সম্প্রতি ৭৫০ কোটি মার্কিন ডলারে ব্ল্যাকবেরি কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে স্যামসাং। এতে কী সংকেত মেলে? বিষয়টি থেকে কি এমন ধারণা করা যায় যে স্মার্টফোনের বাজারে নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে এবং মুনাফার হার ঠিক রাখার জন্য স্যামসাংয়ের প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ রসদের মজুদ শেষ! সম্প্রতি এ বিষয়টিই এক প্রতিবেদনে তুলে এনেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
একটা সময় নির্ভরযোগ্য পরিমাণ আয় আসত স্যামসাংয়ের মোবাইল বিভাগ থেকেই। কিন্তু অ্যাপলের আইফোন ও চীনা স্মার্টফোন নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রিয়তার কারণে সে লাভের গুড়ে পিঁপড়া ধরেছে। ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে মুনাফা আর ফোন থেকে আসা আয়ের পরিমাণ। স্যামসাংকে টেক্কা দিচ্ছে অ্যাপল ও চীনের জিওমি। গত তিন বছরের মধ্যে ২০১৪ সালের সবচেয়ে বেশি মুনাফা কমেছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠানটির।
স্মার্টফোন বিভাগে যথেষ্ট অভিনবত্ব না দেখাতে পারায় শোরগোল উঠেছিল যে শিগগিরই পদ খোয়াতে পারেন প্রতিষ্ঠানটির মোবাইল ব্যবসা বিভাগের প্রধান জেকে শিন। ডিসেম্বরে এ নিয়ে স্যামসাং কর্তৃপক্ষ এক দফা বৈঠক করলেও তাঁর ওপর আস্থা রেখে মোবাইল বিভাগটিকে আবার পুনর্গঠন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, মোবাইল ফোনের বাজারে স্যামসাংকে এগিয়ে রাখতে না পারলে জেকে শিনের ওপর থেকে আস্থা সরে যাবে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের।
২০০৯ সাল থেকে স্যামসাংয়ের মোবাইল ব্যবসা বিভাগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন শিন। তাঁর নেতৃত্বেই স্যামসাং তাঁদের জনপ্রিয় গ্যালাক্সি এস সিরিজের স্মার্টফোন বাজারে এনেছে, যা অ্যাপলকে হটিয়ে স্মার্টফোনের বাজারের শীর্ষস্থান এনে দিয়েছে স্যামসাংকে। ২০১৩ সালে রেকর্ড পরিমাণ মুনাফাও এসেছে মোবাইল বিভাগ থেকে। কিন্তু ২০১৪ সালের পারফরম্যান্স ঠিক ২০১৩ সালের মতো হয়নি। গত ডিসেম্বরেই জেকে শিনের প্রধান তিন কর্মকর্তাকে পদ হারাতে হয়েছে। এতে শিনের ওপর আরও বেশি প্রত্যাশার চাপ বেড়ে গেছে।
মোবাইল ফোন বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার জন্য ব্ল্যাকবেরিকে কিনতে চাওয়ার এ প্রচেষ্টার একটিই মানে হতে পারে। অবশ্য দুটি প্রতিষ্ঠানই তাদের মধ্যকার দর-কষাকষি ও আলোচনার ঘটনাটি অস্বীকার করেছে।
অবশ্য রয়টার্সের হাতে এর প্রমাণও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র ও কাগজপত্র ঘেঁটে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক খবরে এ তথ্য জানিয়েছে।
ব্ল্যাকবেরি ও স্যামসাংয়ের প্রতিনিধিরা নাম প্রকাশ না-করার শর্তে রয়টার্সকে বলেছেন, গত সপ্তাহে ব্ল্যাকবেরির দাম ও কেনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনায় বসেছিলেন দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। করপোরেট বাজারে অ্যাপলের সঙ্গে পেটেন্ট যুদ্ধে জয়ী হতে ব্ল্যাকবেরির প্যাটেন্ট ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে চায় স্যামসাং। করপোরেট বাজার দখলই লক্ষ্য স্যামসাংয়ের। এ জন্য সাড়ে ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার দাম হেঁকেছেন তাঁরা।
যদিও এখন কানাডার স্মার্টফোন নির্মাতা ব্ল্যাকবেরি শীর্ষ পাঁচের মধ্যে নেই, তার পরও বেশ কিছু করপোরেট গ্রাহক রয়েছে ব্ল্যাকবেরির। এর নিরাপদ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ব্ল্যাকবেরি মোবাইল ব্যবহার করেন।
বিশ্লেষকেদের চোখে ব্ল্যাকবেরির বড় শক্তি হচ্ছে এর পেটেন্ট পোর্টফোলিও। মোবাইল হ্যাক যখন নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন ব্ল্যাকবেরির কাছে আছে উন্নত এনক্রিপশন প্রযুক্তি।
অর্থ খরচ করার দিক থেকে স্যামসাংকে কৃপণ বা রক্ষণশীল বলা যায়। ব্ল্যাকবেরিকে কিনে নেওয়ার মতো এত বড় একটি চুক্তিতে যেতে হলে স্যামসাংয়ের প্রচুর অর্থ খরচ হয়ে যাবে। অবশ্য গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের হিসাব অনুযায়ী, নগদ ও সম্পদ মিলিয়ে স্যামসাং ৬২০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থ সম্পদের প্রতিষ্ঠান।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান অর্গানিক লিমিটসের বিশ্লেষকেরা বলছেন, ব্ল্যাকবেরিকে কেনার মতো বড় ঝুঁকিতে স্যামসাংকে যেতেই হবে, কারণ স্যামসাংয়ের হাতে আর বিকল্প কিছু নেই। নিজস্ব আর কোনো চমক স্যামসাংয়ের কাছে নেই, যা দিয়ে আয়ের খাতটির চাকা আরও দ্রুত ঘোরানো যায়।
হ্যানসুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক কিম স্যাং-জো বলেন, ‘স্যামসাং কর্তৃপক্ষ নিজেরাও বুঝতে পারছে যে অর্গানিক গ্রোথ বা স্বাভাবিকভাবে যতখানি বেড়ে ওঠা সম্ভব, সে সীমানায় পৌঁছে গেছে তারা। এখন বিদেশি প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণের এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে দেখার পথে রয়েছে স্যামসাং।’
স্যামসাং মোবাইল ব্যবসার পাশাপাশি চিপ ও মোবাইল যন্ত্রাংশও তৈরি করে। চিপ ও যন্ত্রাংশের চাহিদা যথেষ্ট বাড়ছে এবং এ থেকে প্রচুর মুনাফা করছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু মোবাইল বিভাগের আয় যে পরিমাণে কমছে, তা এ ক্ষেত্রের আয় দিয়ে পোষাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটির।
রয়টার্স ৫২ জন বিশ্লেষকের মধ্যে জরিপ করে দেখেছে যে এ বছরও স্যামসাংয়ের মুনাফা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাবে।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনারের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত স্মার্টফোন বাজারে পতনের ধারা অব্যাহত ছিল স্যামসাংয়ের। ৩২ শতাংশ থেকে বাজার দখল করে ওই সময় ২৪ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসে। যদিও বছরের শেষ দিকে সাশ্রয়ী ও মাঝারি দামের ফোন বিক্রি বেশি হওয়ায় কিছুটা পুষিয়ে যেতে পারে।
ব্ল্যাকবেরিকে কিনে নিতে পারলে স্যামসাংয়ের নতুন মুনাফার খাত তৈরি হবে এবং বাজারে শীর্ষস্থান দখলে কিছুটা স্বস্তির জায়গা পাবে। বর্তমানে স্যামসাংয়ের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে অ্যাপলসহ চীনের স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্ল্যাকবেরির প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে অ্যাপল ও চীনা স্মার্টফোন নির্মাতাদের সহজেই পেছনে ফেলতে পারবে, পাশাপাশি করপোরেট ক্ষেত্রেও ব্যবসা ধরতে পারবে।
ফরেস্টারের বিশ্লেষক জিন চাও তো বলেই ফেললেন, ‘স্যামসাং ব্র্যান্ডিংয়ের সঙ্গে যদি ব্ল্যাকবেরির প্রযুক্তি দিয়ে প্রচারণা চালাতে পারে খুব ভালো জুড়ি হয়।’
অবশ্য এ ধরনের দুটি বিষয়কে এক করা বেশ কঠিন। কারণ স্যামসাং এর আগে কখনো এত বড় প্রতিষ্ঠান কেনার মতো চিন্তাভাবনা করেনি। এ ছাড়া কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলোর ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সংস্কৃতি তাদের বিদেশি কর্মীদের সঙ্গে কাজের সমস্যা তৈরি করতে পারে। এর আগে নব্বইয়ের দশকে বেশ কয়েকবার লোকসান ও কর্মী ধরে রাখার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এএসটি রিসার্চ নামে একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানকে অধিগ্রহণ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি।
কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক ও সনি ভার্সেস স্যামসাং বইয়ের লেখক চ্যাং সি জিন বলেন, ‘কোনো না কোনো একসময় স্যামসাংকে এ ঝুঁকি নিতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো প্রতিষ্ঠানকে অধিগ্রহণ করার পর তার সঙ্গে সফলভাবে যুক্ত হওয়ার সক্ষমতা স্যামসাংয়ের আছে কি না।’