প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নিনআমাদের সমাজে নারী নির্যাতন যেন এক অপ্রতিরোধ্য ব্যাধির মতোই জেঁকে বসেছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারী। পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায়- বলা যায় প্রতিটি স্থানেই নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণে নারীর যেমন বিপথগামী হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়, তেমনি নির্যাতন নারীকে আত্মহত্যার পথেও প্ররোচনা জোগায়। নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের এই দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে নিতান্ত কম নয় বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে এই প্রবণতা নিঃসন্দেহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সত্য যে, মানবাধিকার প্রশ্নে আমাদের দেশের নারীসমাজ সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় আছে। গতকাল যায়যায়দিনের এক প্রতিবেদনে নারী নির্যাতনের যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা রীতিমতো আতঙ্কের জন্ম দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশের আটটি ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ৭২৪ জন নির্যাতিত নারী ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে যৌন নির্যাতনের শিকার ১৮৭, শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৫৩১ এবং পুড়িয়ে নির্যাতনের শিকার ৬ জন। সাম্প্রতিক সময়ের এই ভয়াবহ চিত্রই প্রমাণ করে আমাদের দেশের নারীরা এখনো কত অসহায়, কত শ্বাপদসঙ্কুল তাদের চলার পথ।
অনস্বীকার্য যে, নারী নির্যাতন দীর্ঘদিনের এক সামাজিক নষ্ট উপসর্গ। পুরুষের যৌনলিপ্সু দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই দেশের বেশিরভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। বখাটেরা যখন তরুণীদের উত্ত্যক্ত করে তখনো একই মনোবৈজ্ঞানিক কারণ কাজ করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। এতে দোষীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি থেকে রেহায় পায় বলেই তারা আবারো এই ধরনের অমানবিক এবং অসামাজিক কর্মে নিজেদের প্রবৃত্ত করার সাহস পায়। অন্যদিকে সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বেকারত্ব, মাদকের সহজলভ্যতা, প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং অপসংস্কৃতির প্রসারকেও দায়ী করা যায় নারী নির্যাতনের বিশেষ কারণ হিসেবে। এই সমস্যা বা সামাজিক অসঙ্গতি জিইয়ে রেখে একটি রাষ্ট্রের সর্বাত্মক উন্নয়ন আশা করা সত্যিই কঠিন।
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে টিএসসিতে যৌন হয়রানির ঘটনার মধ্যদিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতনের বিষয়টি আবারো আলোচনায় এসেছে। এরপর রাজধানীতে আদিবাসী তরুণী ধর্ষণসহ বেশ কয়েকটি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। যৌন নির্যাতন বা নারী নির্যাতনের এসব ঘটনা রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে তৎপর নয় সেটিও আমরা বলতে চাই না। সর্বশেষ ৩১ মে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে এক শিক্ষার্থীকে তার প্রেমিক ও প্রেমিকের দুই বন্ধু মিলে গণধর্ষণ করে। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, মামলা দায়েরের ৬ দিন অতিবাহিত হলেও আসামি আটক হয়নি। আমরা মনে করি, দেশে নারী নির্যাতন রোধে কঠোর আইন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও নারী নির্যাতনের মাত্রা হ্রাস না পাওয়া নিঃসন্দেহে ভীতিকর। সমাজবিরোধী নানা কর্মকা- নারীর ওপর ক্রমাগত কালো ছায়ার যে বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে, তা সভ্যতা ও মানবতার কলঙ্ক ভিন্ন অন্য কিছু নয়। আবার সরকার ও প্রশাসনের তরফে নারী নির্যাতন রোধে যে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপের প্রত্যাশা জনমনে বিরাজমান, সে ক্ষেত্রে আশানুরূপ পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অর্থাৎ যথাযথ আইনি প্রতিকারের ক্ষেত্রটি খুব বিবর্ণ। ফলে এই অশুভ পাশবশক্তিকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক শক্তির রুখে দাঁড়ানোর বিকল্প থাকতে পারে না।
সার্বিক বিবেচনায় বলতে চাই, নারী নির্যাতনের যে ক্রমবর্ধমান উন্মত্ততায় সমাজদেহ থর থর করে কাঁপছে, এর কঠোর প্রতিকার জরুরি। প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে জবাবদিহির আওতায় আনাও জরুরি। একই সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। মনে রাখতে হবে, সময় সমাজকে এগিয়ে দেয়। আর সমাজের হাত ধরেই এগিয়ে যায় দেশ, জাতি। বহুমাত্রিক নারী নির্যাতনের সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আমাদের সমাজ অধঃপতনের দিকে ধাবিত হোক তা কেউ প্রত্যাশা করে না। সমাজে ব্যক্তির অবস্থান, পারিবারিক সুন্দর স্থিতিশীলতা এবং সখ্য বন্ধনের তন্ত্রীগুলো যাদের কারণে ছিঁড়ে যাচ্ছে, তাদের প্রতি কোনো অনুকম্পা কাম্য নয়, আমরা চাই তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক দ- নিশ্চিত করা হোক। লিঙ্গ পরিচয় বড় নয়; নারীও মানুষ_ এটাই সবচেয়ে বড় কথা। আর তা নিশ্চিত করার দায় রাষ্ট্রশক্তির।