কালোটাকা ও বেনামি সম্পদকে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে মূল অর্থনীতিতে ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এ জন্য অপ্রদর্শিত অর্থ ও বেআইনি সম্পদ নিয়ন্ত্রণ আইন নামে নতুন একটি আইন করার কথা বলেছে সংস্থাটি।
সিপিডি বলেছে, অর্থনৈতিক প্রতিষেধক দিয়েই অপ্রদর্শিত অর্থকে মূলধারার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। পাশাপাশি সম্পদ দেশে থাক আর বিদেশে থাক, আয়করের অধীনে অবশ্যই সেই সম্পদের হিসাব অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের পর্যালোচনাভিত্তিক হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে গতকাল সোমবার এ অভিমত দিয়েছে সিপিডি। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সকালে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে চলতি অর্থবছরের ওপর এ পর্যালোচনা তুলে ধরেন সংস্থাটির গবেষকেরা।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির পক্ষে লিখিত বক্তব্য দেন রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। পরে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান এবং অতিরিক্ত গবেষণা খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
পর্যালোচনায় বলা হয়, দীর্ঘ সময় ধরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের মতো অন্তর্নিহিত শক্তি দেশের অর্থনীতির রয়েছে। তবে সেটিকে বিকাশ করার মতো যে ধরনের ‘চালক প্রতিষ্ঠান’ ও পরিবেশ দরকার তা পাচ্ছে না। এ জন্য দরকার বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সংস্কার।
অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অংশ হিসেবে জরুরি ভিত্তিতে পাঁচটি স্বাধীন কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে সিপিডি। যেমন: সঠিক পরিসংখ্যান নিশ্চিত করার জন্য পরিসংখ্যান কমিশন, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে একটি স্থায়ী মূল্য কমিশন, স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার অর্থায়ন কমিশন, সরকারি ব্যয় পুনর্মূল্যায়ন করতে স্বাধীন কমিশন এবং আর্থিক খাত সংস্কার বিষয়ে কমিশন।
প্রশ্নোত্তর পর্বে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকারের আয়-ব্যয়ের গতানুগতিক যে পদক্ষেপ রয়েছে, সেটা দিয়ে বড় ধরনের রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। অন্যথায় বিদ্যমান করদাতাদের ওপর করের বোঝা আরও বাড়তে থাকবে। করের আওতায় নতুন বিষয়, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের নিয়ে আসতে হবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে আয়ের ওপর কর আছে কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পদের ওপর কোনো কর নেই। সম্পদের ওপর কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি উত্তরাধিকার করের বিষয়টিও চিন্তা করা উচিত। এ ধরনের বিধান অনেক আধুনিক রাষ্ট্রে আছে। এর মাধ্যমে সমাজে একধরনের ‘সাম্য বা ইনসাফ’ প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে।
প্রসঙ্গ কালোটাকা: এ বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশে অপ্রদর্শিত আয় নিয়ে বিভিন্ন বছরে বিভিন্ন ধরনের যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটি থেকে বেরিয়ে একটি নির্ভরযোগ্য মধ্যমেয়াদি নীতিমালায় আসা দরকার। যাতে সৎ করদাতাদের ওপর কোনোভাবে চাপ তৈরি না হয়।
এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হলে অপ্রদর্শিত আয় ও বেনামি সম্পদের ওপর একটি আইন লাগবে। এ ধরনের আইন করা খুবই জরুরি হয়ে গেছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আইনের আওতায় যাঁরা সম্পদ দেশে বা বিদেশে রেখেছেন, উভয় ধরনের সম্পদের হিসাব প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে দেশের মধ্যেই অনেকে সম্পদ নিজের নামে না রেখে আত্মীয়স্বজনের নামে রাখছেন। ব্যবসাকে কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না করে অপ্রদর্শিত আয়কে করের আওতায় এনে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
সংস্কারের উৎকৃষ্ট সময়: সিপিডি মনে করে, দেশের অর্থনীতির অনেকগুলো সূচকই বর্তমানে স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিম্নগামী, সুদের হারও কম। স্থিতিশীল বিনিময় হার। বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম এখন নিম্নমুখী। অর্থনীতির অনেকগুলো সূচকের স্থিতিশীল অবস্থানের মধ্যেই অর্থমন্ত্রী ৪ জুন নতুন বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। তাই অর্থনীতির এ ইতিবাচক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আগামী অর্থবছরে প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি সংস্কারে উদ্যোগী হতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এসব সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক মতৈক্য দরকার বলেও মত দিয়ে তিনি বলেন, সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণের এখনই সঠিক সময়। কারণ, অর্থনীতিতে এখন একধরনের স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এটা বড় শক্তির দিক। এ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সরকারের দিক থেকে কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি সংস্কারের ধাক্কা দেওয়া উচিত। এ ধাক্কা ভালোভাবে দিতে পারলেই প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে পৌঁছে যাবে।
বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফর ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্ভাব্য বিভিন্ন চুক্তির বিষয়ে সাংবাদিকেরা অভিমত জানতে চান। জবাবে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারত এরই মধ্যে বাংলাদেশি প্রায় সব ধরনের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। তার পরও অশুল্ক বাধাসহ বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে সে সুযোগকে আমরা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ক্ষেত্রে যে ২৭টি স্থলবন্দর রয়েছে, সেগুলো এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। তাই আগামী বাজেটে এসব বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের উদ্যোগ নিতে হবে।
এ বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘মোদির সফরকে ঘিরে যেসব যোগাযোগ চুক্তি স্বাক্ষরের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো খুবই ইতিবাচক। দুই দেশের মধ্যে সমুদ্র যোগাযোগ বাড়লে তাতে উভয় দেশেরই আমদানি ও রপ্তানি খরচ কমবে। আলাদা আলোচনার মাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের চুক্তি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উচিত ছিল দুই দেশের মধ্যে সামগ্রিকভাবে একটি ট্রানজিট ও বিনিয়োগ চুক্তি করা। তার আলোকে সার্বিকভাবে বিভিন্ন নীতিকাঠামো ও প্রতিষ্ঠান তৈরি হওয়ার সুযোগ ছিল। ভারতের সঙ্গে করা বিভিন্ন যোগাযোগ চুক্তির সুফল নেওয়ার জন্য অবকাঠামো খাতে যে ব্যয় ও বিনিয়োগ প্রয়োজন, তার কোনো উদ্যোগ দেখছি না। নৌ প্রটোকলের আওতায় তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে মাশুল আরোপের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এ দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দেশের সীমানা ব্যবহার করা হলে সে ক্ষেত্রে মাশুল নেওয়া হবে কি না?’
ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক: সরকারের ক্রয়নীতির দুর্বলতার কারণে কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না বলে মনে করছে সিপিডি। কৃষকের কাছ থেকে সরকার যে পদ্ধতিতে ধান, চাল সংগ্রহ করে, তাতে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কেনা হয় মাত্র ১০ শতাংশ। বাকি পণ্য কেনা হয় ফড়িয়াদের কাছ থেকে। এর ফলে সরকারি ক্রয়ের কোনো উপকার কৃষক পাচ্ছেন না। তাই স্থানীয় পর্যায়ে ধান, চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকারের নীতি পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা: সিপিডি জানিয়েছে, আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট হবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় প্রথম বাজেট। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ সরকারের অনেক প্রাক্কলনই শেষ পর্যন্ত অর্জিত হয়নি। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা ৮ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে এটি সাড়ে ৬ শতাংশ হয়েছে। তাই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে বাস্তবভিত্তিক করার সরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে সিপিডি।
দেশের অর্থনীতির অনেকগুলো সূচকের ভালো অবস্থানের চিত্র তুলে ধরে সংস্থাটি। এর পাশাপাশি বিনিয়োগ, রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি করা যন্ত্রপাতির ‘অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি’, রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব, ভর্তুকি ও বৈদেশিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের দুর্বলতার দিক তুলে ধরা হয়। এসব দুর্বলতার কারণে অর্থনীতি তার সম্ভাবনার সীমান্তে পৌঁছাতে পারছে না। তাই সংস্থাটি বলেছে, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক কতটা ভালো অবস্থানে আছে তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থনীতির নিজস্ব যে শক্তি বা সামর্থ্য, সেটি কতটা অর্জিত হচ্ছে।