মাওলানা মুহাম্মদ আলমগীর: একটি আদর্শ রাষ্ট্র, সমাজ ও সুন্দর পরিবার গঠন করতে হলে জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার আপনার আমার সকলের সন্তানদেরকে আদর্শ মানুষ সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। আর এক্ষেত্রে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা আমাদের মেনে চলা অত্যন্ত জরুরী। ইসলাম অন্য সকলের মত সন্তানকে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার দিয়েছে যা প্রতিটি সন্তানের সু নাগরিক হিসাবে তৈরী হতে সহায়ক। পারিবারিক দাম্পত্য জীবনের মুল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সন্তান জন্মদান। মহান আল্লাহ বলেন তোমরা স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করো আল্লাহ তোমাদের জন্য যা কিছু নির্ধারিত করে দিয়েছেন তাই তোমরা সন্ধান করো। (সুরা বাকারা-১৮৭) প্রকৃতপক্ষে সন্তান-সন্ততি হচ্ছে আল্লাহতালার নিয়ামত, তার বিশেষ অনুগ্রহ দান। আল্লাহ বলেন ধন মাল ও সন্তান সন্ততি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য, সুখ, শান্তির উপাদান। সুরা কাহাফ ৪৬ আয়াত এই সন্তান-সন্ততিদের সুনাগরিক হিসাবে তৈরী করতে সন্তানের অধিকার যেমনন আছে তেমন আছে পিতা-মাতার দায়িত্ব। অধিকার সমুহ:
১। বেচে থাকার অধিকার: ইসলাম পূর্ব জাহেলী সমাজে ছেলে সন্তান হলে বাচিয়ে রাখতো আর মেয়ে সন্তান হলে তাকে জীবন্ত কবরস্থ করতো। আমরা তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার ধারক বাহক দাবী করলে ও আধুনিক ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে সন্তান হত্যা করছি। মহান আল্লাহ বলেন তোমরা দারিদ্রতার ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করোনা। তাদের এবং তোমাদের রিযিক আমিই ব্যবস্থা করি। (সুরা ইসরা: আয়াত-৩২)
২। কানে আজান দেওয়া: সন্তান জন্মের পর পরেই তার কানে তাওহিদের আওয়াজ পৌছে দিতে কানে আজান দেওয়া। সাহাবী হযরত আবু রাকি বর্ণনা করেন, আমি দেখলাম যে হযরত ফাতেমা (রা) যখন হাসানকে জন্ম দিলেন তখন রাসুল (সঃ) হাসানের কানে নামাজের আজানের মত আজান দিলেন। বর্তমান হাসপাতাল, ক্লিনিক বা মাতৃসদনে অনেকেই এ মুল্যবান সুন্নাত পালনে অবহেলা করছেন। পিতা বা অভিভাবকদের এ বিষয় খুবই সচেতন হওয়া দরকার। এছাড়া ক্লিনিক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে সঠিক ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৩। তাহনীক করা: আমাদের দেশে সন্তানদের ভাত মুখে দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত আছে রেওয়াজটি ইসলামী নয়। তবে হাদিস শরীফের কাছাকাছি একটি রীতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আরবীতে একে তাহনীক বলা হয়। নবজাতক শিশুকে জন্মের কয়েক দিনের মধ্যে কোন ভাল বুজুর্গের নিকট নিয়ে তার মুখের মধ্যে খেজুর মধু বা অনুরূপ কোন খাদ্য দ্রব্য খাওয়ানোকে তাহনীক বলা হয়। এটি খুবই বরকত পূর্ণ কাজ এবং রাসুল (স:) এর সুন্নত।
৪। মাথা মুন্ডন করা: হাদিস শরীফে সন্তান জন্মের ৭ম দিনে ৭টি কাজ করার কথা বলা হয়েছে তার অন্যতম হলো নবজাতকের শরীরের ময়লা পরিস্কার করা, চুল কাটা, চুলের ওযনের সম পরিমান রোপা দান করা। বর্তমান রূপার পরিবর্তে চুলের সম পরিমান টাকা পয়সা দান করলেই হবে।
৫। আকীকাহ: রাসুল (স:) বলেন প্রত্যেক সদ্যজাত শিশু তার আকীকার সাথে বন্দী থাকে। জন্মের ৭ম দিনে তার পক্ষ থেকে আকীকাহ পশু যবেহ করা হবে তার নাম রাখা হবে এবং তার মাথা কামানো হবে। (তিরমিজী)
রাসুল (স:) আরো বলেন শিশু জন্মের পর আকীকাহ করা আবশ্যক। অতএব তার পক্ষ থেকে তোমরা রক্ত প্রবাহিত কর (অর্থ) পশু যবেহ কর। এর তার থেকে কষ্ট দুর করে দাও (বোখারী)
আকীকার পশুর সংখ্যা: আকীকাহ ইসলাম পূর্ব যুগে ও প্রচলন ছিল। যদিও তার ধরন ছিল ভিন্ন। এখন ইয়াহুদীদের মধ্যে আকীকাহ প্রচলন আছে বলে জানা যায়। তবে তারা পুত্র সন্তানের জন্য আকীকাহ করলেও কন্যা সন্তানের আকীকাহ করেনা। ইসলাম তাদের প্রথাকে রহিত করে পুত্র সন্তানের জন্য দুটি ছাগল ও কন্যা সন্তানের জন্য একটি ছাগল দিয়ে আকীকাহ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুল (স:) বলেন তোমরা পুত্র সন্তানের জন্য দুইটি ছাগল এবং কন্যা সন্তানের জন্য একটি ছাগল আকীকাহ করো। (আবু দাউদ) অবশ্য মেষ দিয়ে আকীকাহ দিলে সমান সমান করা যায়। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (স:) হাসান ও হোসাইনের (রা:) পক্ষ থেকে একটি করে মেষ আকীকাহ করেছেন। (আবু দাউদ) আকীকার পশু ও দিন: সকল সহী হাদিস থেকে প্রমাণিত আছে যে সন্তান জন্মের ৭ম দিনে আকীকাহ দিতে হবে। এটি সুন্নাহ। তবে মুস্তাদারাক হাকেমের বর্ণনামতে ৭ম দিন দিতে না পারলে ১৪ দিন বা ২১ দিন বর্নিত রয়েছে তবে হাদিসটি অনেক মুহাদ্দিস যয়ীফ বলে মত দিয়েছেন। তবে এ কথা সত্য যে যথা সময় আকীকাহ না দিয়ে পরে আদায় করলে তা সুন্নাত হবেনা। মুস্তাহাব আমল হবে। আমাদের সাধ্য অনুযায়ী জন্মের ৭ম দিনে আকীকাহ আদায় করতে হবে। আকীকার পশুর মধ্যে রয়েছে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এবং মেষ দিয়ে ও আকীকাহ দেওয়া যায় এছাড়া গরু কিংবা উট দিয়ে আকীকাহ না দেওয়াই ভাল। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে আবু বকর (র:) বংশের এক মহিলা মানত করল যে আবদু রহমানের স্ত্রীর কোন সন্তান হলে আমরা আকীকার জন্য একটি উট যবেহ করবো। তখন হযরত আয়শা (রা:) একথা শুনে বললেন, এটা হতে পারেনা। বরং সন্নাত হলো ছেলে সন্তানের জন্য দুটি সম বয়স্ক ছাগল এবং মেয়ে
সন্তানের জন্য একটি ছাগল আকীকাহ করা। সুতরাং ছাগল, ভেড়া ব্যতীত গরু বা উট দিয়ে আকীকাহ দেওয়া হলে আকীকার সুন্নাত আদায় হবেনা।
৬। নাম রাখা: সন্তানের প্রতি আমাদের আরো একটি দায়িত্ব হলো একটি সুন্দর ভাল অর্থবোধক নাম রাখা। রাসুল (স)ঃ বলেছেন তোমরা সন্তানের জন্মের ৭ম দিনে একটি অর্থ বোধক নাম রাখ কেননা তোমাদেরকে কিয়ামতের দিন সন্তানের নাম ধরে ডাকা হবে। শিশুর নাম রাখার সময় সুন্দর সঠিক অর্থবহ নাম বাছাই করতে হবে। বিশেষ করে রাসুল (স)ঃ পছন্দনীয় নাম হলো আল্লাহর নামে দাসত্ব বোধক নাম যেমন আদুল্লাহ,আবদু রহমান এ জাতের নাম গুলো প্রথম পছন্দ পরে নবীদের নাম এর পরে সাহাবায়ে কেরামসহ নেককার ব্যক্তিদের নামে নাম রাখা যায়। নামের অর্থ ভাল হয় এমন নাম রাখতে হবে। খারাপ অর্থের নাম ও নামের বিকৃতি করা বড় গুনাহের কাজ অথচ আমাদের সমাজে নাম বেশী বিকৃত করে।
৭। দুধ পান করা: জন্মের দিন থেকে শুরু করে পূর্ন দু বছর দুধ পান করানো মায়ের দায়িত্ব আর পিতার দায়িত্ব হলো মাতার জন্য এরূপ দুগ্ধ দানের ব্যবস্থা করা। মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর সাথে সাথে অন্যন্য খাদ্য গ্রহন অভ্যস্থ করতে হবে। যেন দু বছরের মধ্যে তাকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু বছর বুকের দুধ খাওয়াবে যে দুধ পান করানোর সময়টি পূর্ণ করতে চায়। তার পিতার দায়িত্ব হলো যথা বিধি তাদের ভরন পোষন করা। (সুরা বাকারা ২৩৩নং আয়াত)।
৮। খতনা করা : সন্তানের প্রতি পিতামাতার আরো একটি দায়িত্ব হলো তার খতনা করা। এটি হযরত ইব্রাহিম (আ:) থেকে শুরু করে সকল নবীদের গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। এবং অত্যন্ত স্বাস্থসম্মত ও বিজ্ঞান ভিত্তিক। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্নিত রাসুল (সঃ) বলেন তোমরা সন্তনের ৭ম দিনে নাম রাখ ও খতনা কর। ৭ম দিনে খতনা করানো উত্তম।তবে পরে খতনা করানো নিষিদ্ধ নয়।
৯। শিক্ষা দেয়া: (ক) সহী কুরআন, শরীয়তের ফরজ. ওয়াজিব ও হালাল হারাম এর জ্ঞান সহ পযার্প্ত পরিমান দ্বীনি ও আধুনিক জ্ঞান শিক্ষা দিতে হবে। ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমান নর নারী-পুরুষ সকলের উপর ফরজ করা হয়ছে। (খ) খেলাধুলা ও ব্যায়াম শিক্ষা দিতে হবে। রাসুল (সা:) বলেছেন শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দূর্বল মুমিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ও প্রিয়তর । ইসলাম চায় সন্তান ইমানের শক্তি। মনের শক্তি ও দেহের শক্তির সমন্বয় শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠুক। সন্তানের দৈহিক ও মানষিক বিকাশ ও শক্তি অর্জনের জন্য তাদের শরীর চর্চামুলক খেলাধুলা করাতে ইসলামে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। বিশেষত তীর নিক্ষেপ,ঘোড়ার পিঠে আরোহন. সাতার ইত্যাদি খেলাধুলা। হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্নিত রাসুল (সঃ) বলেন হাবশীগন লাঠি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে খেলা করছিলেন। হযরত উমর (রঃ)তাদেরকে আপত্তি করলে রাসুল(সঃ) বলেন উমর তুমি ওদের খেলতে দাও। এর পর তিনি ক্রীড়া রতদেরকে কলেন হে হাবশীগন তোমরা খেল। যে ইহুদী নাসারারা জানতে পারে যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে প্রশস্থতা আছে। আমি প্রশস্থ দ্বীনের হানিক সহ প্রেরিত হয়েছি। (মুসনাদ আহামদ) ইমানী মক্তি,ইলমী মক্তি, শারীরিক শক্তি, মনোবল ও সমৃদ্ধ আর্থিক শক্তি সহ এক মজবুত মানুষ তৈরী করাই পিতা মাতার দায়িত্ব। সাথে সাথে তাওহিদ ইমান ও আদব মাখলাক-চরিত্র শিক্ষাদিতে হবে। এবং ৭ বছর বয়স থেকে নামাজের আদেশ এবং ১০বছর বয়স থেকে সালাতের জন্য প্রহার করতে হবে। উত্তম আচারন ও উত্তম চরিত্র সন্তানের জন্য বড় সম্পদ। বর্তমান দুনিয়াতে ঘটা করে বিজাতীয় সাংস্কৃতির অনুকরনে জন্মদিনের অনুষ্ঠান করা হয়। অবশ্যই জন্মদিনের অনুষ্ঠান করা যায়। তবে তা বিজাতীয় সাংস্কৃতির পরিবর্তে বিশেষ করে গান বাজনা ও মোমবাতি জালানো বাদ দিয়ে সুন্দর অনুষ্ঠান করা যায়। জন্ম দিনের উপহার দিবে। লেখাপড়ার খুজ খবর নিবে আমল.আখলাক ও চরিত্র গঠন মুলক আলোচনা বা পরামর্শ দিবে। যেমন জন্মের ৭ম বার্ষিকী পালন করা হবে আর সে দিন রাসুল (স:) এর হাদিসটি শিক্ষা দেওয়া হবে যেটি রাসুল (স:) বলেছেন তোমাদের সন্তানদের ৭ বছর বয়সে সালাতের জন্য নির্দেশ দাও। এই নিয়মে জন্ম দিন পালন করা হলে তা অবশ্যই জায়জ। (হালাল হারামের বিধান)
লেখকঃ খতিব ও সেক্রেটারী জেলা ইমাম সমিতি।