1. ccadminrafi@gmail.com : Writer Admin : Writer Admin
  2. 123junayedahmed@gmail.com : জুনায়েদ আহমেদ, সম্পাদনায়-আরজে সাইমুর : জুনায়েদ আহমেদ, সম্পাদনায়-আরজে সাইমুর
  3. swadesh.tv24@gmail.com : Newsdesk ,স্বদেশ নিউজ২৪.কম : Newsdesk ,স্বদেশ নিউজ২৪.কম
  4. swadeshnews24@gmail.com : নিউজ ডেস্ক, স্বদেশ নিউজ২৪.কম, সম্পাদনায়-আরজে সাইমুর: : নিউজ ডেস্ক, স্বদেশ নিউজ২৪.কম, সম্পাদনায়-আরজে সাইমুর:
  5. hamim_ovi@gmail.com : Rj Rafi, সম্পাদনায়- সাইমুর রহমান : Rj Rafi, সম্পাদনায়- সাইমুর রহমান
  6. skhshadi@gmail.com : শেখ সাদি, সম্পাদনায়-সাইমুর রহমান: : শেখ সাদি, সম্পাদনায়-সাইমুর রহমান:
  7. srahmanbd@gmail.com : এডমিন, সম্পাদনায়- সাইমুর রহমান : এডমিন, সম্পাদনায়- সাইমুর রহমান
  8. sumaiyaislamtisha19@gmail.com : তিশা, সম্পাদনায়-সাইমুর রহমান : তিশা, সম্পাদনায়-সাইমুর রহমান
সুন্দরবনের শেলাবুনিয়ায় আমাকে কবর দিতে হবে, অন্য কোথাও না’-ফাদার রিগন - Swadeshnews24.com
শিরোনাম
গোবিন্দগঞ্জে অটোচালক দুলা হত্যার মূল আসামি আটক চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু পলাশবাড়ীতে উপজেলা নির্বাচনে অনলাইন মনোনয়নপত্র দাখিলের বিষয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সাথে মতবিনিময় ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলেই বিএনপি বলে বিরোধীদল দমন’ এবার বুবলী-শাকিবের ‘কোয়ালিটি টাইম’ নিয়ে মুখ খুললেন অপু বাংলাদেশের সফলতা চোখে পড়ার মতো: সিপিডির রেহমান সোবহান চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে যা বললেন নিপুণ তালিকা দিতে না পারলে ফখরুলকে ক্ষমা চাইতে বললেন ওবায়দুল কাদের প্রকাশিত হলো দিদারের ‘বৈশাখ এলো রে এলো বৈশাখ’ আ.লীগের মতো ককটেল পার্টিতে বিশ্বাসী নয় বিএনপি: রিজভী হৃদয় খানের সঙ্গে জুটি ন্যান্সিকন্যা রোদেলার শাকিব ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে ভাবতে পারি না: বুবলী শাকিবের এমন সময় আমাদেরও ছিল: ওমর সানী কত টাকা সালামি পেলেন জায়েদ খান, দিতে হলো কত লাখ? শাকিব খানের সঙ্গে বিয়ে,দেনমোহর, বিচ্ছেদসহ নানা বিষয় নিয়ে মুখ খুললেন বুবলী

সুন্দরবনের শেলাবুনিয়ায় আমাকে কবর দিতে হবে, অন্য কোথাও না’-ফাদার রিগন

  • Update Time : মঙ্গলবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
  • ৪২৯ Time View

1423029627_07ফাদার রিগন ২৮ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন এক তরুণ মিশনারি হিসেবে। ধর্মতত্ত্ব, মানবকল্যাণ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে পশ্চিমের ইতালিতে থেকে প্রাচ্যের বাংলাদেশে থিতু হয়েছিলেন ক্যাথলিক মিশনে। গ্রিক, ফেঞ্চ, লাতিন, ইংরেজি জানা এই তরুণ ভালোবেসে ফেলেন বাংলাভাষা ও বাংলাদেশকে। নিয়মনিষ্ঠ মিশনারি জীবনে তার নির্দিষ্ট কাজের সীমানা তাই ছুঁয়ে যায় বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জসীমউদ্দীন-এর সাহিত্য অনুবাদে। ইতালীয় ভাষায় ৫০-এর ঊর্ধ্বে শুধু রবীন্দ্রনাথের বইয়ের অনুবাদ করেছেন ফাদার রিগন। মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসী ভূমিকা তাকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা।
বাংলাদেশের সম্মানিত নাগরিক এই আলোকিত মানুষটির শেষ জীবন কাটছে সুদূর ইতালিতে। কিন্তু তার হৃদয়জুড়ে এখনও বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ। ফাদার মারিনো রিগনের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথন শেষে তার সম্পর্কে জানাচ্ছেন পলাশ রহমান ইতালি থেকে

সকাল সাড়ে আট’টা। আমি এবং ভেনিস বাংলা স্কুলের সভাপতি সৈয়দ কামরুল সরোয়ার রওনা করলাম ভিসেনছার উদ্দেশে। ভেনিসের ম্যাস্ত্রে স্টেশন থেকে ভিসেনছার দুরত্ব ৫৯ কিলোমিটার। সকাল ন’টার মধ্যে আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম। স্টেশনের কাছাকাছি একটা স্নাক্সবার থেকে ইতালির বিখ্যাত কাপোচিনো এবং ব্রিওয়াশ দি মারমেলাতায় প্রাতঃরাশ সেরে নিলাম। বাইরে তখন শেষ নভেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডা। জ্যাকেটের হুট দিয়ে মাথা মুড়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। মিনিট পনেরো হেঁটে পৌঁছে গেলাম সাভেরিয়ানি মিশনে। এখানেই থাকেন ইতালীয় বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি নাগরিক এবং মুক্তিযুদ্ধের অকৃতিম বন্ধু ক্যাথলিক পুরহিত ফাদার মারিনো রিগন।
মিশনের অভ্যর্থনা কক্ষে বসা মহিলাকে জানালাম, আমরা ফাদার মারিনো রিগনের সঙ্গে দেখা করতে চাই। ভদ্রমহিলা জানতে চাইলেন কোথা থেকে এসেছি। বললাম, ভেনেসিয়া থেকে। তিনি ইন্টারকমে ফাদার মারিনোকে খবর জানিয়ে দিলেন এবং আমাদের অপেক্ষা করতে বললেন। এক মুহূর্ত কী যেন ভেবে ভদ্রমহিলা অভ্যর্থনা কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। খুব আন্তরিকভাবে জানালেন, মিশনের নিচতলায় একটা কুটিরশিল্প মেলা হচ্ছে। সাভেরিয়ানি মিশনে যারা থাকেন তাদের তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্প প্রদর্শিত হচ্ছে মেলায়। ইচ্ছা করলে আপনারাও মেলায় যেতে পারেন। আমরা সানন্দে মেলায় ঢুকে পড়লাম। মহিলাও কিছুটা সময় আমাদের সঙ্গ দিলেন। ধর্মীয় ভাবধারায় প্রদর্শিত শিল্পগুলো সম্পর্কে তিনি আমাদের ইতিবাচক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করলেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলাম ক্যাথলিক সন্ন্যাসীদের তৈরি করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পকর্ম। মেলার একপাশে বাংলাদেশের পতাকা এবং নকশিকাঁথা দেখলাম। বুঝতে অসুবিধা হলো না সুদূর বাংলাদেশ থেকে ওগুলো কীভাবে উড়ে এসেছে ইতালির এই সাভেরিয়ানি মিশনে।
প্রায় কুড়ি মিনিট পর উপরতলা থেকে নিচে নেমে এলেন ফাদার মারিনো রিগন। বয়সের ভার সামলাতে চাকাওয়ালা ট্রলিতে ভর দিয়ে হাঁটছেন ভারী পায়ে। আমরা ফাদারের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের দেখেই তিনি থমকে দাঁড়ালেন। তার চোখে মুখে ভেসে উঠল একরাশ অকৃত্রিম আনন্দ ঝিলিক। মনে হলো আমরা তার অনেক দিনের পরিচিত, অনেক আপন। তার চোখের পলকে পলকে তখন খেলা করছিল সবুজের ঢেউ, সে এক অদ্ভুত রকমের ভালোলাগা। বললাম, বুওনজর্ন (শুভদিন) পাদরে। উত্তরে তিনি বললেন, আমি বাংলাদেশের নাগরিক, আমার সঙ্গে ইতালিয়ান বলছেন কেন? আমরা কিছুটা লজ্জায় পড়ে গেলাম। বললাম, শুভ সকাল। তিনিও বললেন, শুভ সকাল।
সাভেরিয়ানি মিশনে আগত অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত একটি ছোট কক্ষে গিয়ে বসলাম আমরা। অনেক কথা হলো ফাদার মারিনোর সঙ্গে। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় আমরা কথা বললাম। ভেনিসে বাংলা স্কুল আছে, সেখানে ছেলে মেয়েরা বাংলা শেখে শুনে তিনি বেশ খুশি হলেন। বারবার জানতে চাইলেন বাংলা স্কুলের খুঁটিনাটি বিষয়ে। সৈয়দ কামরুল তাকে বাংলা স্কুল পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা জানি বাংলা স্কুল পরিদর্শনের মতো শারিরিক সক্ষমতা তার নেই। অথচ তিনি তার বার্ধক্যকে পাত্তাই দিলেন না। বললেন, ভেনিসে আমার এক ভাই বাস করে, আপনারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সে আমাকে নিয়ে যাবে।
ফাদার মারিনোর ছেলেবেলা, পুরহিত হওয়া, বাংলাদেশে যাওয়া, ইতালিতে ফিরে আসা, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অনুবাদ এবং শেষ ইচ্ছাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়। তিনি অকপটে বলেন, এখন আমি বাংলাদেশে থাকতে পারলে বেশি ভালো থাকতাম। কিন্তু কিছু করার নেই, আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে এখানে চলে আসতে হয়েছে। আমি তাদের কথা অমান্য করতে পারি না। আমাদের ক্যাথলিক মিশনের নিয়ম হলো ঊর্ধ্বতন ধর্মগুরুরা যা নির্দেশ করবেন তা মানতে আমরা বাধ্য। ১৯৫৩ সালে তাদের নির্দেশেই বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, ২০১৪ সালে তাদের নির্দেশেই ফিরে এসেছি। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশকে অনেক অনুভব করি। সব সময় বাংলাদেশের কথা মনে করি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং আতিথেয়তার কোনো তুলনা হয় না। বাংলাদেশের মানুষ অতিথিকে দেবতা মনে করে। তারা মেহমানকে বলে ‘অতিথি নারায়ণ’, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ বড়দের নাম ধরে ডাকে না, সম্পর্ক ধরে ডাকে, এগুলো আমার খুব ভালো লেগেছে। মারিনো বলেন, আমি বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মুগ্ধ ছিলাম। বাংলাদেশের আসল সংস্কৃতি অনেক ভালো। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারে না। তারা বুঝতে পারে না তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি কত ভালো।
রিগন বলেন, বাংলাদেশের মেয়েরা অনেক ভালো। তাদের মন অনেক নরম। তাদের অন্তরে অনেক প্রেম। তারা কথা বলে কবিতার মতো করে।
আমরা ফাদারের কথা শুনে একটু মজা করার চেষ্টা করি। বলি, আপনি কোনো বাংলাদেশি মেয়ের প্রেমে পড়েছেন?
মুখে হাসির রেখা টেনে মারিনো বলেন, পড়েছি তো কিন্তু তা বলা যাবে না। বাংলাদেশের অনেক মেয়ে আমাকে প্রেমের কথা বলেছে। আমি সেগুলোকে ঈশ্বরপ্রেম হিসেবে ধরে নিয়েছি। কারণ ক্যাথলিক সন্ন্যাসীদের প্রেমে পড়তে নিষেধ আছে।
সন্ন্যাসী হওয়ার আগে কেউ প্রেমের প্রস্তাব করেনি?
না, আমি যখন ইতালিতে থেকেছি তখন কেউ আমাকে প্রেমের কথা বলেনি। তখন আমার জীবনে প্রেম আসেনি। এলে হয়তো ধর্ম শিক্ষা নিতে পারতাম না।
কেন আসেনি?
সে সময়ের ইতালি এ সময়ের ইতালির মতো ছিল না। তখন সবকিছু এত সহজ এবং খোলামেলা ছিল না। সে সময়ে আমরাও অনেক সীমাবদ্ধ ছিলাম। আমাদের সমাজেও বিয়ের আগে ছেলে-মেয়েদের মেলামেশাকে ভালো চোখে দেখা হতো না।
বাংলাদেশের কার কার কথা আপনার বেশি মনে পড়ে?
এই প্রশ্ন শুনে মারিনো হেসে দিয়ে বলেন, সবাইকে। তিনি বেশ ক’জনের নাম মনে করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু পেরে ওঠেন না। বার্ধক্য তাকে অনেক কিছু ভুলিয়ে দিয়েছে। সবকিছু মনে রাখতে পারেন না। সব কথা গুছিয়ে বলতেও কিছুটা কষ্ট হয়। তার পরও মনে করার চেষ্টা করেন, খেই ধরিয়ে দিলে ঠিক ঠিক মনে করতে পারেন। খুলনার সোনাডাঙ্গায় আমার বাড়ি শুনে তিনি বলেন, ওখানেই ক্যাথলিকদের একটি হাসপাতাল আছে। ওই হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দিতে ইতালি থেকে ডাক্তার যায়। তিনি বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ ও তার স্ত্রীর কথা উল্লেখ করে বলেন, অনেক আগে থেকেই তাদের সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্ক। মওদুদের শ্বশুর কবি জসীমউদ্দীন বেঁচে থাকতেই তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়। আমি আর জসীমউদ্দীন একদিন শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। শেখ মুজিব তখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। অনেক চেষ্টা করেও তিনি নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপার নাম মনে করতে পারেননি। বার বার শুধু বলছিলেন, বাংলাদেশের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী…. কী যেন নাম!
আমরা তাকে ছোট ছোট কথা মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করি। বলি, আপনি একবার বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ আপনার মাথায় আর লালন আপনার অন্তরে।
তিনি বলেন, হ্যাঁ আমি বলেছি তো। আমি তাদের অনেক বই অনুবাদ করেছি। রবীন্দ্রনাথের লেখা অনেক ভালো, লালনের দর্শন আমি খুব পছন্দ করি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা-সেবা দিতেন।
সে কথা মনে করতেই যেনো আঁতকে ওঠেন মারিনো। বলেন, ‘ওরে বাবা, ওই সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অনেক অত্যাচার করেছে। গ্রামবাসীর ঘরে আগুন দিয়েছে, আমি যেখানে থাকতাম ওইখানে দুইজন হিন্দু ছেলেকে তারা হত্যা করেছিল। গ্রামের মানুষ মৃত ছেলে দুটিকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিল এবং আমি তাদের পরিবারের কাছে লাশ ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করেছি।
আপনি চিকিৎসার জন্য ইতালিতে আসার সময় বলেছিলেন, আপনার কবর যেন বাংলাদেশে হয়।
বলেছি তো। আমি এখনো চাই আমার কবর হবে খুলনার সুন্দরবনে। কিন্তু তা হয়তো হবে না, আমার ঊর্ধ্বতন গুরুরা বলেছেন, আমাকে এখানে থাকতে হবে। আমি তাদের কথা অমান্য করতে পারি না।
মৃত্যুর পর আমরা যদি আপনাকে নিয়ে যেতে চাই?
-আপনারা পারবেন? ফাদারের চোখে মুখে ফুটে ওঠে খুশির ঝরনাধারা, ঠিক যেন বড়দিনের খুশি।
বললাম, কেন পারব না? আপনি তো আমাদের দেশের মানুষ। আপনি চাইলে আমরা অবশ্যই পারব।
খুশিতে হাতে তালি দেন ফাদার মারিনো। সে কী আনন্দ তার চোখে মুখে, একদম শিশুর মতো। বায়নার সুরে বলেন, সুন্দরবনের শেলাবুনিয়ায় আমাকে কবর দিতে হবে, অন্য কোথাও না।
আমরা বললাম, তা-ই হবে ফাদার।
কথার ফাঁকে মারিনো রিগন তার লেখা একটা মৌলিক বই আমাকে উপহার দেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা ইতালীয় ভাষার ওই বইটির নাম ‘উনিভেরসালিজমো দি তাগোরে’ (টহরাবৎংধষরংসড় ফর ঞধমড়ৎব)।
ক্যাথলিক পুরহিত ফাদার মারিনো রিগনের জন্ম ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভিসেনছা প্রভিন্সের ভিল্লাভেরলা গ্রামে। বাবা রিকার্দো রিগন ছিলেন একজন কৃষক, অভিনেতা এবং গায়ক। তিনি কৃষি কাজের পাশাপাশি গ্রামের নাট্যদলে অভিনয় করতেন এবং গান-বাজনায় মগ্ন থাকতেন। সাহিত্যের প্রতিও তার ব্যাপক আগ্রহ ছিল। মা মনিকা রিগন ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা। আট ভাই-বোনের মধ্যে মারিনো সবার বড়। ছোট সময় থেকে তিনি সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। বাবা রিকার্দোকে দেখেই সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন মারিনো। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হয় মা মনিকার উৎসাহে। ছেলেবেলা থেকেই মারিনো বেশ শান্ত এবং মেধাবী ছিলেন। তখন থেকেই তার মধ্যে মানবিক গুণাবলি ফুটে উঠতে শুরু করে। মাত্র ৫/৬ বছর বয়স থেকেই মারিনো ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। ওই বয়সেই তিনি পুরোহিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আত্মমানবতার সেবায় নিজেকে বিনিয়োগের সংকল্প করেন। মারিনোর শিশু মনে ধর্মীয় পুরহিত হওয়ার স্বপ্ন প্রথম অঙ্কুরিত হয় তার বাবার অভিনীত একটা মঞ্চনাটক দেখে। ধর্মীয় কাহিনীর ওই নাটকে বাবা রিকার্দো যিশুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
মারিনোর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয় ১৯৩১ সালে নিজ গ্রামের প্রাথমিক স্কুল থেকে। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে তিনি যোগ দেন ক্যাথলিক মিশনারিতে। এরপর ওই মিশনারির তত্ত্বাবধায়নে একে একে হাইস্কুল এবং কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। একই সময়ে মারিনো ক্যাথলিক মিশনের ধর্মতত্ত্ব বিষয়েও শিক্ষা অর্জন করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শেষ এক বছর তিনি কাটিয়েছেন আমেরিকায়। সেখানের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মারিনো মানবকল্যাণ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। মারিনো ছাত্র সময় থেকেই গ্রিক, ফ্রেঞ্চ, লাতিন এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। ধর্ম প্রচারক হিসেবে বাংলাদেশে অভিবাসী হওয়ার পর বাংলা ভাষা রপ্ত করেন।
১৯৫৩ সাল, মারিনো রিগনের বয়স মাত্র ২৮ বছর। ধর্মের দীক্ষা নেয়া এক টগবগে যুবক। ধর্মগুরুরা নির্দেশ দিলেন তোমাকে বাংলাদেশে যেতে হবে ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক হিসেবে। ক্যাথলিক মিশনের প্রথা অনুযায়ী ‘না’ বলার কোনো সুযোগ নেই। ব্যাগ-পেঁটরা গুছিয়ে রওনা করলে মারিনো। জানুয়ারির ৬ তারিখে এসে পৌঁছালেন ভারতের কলকাতায়। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে ৭ জানুয়ারি তিনি যশোরের মাটিতে পা রাখেন এবং এরপর স্টিমার যোগে ঢাকায় যান। ১৯৫৩ সালের ৭ জানুয়ারি, অর্থাৎ বাংলাদশের জন্মের আগেই বাংলাদেশে আসেন মারিনো রিগন।
মারিনো ঢাকার আর্চবিশপ মিশনে থাকেন চার মাস। ওখানে বসেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ এবং সংস্কৃতি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করেন। নতুন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন ভাষা, নতুন আবহাওয়া, নতুন পরিবেশ, নতুন সংস্কৃতি, এ সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হলে প্রথমেই ভাষা জানা দরকার, বুঝতে দেরি হয় না যুবক মারিনোর। সে সময়ের ঢাকা শহর দেখেও বেশ অবাক হন তিনি, কিন্তু একটুও ঘাবড়াননি। চার মাস পর মারিনোকে পাঠিয়ে দেয়া হয় মুজিবনগরের (সে সময়ের কুষ্টিয়া) ভবেরপাড়া ক্যাথলিক মিশনে। সেখানে তিনি সহকারী পুরোহিত হিসেবে কাজ শুরু করেন।
একদম অজোপাড়া গাঁ। কাঁচা রাস্তা, কাঁচা বাড়িঘর। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তাগুলো চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায়। কিন্তু একদণ্ড থেমে থাকেন না ফাদার মারিনো। কখনো গরুর গাড়ি, কখনো ঘোড়ার গাড়ি, কখনো সাইকেল বা হেঁটে ধর্ম প্রচার করতে নেমে পড়েন তিনি। পাশাপাশি মনোযোগ দেন বাংলা ভাষা আয়ত্ত করতে। সেখানে কোনো শিক্ষক ছিল না, নিজে নিজে শেখার চেষ্টা করতেন। যা পারতেন তা-ই নিয়েই চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। মুজিবনগরের রতনপুর এবং বল্লভপুর ক্যাথলিক পল্লীর মানুষদের সঙ্গে বেশি সময় কাটত মারিনোর। তখন তিনি ওই অঞ্চলের মানুষদের মতো টেনেটেনে কিছু বাংলা বলা শিখেছিলেন।
১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত মাত্র এক বছর মুজিবনগরের ভবেরপাড়া মিশনে কাজ করেন মারিনো রিগন। এরপর চলে আসেন সুন্দরবনের পাশে মালাগাজি মিশনে। সেখানে ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ধর্মগুরুর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কাজ করেন খুলনার ক্যাথলিক মিশনে। এরপর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বানিয়াচর মিশনে এবং ১৯৭৯ সাল থেকে শুরু করে ইতালিতে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সুন্দরবনের শেলাবুনিয়ার সেন্ট পল মিশনে ধর্ম প্রচারকের কাজ করেছেন। তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন শেলাবুনিয়ার ক্যাথলিক মিশন। ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছেন ওই এলাকার। শেলাবুনিয়াকে তিনি একটি পর্যটন পল্লীতে রূপ দেন। সোঁদা মাটির গন্ধমাখা ওই এলাকার মানুষের সঙ্গে তার গড়ে উঠেছে আত্মার সম্পর্ক। মিশনের সিদ্ধান্তে তিনি শেলাবুনিয়া ছাড়তে বাধ্য হলেও এখনো যেন নাড়ির টান অনুভব করেন ওই অঞ্চলের প্রতি। আর তাই ফাদার মারিনোর মনে শেষ ইচ্ছা হলোÑ তার সমাধি হবে খুলনার শেলাবুনিয়ায়।
বাংলা ভাষার দখল নিতে ফাদার মারিনোর সময় লেগে যায় ৫ থেকে ৬ বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি বলা এবং লেখা দুটোই আয়ত্ত করেন। বাংলা ভাষা শেখার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েন মারিনো। ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি পুরোমাত্রায় বাংলা সাহিত্য বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। মেহেরপুর থেকে খুলনায় আসার পরে স্থানীয় একজন শিক্ষক ললিত পল সরকার মারিনোকে পরামর্শ দেন বাংলা শিখতে হলে শরৎ পড়তে হবে। তখন ওই শিক্ষকের পরামর্শে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পণ্ডিতমশাই’ পড়তে শুরু করেন মারিনো। বলা যায় ‘পণ্ডিতমশাই’ দিয়েই মারিনোর বাংলা সাহিত্যের হাতেখড়ি হয়। একে একে শরৎচন্দ্রের ত্রিশের বেশি বই পড়ে ফেলেন মারিনো। এর মধ্যে ‘পল্লী সমাজ’ সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তার। ‘দেবদাস’ সম্পর্কে মারিনোর মূল্যায়ন হলো, ওটি একটি ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী। তবে আধ্যাত্মিক বিবেচনায় তিনি বেশি পছন্দ করেন ‘পণ্ডিতমশাই’। শরৎচন্দ্রের পর মারিনো বঙ্কিম সাহিত্য পড়তে শুরু করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ দিয়ে শুরু করেন এবং একে একে তার সব বই পড়ে ফেলেন। ওই সময় অনেকেই মারিনোকে নিষেধ করতেন বঙ্কিম পড়তে। তারা বলতেন বঙ্কিম সাহিত্য অনেক কঠিন। এত তাড়াতাড়ি তুমি বঙ্কিম পড়লে বাংলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তারা মারিনোকে পরামর্শ দেন রবীন্দ্রনাথের বই পড়তে। ১৯৫৭ সালের মার্চ থেকে তিনি রবীন্দ্রনাথ পড়া শুরু করেন। সেই যে রবীন্দ্রনাথ তার মাথায় ঢুকেছে, আজও বের হয়নি। রবি সাহিত্যের প্রেমে পড়ে যান মারিনো। শুরু করেন নিজ ভাষায় (ইতালীয়) অনুবাদের কাজ। ‘গীতাঞ্জলি’ সরাসরি বাংলা থেকে ইতালীয় ভাষায় অনূদিত তার প্রথম বই। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি মারিনো রিগন। রবীন্দ্রনাথের প্রায় অর্ধশত বই অনুবাদ করেন তিনি। এর মধ্যে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪৭টি। একই সঙ্গে কোনো বিদেশি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের সর্বোচ্চ সংখ্যক বইয়ের অনুবাদক তিনি। মারিনোর মতে রবীন্দ্রনাথের কাব্যের মধ্যে ‘বলাকা’ এবং উপন্যাসের মধ্যে ‘গোরা’ শ্রেষ্ঠ।
১৯৬৪ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ বাংলা থেকে সরাসরি ইতালীয় ভাষায় প্রকাশিত মারিনো রিগনের প্রথম বই। পরে তা ইউরোপের আরও ক’য়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও লালনের ৩৫০টি গান, জসীমউদ্দীন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন কবির নির্বাচিত কবিতার সংকলন ও বাউল গানসহ অনেকগুলো বই তিনি ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ এবং শেলাবুনিয়ার ওপর মৌলিক বইও লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য অনুবাদের মধ্যে রয়েছে, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি, কড়ি ও কমল, সুঙ্গিল, সোনার তরী, নৈবেদ্য, চিত্রা, বলাকা, চৈতালী, লেখন, কণিকা, শান্তিনিকেতন উপদেশমালা (১ম, ২য় এবং ৩য় খণ্ড), কথা, চিনা, কল্পনা, শিশু, স্মরণ, শেষ লেখা, মহুয়া, শ্যামলী, নবজাতক, খ্রিষ্ট, রোগশয্যা, জন্মদিনে, আরোগ্য, কাহিনী, স্ফুলিঙ্গ, চিত্রাঙ্গদা, পূর্বদিকে (সংকলন) ইত্যাদি। জসীম উদ্দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ, সুচয়নী, সোজন বাদিয়ার ঘাট ও নির্বাচিত কবিতা। শরৎচন্দ্রের ‘পণ্ডিতমশাই’ ও ‘চন্দ্রনাথ’। সুকান্তর নির্বাচিত কবিতা সংকলন। তার অধিকাংশ বই প্রকাশিত হয়েছে ইতালির বিভিন্ন বিখ্যাত প্রকাশনী থেকে এবং পরে তা ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ডয়েচসহ ইউরোপের বেশ ক’টি প্রধান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।
কবি জসীমউদ্দীন এবং মারিনো রিগন ছিলেন হরিহর আত্মা। তারা দু’জন পরস্পরকে খুবই পছন্দ করতেন। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাদের মধ্যে পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তা গড়ায় পারিবারিক পর্যায়ে। কবির মৃত্যুর পরও তাদের সেই পারিবারিক সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। ১৯৭৩ সালে জসীমউদ্দীন মারিনোকে নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। সেদিন তারা টানা একঘণ্টা কথা বলেছিলেন। মারিনো বঙ্গবন্ধুকে গীতাঞ্জলির ১০৯ নম্বর কবিতাটি আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন- ছাড়িস নে, ধরে থাক এঁটে। / ওরে হবে তোর জয় / অন্ধকার যায় বুঝি কেটে / ওরে আর নেই ভয় / ওই দেখ পূর্বাশার ডালে / নিবিড় বনের অন্তরালে / শুকতারা হয়েছে উদয়…
১৯৭১ সাল, বাংলাদেশে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। এ সময় বাংলাদেশে যেসব বিদেশি ছিলেন তারা অনেকেই নিজ দেশে ফিরে যান। মারিনো রিগনকেও ইতালিতে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল তার দেশ ইতালি, ছুটি নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল তার ধর্মীয় মিশন। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। বাংলাদেশিদের বিপদ দেখে তিনি চলে যাননি নিরাপদ আশ্রয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় মারিনো রিগন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বানিয়ারচরে অবস্থান করেছেন। সেখানে ক্যাথলিক মিশনের প্রধান পুরোহিত হিসাবে কাজ করেছেন।
দিনের আলোতে মারিনো একজন পুরোহিত হলেও রাতের আঁধারে বনে যান একজন পুরোদস্তুর মুক্তিযোদ্ধা। বানিয়ারচরে তখন তার একটা ছোট চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল। রাত গভীর হলে আহত মুক্তিযোরা সেখানে আসতেন। মারিনো নিজে উপস্থিত থেকে তাদের চিকিৎসাসেবা দিতেন। খাবার এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। অবসর সময়ে লিখতেন একাত্তরের দিনলিপি। একাত্তরের ১৪ জুলাই মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বৃহত্তম গেরিলা বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন রামশীলের সম্মুখযুদ্ধে মুখমণ্ডলে গুলিবিদ্ধ হন। মারাত্মক আহত অবস্থায় হেমায়েত উদ্দিনকে তার সহযোদ্ধারা নিয়ে আসেন ফাদার মারিনোর চিকিৎসাকেন্দ্রে। মারিনো সারা রাত দাঁড়িয়ে থেকে হেমায়েত উদ্দিনকে চিকিৎসাসেবা দেন। বানিয়ারচর এলাকার কৃষক এবং মৎস্যজীবীদের নিয়ে মারিনো একটি সমিতি গড়ে তোলেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে তিনি ওই সমিতির সদস্যদের জন্য একটি বড় নৌকা তৈরি করে তার নাম দেন ‘সংগ্রামী বাংলা’। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় আরও একটা নৌকা বানান, নাম দেন ‘রক্তাক্ত বাংলা’। দেশ স্বাধীন হলে যে নৌকাটি বানান তার নাম রাখেন ‘স্বাধীন বাংলা’ এবং এরপর আরও একটা নৌকা বানান, নাম দেন ‘মুক্ত বাংলা’। উল্লেখ্য, যুদ্ধের সময় হেমায়েত উদ্দিন ভারতে না গিয়ে ৫৫৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্পূর্ণ স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দেন এবং পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যুদ্ধের পর তাকে বীর বিক্রম উপাধি দেয়া হয়। তার গেরিলা বাহিনী খুলনা, বরিশাল, মাদারিপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর এবং গোপালগঞ্জ অঞ্চলে যুদ্ধ করেছে।
২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত ‘স্মারক সংগ্রহ’ অনুষ্ঠানে ফাদার রিগন যুদ্ধের সময় তার লেখা ‘একাত্তরের দিনলিপি’ ও তার তোলা আলোকচিত্র মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দান করেন। ফাদার রিগনের স্মারকগুলো গ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি ও ‘ভেতরে বাইরে’ বইয়ের লেখক এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার। দিনলিপিতে মারিনো রিগন লেখেন, ১৯৭১ সালের ১২ জুন সকাল ৮টায় ২৩ জন মিলিটারির দুটি লঞ্চ জলিলপাড়ে ভিড়ল। তাদের সঙ্গে কয়েকজন বাঙালিও ছিল। সৈন্যরা সমস্ত বাজার আগুন দিয়ে পোড়াল। শুধু বাজার নয়, তারা গ্রামে ঢুকে কলিগ্রামের ৫০টি, জলিলপাড়ের ১৮টি এবং বনগ্রামের ২৬টি বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল। বাজারে একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করলো। কলিগ্রামের পাষাণের ছেলে রবিদাস কোনো মতে জীবন বাঁচালো। তারা কলিগ্রাম অক্সফোর্ড মিশনের সামুয়েল বিশ্বাসকেও আঘাত করলো। বনগ্রামে মিলিটারিরা ৪ জনকে হত্যা করে। শিশির, তন্ময়, উপেন দাস, বাবু মালাকার, নারায়ণ বাড়ৈ এবং আরো অনেককে আহত করল। বিকেলে তারা ধ্বংসযজ্ঞ শেষ করে ৬টি খাসি ও অনেক জিনিসপত্র নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করল। এই বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞের পর আমি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দেখতে গেলাম। কী করুণ সে আর্তনাদ! বাঁচার জন্য মানুষের কী আকুতি….!
শিক্ষা এবং সংস্কৃতি অনুরাগী মারিনো রিগন খুলনার সুন্দরবন এবং এর আশপাশের এলাকায় ছোট-বড় মোট ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে নামকরা স্কুল হলো সেন্ট পলস স্কুল। তিনি বহু দরিদ্র ছেলেমেয়ের লেখা-পড়ার খরচ জুগিয়েছেন নিয়মিত। গ্রামের মানুষকে ভালো চিকিৎসাসেবা দিতে গড়ে তুলেছেন হাসপাতাল। কৃষক মৎস্যজীবীদের জন্য সমবায় সমিতি গঠন করেছেন। সহায়-সম্বলহীন বাস্তুভিটাহারাদের জন্য আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেন। ফাদার মারিনো যেখানে গিয়েছেন সেখানেই গঠন করেছেন সাংস্কৃতিক দল। ১৯৫৪ সালে যখন মুজিবনগরের মেহেরপুর থেকে খুলনার মালগাজিতে আসেন সেই সময় গ্রামের মানুষদের নিয়ে গড়ে তোলেন যাত্রাদল। এরপর কীর্ত্তন নাট্যদলও গঠন করেছেন। তার গঠন করা যাত্রাদলের শিল্পীরা পরবর্তীতে দেশের বড় বড় যাত্রাদলে যোগ দিয়ে অনেক খ্যাতি অর্জন করেছে। সেন্ট পল্স স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্যও তিনি নাচ, গান, নাটক এবং হাতের কাজ শিক্ষার ব্যবস্থা রেখেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে মারিনো বাংলাদেশের নাটক এবং যাত্রা খুবই পছন্দ করেন। সেই প্রথম যখন মেহেরপুরের ভবেরপাড়ায় এসেছেন তখনই প্রথম গ্রাম্য শিল্পীদের যাত্রাপালা দেখেন। এরপর থেকে যত দিন তিনি বাংলাদেশে থেকেছেন কখনোই নিজেকে এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। কোনো কাজে ঢাকায় গেলেই তিনি শিল্পকলা একাডেমীতে যেতেন নাটক দেখতে। কলকাতায় গিয়েও তিনি মঞ্চনাটক দেখেছেন। সময় পেলেই টেলিভিশনে বাংলাদেশের নাটক দেখতেন। গ্রামের দরিদ্র নারীদের জন্য তিনি ১৯৮২ সালে একটি সেলাই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে প্রায় শতাধিক নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য নকশিকাঁথা সেলাই করেন। তাদের সুচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে ফুটে ওঠে গ্রাম-বাংলার অনেক গল্পকথা। ফাদার রিগনের প্রতিষ্ঠিত সেলাই কেন্দ্রের নকশিকাঁথা ছড়িয়ে যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতেও তৃপ্ত হন না তিনি। ১৯৮৬ সালে তার জন্মস্থান ইতালির ভিচেনছায় প্রথম নকশিকাঁথার প্রদর্শনী করেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে রাজধানী রোম, বাণিজ্যিক শহর মিলানো, জলকন্যা ভেনিসসহ ইতালির বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশের নকশিকাঁথার প্রদর্শনী করেন এবং ইতালীয়দের কাছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য তুলে ধরেন। ইতালীয়দের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন আমাদের লোকঐতিহ্যের স্মারক নকশিকাঁথা। এ কাজে রিগনকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন তার ভাই-বোনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা।
বাংলায় বিমুগ্ধ মারিনো রিগন তার দেশ ইতালিতে শুধু নকশিকাঁথা পাঠিয়েই থেমে থাকেননি, তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির বিশ্ব বিকাশের চেতনা থেকে ১৯৮৬ সালে ইতালির ব্লোনিয়া শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শিশু সংগীত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের শিশুশিল্পী অরিন হককে পাঠান। অরিন সেখানে রবীন্দ্রনাথের ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’ পরিবেশন করে প্রথম স্থান অধিকার করে নেয়। ইতালীয়রা পরিচিত হয় বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে। ১৯৮৭ তে মিলানো, ভেনিস, ভিসেনছা, ফিরেন্সেসহ বেশ ক’টি শহরে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ অবলম্বনে নৃত্যনাট্য প্রদর্শিত হয় মারিনোর উদ্যোগে। এছাড়াও নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপার নেতৃত্বে দুইবার বাংলাদেশের শিল্পীরা ইতালির বিভিন্ন শহরে নৃত্য পরিবেশন করেন। উল্লেখ্য, ইতালিতে অভিবাসী বাংলাদেশিদের কমিউনিটি মূলত গড়ে ওঠে ৯০-এর দশকে। সুতরাং বলা যায় ইতালিতে বাংলাদেশি কমিউনিটি গড়ে ওঠার আগেই ইতালীয়দের কাছে বাংলাদেশের এবং বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিচয় করিয়ে দেন ফাদার মারিনো রিগন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তার প্রথম বই।
রবীন্দ্রনাথে আকণ্ঠ নিমজ্জিত মারিনো তার ভাই-বোন এবং স্বজনদের নিয়ে ১৯৯০ সালে ইতালিতে প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্র অধ্যয়নকেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ চর্চা এবং বিকাশই মূলত ওই কেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য। ১৯৯১ সাল থেকে রবীন্দ্রকেন্দ্রের উদ্যোগে প্রতিবছর ইতালিতে রবীন্দ্র উৎসব পালিত হয়। ওই কেন্দ্রের উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টায় মারিনোর জন্মস্থান ভিল্লাভেরলার একটি সড়কের নাম পরিবর্তন করে রবীন্দ্রনাথের নামে রাখা হয়েছে, ‘ভিয়া তাগোরে’। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ইতালীয় ভাষায় ‘তাগোরে’ বলা হয়।
ফাদার মারিনো রিগনের ভাই-বোনসহ অনেক আত্মীয়স্বজন বাংলাদেশে এসেছেন। তারাও বাংলাদেশের আতিথেয়তা এবং বাংলা সংস্কৃতির প্রেমে পড়েছেন। তাদের কেউ কেউ বাংলা সংস্কৃতিতে এতটাই মুগ্ধ হয়েছেন যে তারা বহুবার বাংলাদেশে এসেছেন। বারবার ফিরে এসেছেন শেলা নদীর পাড়ে। মারিনোর এক ভাইর মেয়ে মনিকা এবং এক বোনের ছেলে এনরিকো বিয়ে করেছেন বাংলাদেশি রীতিতে। মনিকা তার বন্ধু মিকেয়েলেকে বিয়ে করেন ২০১২ সালে এবং এনরিকো তার বান্ধবী মিরকাকে বিয়ে করেন ২০০০ সালে। তারা শেলাবুনিয়ায় আসেন এবং বাংলাদেশের লোকরীতিতে হলুদ মেখে, লুঙ্গি, শাড়ি পরে, মাইক বাজিয়ে বিয়ে করেন।
ফাদার মারিনো রিগন যেমন বাংলাকে ভালোবেসেছেন তেমনি বাংলার মানুষও তাকে ভালোবেসেছে উদারভাবে। ক্যাথলিক ধর্ম প্রচারক মারিনো বাংলাদেশের যে প্রান্তে গিয়েছেন সেখানের মানুষই তাকে হৃদয় নিংড়ানো আতিথেয়তা দিয়ে গ্রহণ করেছে। শেলাবুনিয়া ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফাদার রিগন শিক্ষা এবং উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। প্রতিবছর ফাদারের জন্মদিনে ওই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মোংলায় তিন দিনের রিগন মেলা করা হয়। সেখানে বাংলার ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, কুটির শিল্প, নকশিকাঁথা, রিগনের বই, আলোকচিত্রসহ বিভিন্ন জিনিসের প্রদর্শনী করা হয়। এছাড়াও মেলায় নৃত্য, গান, যাত্রা, কীর্ত্তন, কবিতা, পদাবলিসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ মেলায় সংসদ সদস্য, সচিব, মেয়রসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সামাজিক প্রতিনিধি এবং প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ফাদার মারিনো রিগনকে ২০০৯ সালে সম্মানসূচক বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে এবং ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করে। এছাড়াও বহু পুরস্কার, সম্মাননা, সংবর্ধনা ও মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ফাদার মারিনো রিগন খুব আনন্দের সঙ্গে উল্লেখ করেন ১৯৮২ সালের ১৪ মার্চের কথা। ওইদিন রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার তার হাতে তুলে দেন কবি জসীমউদ্দীন একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার।
ফাদার মারিনোকে নিয়ে ইতালীয়দেরও গর্বের কোনো শেষ নেই। সাহিত্য এবং মানবকল্যাণে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য ইতালি থেকেও তিনি পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ১৯৯৪ সালে ভেনিসের লায়ন্স ক্লাব পুরস্কার, একই বছরে ইতালির রকো দি অরো পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে ড. রবার্ট ডব্লিউ পিয়াসের ম্যান অব দ্যা ইয়ার পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে ভিচেনছার অলিম্পিক একাডেমি পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে ভিচেনছার বিশেষ নাগরিক সম্মাননা, ২০০২ সালে মারিয়েলে ভেস্ত্রে পুরস্কার, ২০০৩ সালে খ্রিষ্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্রের সম্মাননা পদক এবং ২০১২ সালে সাবেরিয়ানি ফাদার্স মিশনের বিশেষ সংবর্ধনা এবং সম্মাননা।
‘ফাদার মারিনো রিগন: ভেনিস টু সুন্দরবন’ শিরনামে মারিনোর কর্মমুখর এবং বহুমাত্রিক জীবন নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয় ২০১২ সালে। এটি নির্মাণ করেন আবৃত্তি শিল্পী রবিশঙ্কর মৈত্রী এবং গবেষণায় ছিলেন পুঁথিশিল্পী কাব্য কামরুল। এছাড়াও ২০১০ সালে ফাদারের বাংলাদেশের জীবনের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে ইতালিয় একটি সংস্থা।
আমরা ফাদার মারিনোকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাংলাদেশের বিশেষ কোনো খাবার খেতে কি ইচ্ছা করে?
তিনি ঝটপট উত্তর দেন, পোলাও আমি অনেক পছন্দ করি।
সৈয়দ কামরুল বলেন, আপনি খেতে চাইলে একদিন বাসা থেকে পোলাও রান্না করে নিয়ে আসতে পারি আপনার জন্য।
মারিনোর বয়সী চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই তার চোখে মুখে কৃতজ্ঞতার আলো। তিনি মুহূর্তের জন্য ফিরে যান শেলাবুনিয়ায়। বাংলার ঐতিহ্যবাহী আতিথিয়তার গন্ধ পান। একটু সময় নিয়ে খুব ধীর কণ্ঠে বলেন, আপনারা আমার জন্য খাবার আনলে মিশনের কর্তৃপক্ষ হয়তো পছন্দ করবে না।
৫ ফেব্রুয়ারি ফাদার মারিনো রিগনের জন্মদিন। আমরা এই বহুমাত্রিক গুণী মানুষটির সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© All rights reserved © 2020 SwadeshNews24
Site Customized By NewsTech.Com