চারদিকে মৃত্যুর ধুম আর জীবনের হাহাকার। ভয়াবহ ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের চারদিন পরও এমনটাই এখন নেপালের চিত্র। এরইমধ্যে মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। তবে এরই ফাঁকে উদ্ধারকারদের মনে আশার আলো জ্বালিয়ে ঘটেছে অলৌকিক ঘটনা। বিভিন্ন বিধ্বস্ত ভবন থেকে একের পর এক মরদেহ বের করতে করতে যখন উদ্ধারকারীরাও অবসন্ন হয়ে পড়েছেন ঠিক তখনই ধ্বংসস্তূপে জীবনের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়ে আবারও আশাবাদী হয়ে উঠেছেন তারা।
৮০ ঘন্টা ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকার পর মঙ্গলবার অলৌকিকভাবে এক নেপালি তরুণকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হন উদ্ধারকারীরা। কাঠমুন্ডুর একটি বিধ্বস্ত অ্যাপার্মেন্ট থেকে রিশি খানাল নামে ২৭ বছর বয়সী ওই তরুণকে উদ্ধার করা হয়। এর আগে মহারাজগঞ্জের বসুন্ধরা এলাকার একটি ৫ তলা ভবন থেকে ভূমিকম্পের ৫০ ঘন্টা পর সুনিতা সিতোলা নামের এক নারীকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পরপরই স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয় সুনিতাকে। বর্তমানে একটি স্কুলে স্বামী-সন্তানসহ আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। উদ্ধার হওয়ার পর সুনিতা বলেন, “মনে হচ্ছে নতুন এক দুনিয়া ফিরে পেলাম আমি।”
নিখোঁজদের জীবিত পাওয়ার আশায় অপেক্ষায় স্বজনরা
সুনিতার মতো অলৌকিকভাবে বেঁচে থাকার ভাগ্য হয়তো সবার কপালে নেই। প্রয়োজনীয় উদ্ধার তৎপরতা আর সরঞ্জামাদির অভাব এবং দুর্গম পথের কারণে অনেক ঘন্টা বেঁচে থাকার পরও শেষ পর্যন্ত হয়তো ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়েছে অনেককে। বিধ্বস্ত ভবনে আটকা পড়াদের মোবাইল থেকে স্বজনদের কাছে আসা এসএমএসই জানান দেয় সে কথা। এমনই একজন ভক্তপুরের বাসিন্দা দীনেশের ছেলে দশ বছরের রাজীব। শনিবার দুপুরে তিনতলা বাড়ির নীচে আটকে পড়ে রাজীব। শনিবারের ভূমিকম্প গোটা ভক্তপুরকে যেভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, কারও বেঁচে থাকার আশা প্রথমে ছেড়েই দিয়েছিলেন দীনেশ।
তবে হঠাৎ করে রোববার দুপুরের পর থেকে নেপালে আবারও মোবাইল পরিষেবা শুরু হবার পর ছেলে রাজীবের এসএমএস পান দীনেশ। লিখেছে, ভাল আছে। বাবা যেন তাঁকে এসে বাঁচায়। এর পর থেকে জনে জনে ছুটে গিয়েছেন দীনেশ। নিজেও চেষ্টা করেছেন ধ্বংসস্তূপ সরানোর। কিন্তু সাধ্য কী তার এত বিশাল স্তূপ ফুঁড়ে তুলে আনেন সন্তানকে! ধ্বংসাবশেষে নীচে আটকে পড়া রাজীবকে বাঁচাতে আসেনি কোনও উদ্ধারকারী বাহিনীও। আসার উপায়ও নেই। ভূমিকম্পের পর দুর্গম এলাকা ভক্তপুরী যেন আরও দুর্গম হয়ে পড়েছে।
মানবিক সহায়তার অভাবে ঘনীভূত হচ্ছে ক্ষোভ; শহর ছাড়ছেন কাঠমুন্ডুবাসী
একদিকে স্বজন হারানোর শোক, আরেকদিকে প্রাণের শঙ্কা কোনটাই কাটছে না নেপালের দুর্গত এলাকার মানুষের। চারদিন ধরে ত্রাণের অপেক্ষায় থেকেও পর্যাপ্ত খাবার ও মৌলিক প্রয়োজনীয় উপকরণ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন খোলা আকাশে রাত কাটানোদের অনেকে। সরকারিভাবে সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগও করেছেন তারা। প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে কাঠমুন্ডু ছাড়তে শুরু করেছেন আশ্রয়হারা মানুষেরা। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি; এমন এলাকাগুলোর উদ্দেশে ছুটে চলেছেন তারা। এরজন্য কেউ ভীড় করছেন বিমানবন্দরে, আবার কেউবা বাসে করে রওনা দিচ্ছেন গন্তব্যে।তবে কতৃপক্ষের দাবি, পুনঃকম্পনের কারণে বার বার বিমানবন্দর বন্দর হয়ে যাওয়ায় ঠিক মতো ত্রাণবাহী বিমান থেকে ত্রাণ নামানো যাচ্ছে না। এছাড়া লোকবলের অভাব রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে উদ্ধার তৎপরতায় চলছে প্রাণান্ত চেষ্টা; পৌঁছেছে ত্রাণ
চারদিনের চেষ্টার পর অবশেষে ত্রাণ পৌঁছাতে শুরু করেছে নেপালের ভূমিকম্পপ্রবণ দুর্গত এলাকাগুলোতে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের কাছাকাছি এলাকাগুলো এতটাই দুর্গম আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও অবতরণ করতে পারছিল না হেলিকপ্টারগুলো। তাই উপর থেকেই ফেলা হচ্ছে ত্রাণ। আর সে ত্রাণের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন দুর্গতরা। প্রত্যন্ত অঞ্চল গুর্খার এক স্থানীয় এএফপিকে জানান, ভূমিকম্পের পর থেকে কোন গেল কয়েকদিন ধরে কোন খাবারই পাচ্ছিলেন না তারা। বললেন, এলাকার সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। কেবল গুর্খাই নয় লাপার্ক এলাকার ১৭শটি ঘর-বাড়ির ১৬শটিই নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে কতৃপক্ষ। তবে কোন অঞ্চল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা এখনও নিরূপণ করতে পারেনি তারা।
নেপালে চলছে তিন দিনের জাতীয় শোক
৮১ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের এ ভূমিকম্পের ভয়াবহতা আর নিহতদের স্মরণে তিন দিনের জাতীয় শোক পালন করছে নেপাল। প্রাণহানির সংখ্যা ১০ হাজারে পৌঁছাতে পারে বলে এরইমধ্যে আশঙ্কা জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা। আর জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী ভূমিকম্পের কারণে নেপালের ৮০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর গুরুতর খাদ্য সঙ্কটে পড়বে ১৪ লাখ মানুষ।