মিরাজ এর পরিচয় মিরাজ মূলতঃ দুই ভাগে বিভক্ত প্রথমাংশ হলো ইসরা এবং দ্বিতিয়াংশ হলো মিরাজ। অসিরা শব্দটি আরবী। এর উৎপত্তি হলো ইসরা থেকে অভিধানিক অর্থ হলো রাতে নিয়ে যাওয়া, রাতে ভ্রমণ করা বা রাতে চলা ইত্যাদি পরিভাষায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদে আক্সা পর্যন্ত (সফর) ভ্রমণকে ইসরা বলে।
দ্বিতীয়াংশ মিরাজঃ মিরাজ শব্দটি আরবী উরজুন থেকে এসেছে যার দ্বারা আরোহন বুঝায়। অভিধানে অর্থ হলো, সিঁড়ি সোপান, ধাপ বা উর্ধ্বগম ইত্যাদি। পরিভাষায় মসজিদে আক্সা হইতে সাত-আকাশ, সিদরাতুল মুনাতাহা ইত্যাদি ভ্রমণকে মিরাজ বলে। শরই অর্থ মসজিদে আক্সা থেকে সাত আকাশ সহ সিদরাতুল মুনতাহা পাড়ি দিয়ে আরশ মুয়াল্লাহ আল্লাহর দরবারে রাসুল (সঃ) এর ভ্রমণকে মিরাজ বলে।
মিরাজ কেন প্রয়োজনঃ মহান আল্লাহ পাক তার নবী-রাসুলগণকে নবুওয়াতের গুরু-দায়িত্ব পালনের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য যে ট্রেনিং দেওয়ার উদ্যেশ্যে তার রহমতের সর্বাধিক কাছে ডেকে নিতেন এবং ঐ ডাকে হাজির হওয়াকে মিরাজ বলা হয়। মিরাজ প্রত্যেক নবী রাসুলগণের হয়েছিল। কিন্তু সবার মিরাজ একই স্থান বা এক ধরনের হয়নি। যেমন হযরত আদম (আঃ) এর মিরাজ হয়েছিল জন্নাতে, হযরত মুসা (আঃ) এর মিরাজ হয়েছে তুর পাহাড়ে, ইব্রাহিম (আঃ) এর মিরাজ হয়েছে মরুভূমির মধ্যে আর আমাদের নবী (সঃ) এর মিরাজ একবারে সাত আসমানের উপর আরশ আজীমে। আমাদের নবী (সঃ) যেহেতু শেষ নবীও বিশ্ব নবী ছিলেন তাই তার দায়িত্ব ও ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তার ট্রেনিংও ছিল সর্বাধিক দায়ী। তাই তা ছিল বিরাট লম্বা কোর্সেরও দীর্ঘ সময়ের আর তার স্থান ছিল খোদ রাব্বুল আলামীনের রাজধানীতে। মিরাজ এর আরো কয়েকটি মৌলিক কারণ ছিল। মহানবী (সঃ) জন্মের পূর্বেই পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। জন্মের ৬ বছর পরে মাতা আমেনা ইন্তেকালের পর তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের কাছে লালিত-পালিত হন। মহানবী (সঃ) এর বয়স যখন ৮ বছর তখন দাদা ও মারা যান। এরপর তিনি চাচা আবু তালিবের কাছে লালিত-পালিত হন। যুবক হলে মহানবী (সঃ) এর সাথে খতিজার বিয়ে হয় এবং শুরু হয় পারিবারিক জীবন। চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেন। তিন বছর গোপন দাওয়াত এরপর প্রকাশ্যে ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের কাজ দ্রুতগতিতে অগ্রসর হওয়াতে কাফের মুশরিকদের মাথা ব্যাথা বেড়ে যায়। নবুওয়াতের ১১ তম বছর রাসুল (সঃ) এর ৫১ বছর বয়সে ইসলামের দুশমনরা নবী করিম (সঃ) এবং তাঁর সাহাবীদের উপর নির্যাতন ও নিপিড়নের ষ্টীম রোলার চালায়। এই কঠিন সময়ে রাসুল(সাঃ) এর ঢাল ছিলেন চাচা আবু তালিব। তিনি নিজ ক্ষমতার প্রভাবে কাফিরদের অত্যাচার নির্যাতন হতে মহানবী (সঃ) কে রক্ষা করতেন। ঘরের ভেতর হজরত খাদিজা (রাঃ) মহানবীকে শান্তনা এবং কৌশলে পরামর্শ দিয়ে দুঃখ দূর করার জন্য চেষ্টা করতেন। মহান আল্লাহর কি ইচ্ছা এ বছর সামান্য ব্যবধানে আবু তালিব ও খদিজা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। এদের মৃত্যুতে রাসুল (সাঃ) হতাশ হয়ে ভেঙ্গে পড়েন। ভাঙ্গা হৃদয়ের বেদনাগুলো দূর করার জন্য তখন আল্লাহ মহানবীকে তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে নিয়ে আসেন। রাসুল (সাঃ) এর নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বছর ৫৩ বছর বয়সে মদিনায় হিজরত করে একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ কল্যাণময় সমাজ গঠন করবেন। সেই সমাজ ব্যবস্থার মূলনীতি কি হবে এবং এলাকাটি কোথায় হবে তা স্বচক্ষে দেখবার জন্য মিরাজ এ নিয়ে যান এবং আল্লাহতালার কিছু নিদর্শন বিশেষ করে জান্নাতবাসীদের পুরস্কার ও জাহান্নামে জাহান্নামীদের শাস্তির করুণ চিত্রগুলো স্বচক্ষে দেখানোই মিরাজের অন্যতম উদ্দেশ্য। এছাড়াও হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আঃ) পর্যন্ত সকল নবী রাসুলদের সাথে পরিচয় মোলাকাত, ঐতিহাসিক স্থানসমূহ এবং আরো কতিপয় আল্লাহর কুদরতী নিদর্শন তাকে দেখানো হয়।
মিরাজ কখন কিভাবে শুরু হয়। নবুওয়াতের দ্বাদশ বছর রাসুল (সাঃ) এর ৫২ বছর বয়সে হিজরতের কয়েক মাস আগে ২৭ রজব বুধবার রাত্রে মিরাজ হয়েছিল। সেদিন তিনি হযরত উম্মে হানির বাড়ীতে নিদ্রামগ্ন ছিলেন। এমন সময় হযরত জিব্রাইল (আঃ) ও হযরত মিকাইল (আঃ) এসে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে জম জম কূপের পার্শ্বে নিয়ে যান। সেখানে সিনা চাক করা হয়। জমজমের পানি দ্বারা ভিতরের অঙ্গগুলি ধুয়ে পরে তা জুড়ে দেওয়া হয়। অতঃপর বোরাকে সওয়ার হয়ে তিনি মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফর করেন। পথিমধ্যে মদিনায়, তুর পাহাড়ে ও বায়তে লাহাম (হযরত ঈসা আঃ এর জন্মস্থান) এই তিন জায়গায় জিব্রাইল (আঃ) পরামর্শে সালাত আদায় করেন। পরে বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে সমস্ত নবীদের ইমাম হয়ে দুই রাকাত সালাত আদায় করেন। অতঃপর বোরাকে সওয়ার হয়ে ঊর্দ্ধলোকে গমন করেন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে বোরাক ছাড়াও নিতে পারতেন কিন্তু তা না নিয়ে বোরাক নেওয়ার অর্থ হলো হুজুর (সঃ) কে অতিরিক্ত সম্মান দেওয়া।
যেমন কাউকে এমনিভাবে ডেকে পাঠাই আবার সম্মানিত লোক হলে তার জন্য গাড়ীও পাঠাই। আল্লাহর নবী যেহেতু আল্লাহর সর্বাপেক্ষা প্রিয় নবী তাই তার সম্মানার্থে বাহন হিসেবে বোরাক পাঠিয়েছিলেন। তাতে করে তিনি পৌঁছে গেলেন আল্লাহর রহমতের অতি নিকটে। যাবার পথে প্রথম আসমানে দেখা হলো হযরত আমদ (আঃ) এর সাথে অতঃপর ২য় আসমানে দেখা হলো হযরত ইসা (আঃ) এর সাথে, ৩য় আসমানে হযরত ইউসুফ (আঃ) এর সাথে, ৪র্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর সাথে, ৫ম আসমানে হযরত হারুন (আঃ) এর সাথে, ৬ষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আঃ) এর সাথে, ৭ম আসমানে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সাথে সাক্ষাত হয। সাত আসমানে কাবার সোজা উপরে সাত আসমানের উপরে যেখানে বায়তুল মামুর অবস্থিত সেখানে পৌঁছে যান। সেখানে অগনিত ফেরেস্তা দেখেন যার সীমা সংখ্যা নেই। তিনি দেখলেন বায়তুল মামুরে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতার একটা করে নতুন দল এসে সে ঘরকে তাওয়াফ করছে। কোন ফেরেশতা ২য় বার তাওয়াফ করার সুযোগ পায় না। সেখানে তিনি দেখলেন যে, আল্লাহর রাজত্বের পরিসীমা কত দূর দূরান্ত নিয়ে পরিব্যাপ্ত। পৃথিবীর লোক সংখ্যার চাইতেও কোটি কোটি গুণ বেশী ফেরেশতারা সেখানে সৃষ্টি করে রেখেছেন। সে আর এক স্বর্গীয় জগত। এরপর নবী করিম (সাঃ) এমন এক জগতে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে শুধু আল্লাহর নুরের তজ্জল্লী দ্বারা পরিব্যাপ্ত ছিল। যার দিকে চোখ মেলে চেয়ে দেখতে গেলে মানুষ গলে পানি হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ নবী করিম তা দেখতে পেলেন। তাই আল্লাহ বলেন ‘মাযাগল বাছারুগুওয়ামা তগা’- অর্থÑ‘তা দেখার সময় নবী (সঃ) এর দৃষ্টিতে বক্রতা আসেনি এবং চোখ ঝলসে যায়নি’। অতঃপর আল্লাহর সাথে রাসুল (সাঃ) এর কথা শুরু হয় এবং দীর্ঘ আলোচনার পর জন্নাতের বিভিন্ন ভাল কাজের পুরস্কার এবং জাহান্নামে অপরাধীদের শাস্তি কি হবে তা সহ মহান আল্লাহর অসংখ্য কুদরতী নিদর্শন দেখানোর পর উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত সালাত এবং সমৃদ্ধ ও শান্তিময় সমাজ গঠনের ১৪ দফা মূলনীতি নিয়ে জমিনে ফিরে আসেন।
শান্তি প্রতিষ্ঠার ১৪ দফা :
১। আল্লাহর আইনের আনুগত্য করা। মানব রচিত মতবাদ দিয়ে মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা সুদুর পরাহত। তাই মানুষের সামগ্রিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।
২। পারিবারিক জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলার জন্য পিতা-মাতার সাথে ভাল আচরণ করা।
৩। সামাজিক বন্ধন মজবুত করার জন্য আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাল আচরণ করা, তাদের হক এবং মিসকীন ও পথিক (মুসাফির) দের হক আদায় করা।
৪। অপচয় না করা। আল্লাহ বলেন তোমরা অপচয় করো না। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আমাদের জীবনে প্রয়োজনীয় খরচ এবং আত্মীয় স্বজনের ফকির-মিসকীনের হক আদায় না করে বিভিন্ন খাতে প্রচুর টাকা অপচয় করি।
৫। আয়-ব্যয় ভারসাম্য রাখতে হবে। ভারসাম্যহীন জীবন মানুষের জীবনে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে তাই আয় এবং ব্যয়ের সাথে সংগতি রেখে খরচ করতে হবে। বেহিসাবী খরচ যেমন করা যাবে না তেমনি আবার কৃপন ও হওয়া যাবে না।
৬। রিযিক বন্টনের ব্যাপারে আল্লাহর যে নীতি কাউকে বেশী আবার কাউকে কম দিয়েছেন। তা মেনে নেওয়া। এ নীতি অত্যন্ত যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক এবং এ নীতি ধনী গরীব সকলের জন্য কল্যাণকর।
৭। নিজ সন্তান হত্যা না করা। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা গরীব হয়ে যাওয়ার ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। তাদের ও তোমাদের রিযিক আমি দেবো’। খাওয়া-পরার ভয়ে নিজ সন্তানকে হত্যা করা বড় ধরনের অপরাধ। আমাদের উচিত সন্তানদের বেঁচে থাকার অধিকার দিয়ে তাদেরকে সুশিক্ষিত করে সম্পদে পরিণত করা।
৮। জ্বেনা ব্যাভিচার ও অশ্লীলতা রোধ করা। জ্বেনা ব্যাভিচার ও অশ্লীলতা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জন্য এক ভয়ংকর মহামারী। অশ্লীলতার কারণে নৈতিক ও চরিত্রহীন যে সমাজ গঠিত হয় তা জাতির জন্য অভিশাপ।
৯। বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা যাবে না। আল্লাহ বলেন- ‘জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তোমরা এই আদেশ মেনে চলবে যে কাউকে হত্যা করবে না’। কারণ মানুষের জীবন আল্লাহর নিকট অতি পবিত্র। তাই মানুষ হত্যা তিনি হারাম করেছেন। এ আদেশের মধ্যে গুপ্ত হত্যা, বিনা বিচারে হত্যাসহ সকল প্রকার খুন, গুম ও অপহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
১০। ইয়াতিমের সম্পদ সংরক্ষণ করা। মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা কখন এতিমের মাল স্পর্শ করো না’। কিন্তু এতিম যতক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞন বুদ্ধি সম্পন্ন হওয়ার মত বয়সে না পৌঁছে ততদিন পর্যন্ত তার সম্পত্তি দেখাশুনা করা উত্তম।
১১। ওয়াদা, চুক্তি ও অংগীকার পালন করা, ওয়াদা বা চুক্তি বা ব্যক্তিগত হোক বা রাষ্ট্রীয় অথবা আন্তর্জাতিক যে পর্যায়ের হোক যে কোন চুক্তি তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
১২। ইনসাফভিত্তিক বণ্টন ব্যবস্থা। বর্তমান অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থায় ইনসাফভিত্তিক বিলি বন্টন না থাকার কারণে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। একদল লুটেরা ও আরেক দল বি ত থেকেই যাচ্ছে।
১৩। অনুমানভিত্তিক কোন কাজ করবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের উচিত মনগড়া অনুমান নির্ভর না হয়ে শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি ও চিন্তা শক্তিসহ প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলে বিপদগামী বা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
১৪। অহংকার পরিহার করা। আল্লাহ বলেন- তোমরা জমিনের উপর দিয়ে কখনও গর্ব করে চলাফিরা করো না। তোমাদের গর্ব, অহংকার যমীন ভাঙতে পারবে না এবং পাহাড়ের সমান ও উঁচু হতে পারবে না। অহংকার আল্লাহর চাদর এটি শুধু তাঁর জন্য। আল্লাহর বান্দার জন্য অহংকার শোভা পায়না। অতীতে অনেক জাতি, বড় স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠী, গর্ব অহংকার করে ধ্বংস হয়ে গেছে। কাজেই আমাদের উচিত গর্ব, অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ পরিহার করা।
আধুনিক পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র যদি এসব ধারাগুলোকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর করা হয় তাহলে আর কি এমন কোন চোরা পথ খোলা থাকে যে পথ ধরে সমাজে অশান্তি ঢুকতে পারে?