্ধু বনে গেছেন। পাখিদের সঙ্গে কে বেশি ভাব জমাতে পারে তা নিয়েই এখন পরিবারের সদস্যদের মাঝে প্রতিযোগিতা। পাখিরাও বোধ করি এ প্রতিযোগিতা উপভোগ করে। বিষয়টি বোঝা যায় এ পরিবারের সবার সঙ্গে পাখিদের ভাব ও খাতির দেখে। ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, হাজারখানেক পানকৌড়িকে চেয়ারম্যান বাড়িটিকে প্রিয় আবাস হিসেবে ব্যবহার করে পানকৌড়িরা পার্শ্ববর্তী হাওর ও বিলে গেছে খাবারের খোঁজে। হাওরে পর্যাপ্ত খাবার খেয়ে সন্ধ্যায় ফেরে চেয়ারম্যান বাড়িতে। দিনের বেলায় সব বা”চা পাখির বাবা-মা খাদ্য নিয়ে ফিরে না এলেও শত শত বা”চা একটা ঝাঁক দেখলেই চিৎকার-চেঁচামেচি শুর“ করে। তখন কানে তালা ধরার দশা। এসব পানকৌড়ি নিজের মতো করে দুই বছর ধরে ৫০ শতাংশ জায়গার ওপর অব¯ি’ত চেয়ারম্যান বাড়িতে জীবনযাপন করছে। ওই পাখিগুলোকে হত্যা করার জন্য একদল যুবক প্রায় সময় বাড়িতে হামলা চালায়। বিকেলে সংঘবদ্ধ শিকারির দল গুলান দিয়ে পাখি নিধনের জন্য ইটনা কলেজ সংলগ্ন প্রিজে শিশুদের পাখি হত্যায় লেলিয়ে দেয়। থানা পুলিশকে জানালে সাময়িক রা পেলেও পাখি হত্যা বন্ধ হ”েছ না। তারপরও শিকারিদের রক্তচুকে উপো করে পাখিগুলো চেয়ারম্যান বাড়িকে ভালোবেসে সেখানেই বসবাস করছে। ওই বাড়িতে বসবাসরত ইঞ্জিন মিয়া তার ব্যবসার অবসরে পুরো সময়টা দেন পানকৌড়িদের পেছনে। তার চিন্তার সবটা দখল করে আছে এসব পাখি। তিনি জানান, গত বছর থেকে পানকৌড়িরা তাদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করছে। পরিবারের সবার বিশ্বাস তাদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে এরা। প্রথম দিকে এসেছিল শ’পাঁচেক পাখি। এরপর হাজার হাজার পানকৌড়ি তাদের বাড়ির গাছপালায় আশ্রয় নিতে থাকে। অতিথি পাখিরা যে শুধু এ বাড়িতেই থাকে তা কিš‘ নয়, আশপাশের বাড়িতেও থাকে। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ প্রতিবেশীরাও। তাদের বাড়িঘর পাখির বিষ্ঠার গন্ধে প্রায় বাস অনুপযোগী। সব পাখি ঘরে ফিরলে সন্ধ্যার পর থেকে শুর“ হয় বিষ্ঠাবৃষ্টি। এরপরও বাড়ির মহিলা রূপজান (৫০), জান্নাতুল (৫০), জাহানারা বেগম (৪০) পাখির প্রতি ভালোবাসা, মায়া-মমতার কারণে সব অত্যাচার হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। পাখিগুলো পরিবারের কাউকে ভয় পায় না। বাড়ির ইসমাঈল মাস্টার, শামীম মিয়া পাখিদের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখেন। এদের জন্য রয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যব¯’া। প্রতিবেশীরাও এদের দিকে খেয়াল রাখে। গত বছর পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক লোক বাড়ি নীরব দেখে বেশ কয়েকটি পানকৌড়ির বা”চা ধরে পালাতে গিয়ে প্রতিবেশীর হাতে ধরা পড়ে। প্রতিবেশীরা তাকে গণপিটুনি দিয়ে পাখিগুলো রেখে ছেড়ে দেয়। এলাকার প্রভাবশালীরাও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বাড়িতে পাখি শিকার করতে আসে। তখন তাদের নিবৃত্ত করতে মারামারি অব¯’ায় এসে যায়। এভাবে বাধা দেওয়ার কারণে এলাকার মানুষের মাঝে পাখি বিষয়ে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হ”েছ। তাই এখন আর কেউ এগুলো শিকার করতে আসে না। এ এলাকার শিক সাইফুল মাস্টার বলেন, পাখিগুলো সন্তানের মতো। শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত কেউ এদের কোনো তি করতে পারবে না। সন্তানরা বাবা-মার তি করলেও বাবা-মা তো সন্তানকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় না। আমরা এলাকাবাসী পাখিদের রায় ঝুঁকি নিতে রাজি। পাখিগুলো যতদিন গ্রামে থাকবে তত দিন এদের বুকে আগলে রাখব। মাঝে মধ্যে ঝড় শুর“ হলে হাজার হাজার ছোট-বড়পাখি নিচে নেমে আসে। বাড়িঘরে ঢুকে পড়ে, যেন এগুলোও তাদের থাকার জায়গা। মানুষ-পাখিকে একসঙ্গে গাদাগাদি করে তখন থাকতে হয়। চৌকির ওপর-নিচ পাখিরা দখল করে নেয়। তাড়িয়ে দিলে আবার ফিরে আসে। তখন তাদের খাদ্যেরও ব্যব¯’া করতে হয়। এ বিপদের সময় পাখিরা বাড়ির লোকজনের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে, দেখে চোখ ভিজে যায়। বাড়ির লোকজন জানান, অগ্রহায়ণ মাস থেকে এরা বাড়িতে আসতে শুর“ করে। ফিরে যায় চৈত্রের শেষের দিকে। যে সময়টা পাখিরা থাকে না তাদের পরিবার থেকে বুঝি আনন্দও উধাও হয়ে যায়। সবাই যেন কেমন মনমরা থাকেন। কার্তিক মাস থেকেই শুর“ হয় প্রতীা। শুধুই আকাশপানে চেয়ে থাকা, কখন আসবে পানকৌড়ি বন্ধুরা। প্রথম পানকৌড়ির ঝাঁকটা দেখে সবাই খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। তখনই ুধার্ত স্বজনদের জন্য বাজার থেকে মাছ কিনে এনে খেতে দেওয়া হয়। এভাবেই পরম মমতায় রীতিমতো উৎসব করে পাখিদের বরণ করে নেন বাড়ির লোকজন। বিকেল হলেই হাওরপাড়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মানুষ, এমনকি দূরদূরান্ত থেকে আসা অতিথিরাও এ পাখিদের একনজর দেখে মুগ্ধ হন। অনেকে পাখিদের কলকাকলি ওড়াউড়ি দেকে অভিভূত হন। এ সময় হাজার হাজার পাখি তাদের মাথার ওপর চক্কর দিতে দিতে সম্ভবত এ কথাটি বোঝাতে চায়, তোমরা আমাদের মেরো না। আমাদেরও প্রাণ আছে। আমরাও তোমাদের স্বজন, প্রয়াত কুদরত উল্লাহর বসতবাড়ি আমাদের স্বজনের বাড়ি।