মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি:
এক মাসের ব্যবধানে মানিকগঞ্জের জনপ্রিয় ২ বাউলশিল্পী খুন। একজনকে হত্যার পর তার স্বামীও আত্মহত্যা করেছেন। লিখে রেখে গেছেন চিরকুট।
অন্য জনকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে বিলের পানিতে ফেলে হত্যা করেছেন তার স্বামী। পরে ট্রলারের মাঝির ফোনে এলাকাবাসী ঘাতককে আটক করে পুলিশে দিয়েছে।
নিহতরা হলেন- বাউলশিল্পী সাথী সরকার (৩০) ও বিউটি সরকার (৩৬)। দুজনই প্রাণ দিয়েছেন তাদের দ্বিতীয় বিয়ের স্বামী হাতে। সাদা চোখে গান গাওয়া নিয়ে দাম্পত্য কলহে ঝরে গেছে দুটি প্রাণ।
তবে হত্যার এই প্রেক্ষাপট একদিনে তৈরি হয়নি। নিহতদের বাউল গানের গুরু, প্রতিবেশী ও স্থানীয়দের মুখ থেকে উঠে এসে তারই বৃত্তান্ত।
গত ২৯ জুলাই সাথী সরকারের বুকে ছুরিকাঘাত ও গলা কেটে হত্যা করেন তারই স্বামী আসিকুর রহমান ফারুক (৩৫)। পরে ফারুক নিজেও গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
আর গত ১ সেপ্টেম্বর বেড়াতে নিয়ে গিয়ে বিউটি সরকারকে ট্রলার থেকে বিলের পানিতে ফেলে হত্যা করেন তারই স্বামী সেলিম মিয়া (২৮)। এ ঘটনার পরপরই সেলিম ও তার সঙ্গীদের ধরে পুলিশে দেন স্থানীয়রা।
বিউটি সরকার মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার উত্তর তরা গ্রামের আব্দুল মজিদ বিশ্বাসের মেয়ে। আর সাথী সরকার উপজেলার নলকুড়িয়া গ্রামের হামেদ প্রধান আরানের মেয়ে।
পার্শ্ববর্তী শিবালয় উপজেলার সাহেলী গ্রামের জালাল সরকারের কাছে বাউল গানের দীক্ষা নিয়েছিলেন সাথী ও বিউটি। এরপর দেশের বিভিন্নস্থানে জীবনবোধের এই যুক্ত-পাল্টা যুক্তি তুলে ধরে অল্প সময়ে শ্রোতাপ্রিয় হন তারা।
দুজনেরই বেশকিছু বাউল গানের (পালা গান, বিচার গান ও বিচ্ছেদ) অডিও ও ভিভিডি অ্যালবাম বের হয়েছে। দুই শিল্পীর মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। তারা একে অপরের বাড়িতে গিয়ে থেকেছেন। বাউল গান নিয়ে নিজেদের মধ্যে জানা-অজানার অভিজ্ঞতা বিনিময়ও করেছেন।
তাদের এই হত্যাকান্ডে মানিকগঞ্জে বিশেষ করে বাউলশিল্পীদের নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকটা জীবনবোধের এই শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে।
বাউলশিল্পীদের অতীত টেনে অনেকেই বলছেন, বাউল গানকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য শিল্পীরাই দায়ী। যারা মানুষকে জীবনবোধের যুক্তিতে মোহিত করেন, তাদের জীবনচরিত্র আরো হিসাবি হওয়া দরকার।
বাউল গানে অনেক নারীর আদর্শ বাউল সম্রাজ্ঞীখ্যাত মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার জয়মন্টপ গ্রামের মেয়ে মমতাজ বেগমের কথায় ধরেন। তিনি এখন বাউল,রাজনীতিবীদ থেকে জনপ্রতিনিধি ও।
বাউল গানের জন্য অনেক কিছু করেছেন মমতাজ। তবে একাধিক স্বামী পাল্টানো ছাড়াও নামের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছেন এই শিল্প-সংক্রান্ত অনেক বাজে উদাহরণ।
অথচ মানিকগঞ্জের বিশিষ্ঠ বাউলশিল্পী প্রয়াত রশিদ সরকার, আবুল সরকার, তারাব আলী, জালাল সরকার ও আবদুল আলিম সরকার অনেকেরই আদর্শ।
নিহত সাথী সরকারের ছোট বোন রানু আক্তার জানান, সাথী এসএসসি পাস। ছোট বেলা থেকে গানের প্রতি ভীষণ আগ্রহ দেখে জালাল সরকারের কাছে নিলে সেখানেই গানে দীক্ষা নেয় সে।
জালাল সরকারের সঙ্গেই বিভিন্নস্থানে গান করতে যেতেন সাথী। নয় বছর আগে গুরুর সঙ্গে প্রণয়ে জড়িয়ে বিয়ে করেন। সে সংসার টেকে মাত্র দেড় বছর। বিচ্ছেদের পর সাথী বাউল গানে আরো মনোযোগী হন। বিভিন্ন সময়ে তার ছয়টি অডিও ও ভিসিডি অ্যালবাম বের হয়।
এরপর চার বছর আগে বাউল গানের ঢোল বাদক আসিকুর রহমান ফারুকের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার সূত্রে বিয়ে হয় সাথীর। গাজীপুরের শিমুলতলার ছেলে ফারুক সাথীকে নিয়ে মানিকগঞ্জ শহরে বসবাস করতেন। সাথী প্রথম সংসারের মত দ্বিতীয় সংসারেও নিঃসন্তান ছিলেন।
সাথী সরকারের বাবা হামেদ প্রধান জানান, মাস খানেক আগে চাকরি দেয়ার কথা বলে দৌলতপুর উপজেলার এক ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেয় ফারুক। তা থেকেই পারিবারিক কলহে ফারুক সাথীকে খুন করে। পরে নিজেও আত্মঘাতী হয়। চিরকুটে ফারুক লিখে যায়- ‘এই মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’।
এদিকে, বিউটি সরকারের সেজো বোন জরিনা আক্তার জানান, সাত বোনের মধ্যে বিউটি সবার বড়। ছোট বেলা থেকেই গানের প্রতি তার আগ্রহ ছিল বেশি। বাড়িতে হারমোনিয়াম ও তবলা বাঁজিয়ে গান করতেন বিউটি।
১৯৯২ সালে মানিকগঞ্জ শহরের বান্দুটিয়া এলাকার লালমিয়া নামে একজন প্রবাসীর সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় বিউটির। এ কারণে তিনি সপ্তম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি।
লালমিয়া ও বিউটির সংসারে সোহাগ মিয়া ও সূচনা আক্তার নামে দুই সন্তানের জন্ম হয়। এরপর নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে বণিবনা না হওয়ায় ২০০৯ সালে ছাড়াছাড়ি হয়। ছেলে সোহাগ বর্তমানে ওমান থাকেন। আর সূচনাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিচ্ছেদের পর জালাল সরকারের কাছে বাউল গান শিখেন বিউটি। অল্প দিনেই তিনি শ্রোতাদের মন জয় করে নেন। বিউটি বিশ্বাস থেকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন বিউটি সরকার নামে। বাউল গানের অন্তত ১৫টির মতো অডিও এবং ভিসিডি বের হয়েছে তার।
গাজীপুরে গান গাইতে গিয়ে পরিচয় হয় স্থানীয় কাপড়ের দোকান কর্মচারী সেলিমের সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রেম, দুই বছর আগে বয়সে ছোট সেলিমকে বিয়ে করেন বিউটি। গাজীপুর শহরেই ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা।
যে গানে মজে সেলিম বিউটিকে বিয়ে করেন। পরে সেটি আর তিনি করতে দিতে চাননি। এ নিয়ে দাম্পত্যে দিধা দন্দ দেখা দেয়, যার পরিণতি স্বামী হাতে জীবন দিলেন সম্ভাবনাময় এই বাউলশিল্পী।
বিউটির বাবা আবদুল মজিদ বিশ্বাস জানান, বিয়ের পর থেকে তাকে বাউল গান গাওয়া ছেড়ে দিতে বলেন সেলিম। তা না শুনে বিউটি বিভিন্নস্থানে গান গাইতে যেতেন। এ থেকেই তাকে সেলিম খুন করেছে।
স্থানীয়রা জানায়, শুধু বিউটি কিংবা সাথী সরকার নন, মানিকগঞ্জের অনেক বাউলশিল্পীর জীবনই অগোছাল। তারা সংসার জীবন করলেও সেটি নিয়েই ছন্নছাড়া। কেউ কেউ বেশ বেপরোয়া। ঠুনকো কারণে সংসার যেমন গড়েছেন, ভাঙতেও তাদের সময় লাগে না।
তারা বলেন, বাউলশিল্পীরা সুরের মূর্ছনায় মানুষকে জীবন সম্পর্কে জানতে শেখান। অথচ তারা নিজেরাই বেপরোয়া জীবন যাপন করেন, যারই পরিণতি এভাবে একেকটি নির্মম হত্যাকান্ড।
এক মাসে বাউল গানের সম্ভাবনাময় দুই শিল্পী নিহতের ঘটনায় মানিকগঞ্জ জেলা বাবা ভান্ডারী বাউলশিল্পী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল আলীম সরকার জানান, ‘দুটি ঘটনায় নিন্দনীয়। এতে যেমন বাউল গান সংকটে, তেমনি বাউল সমাজের প্রতি মানুষের বিরূপ মনোভাব আরো বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বাউলশিল্পীরা দেশ-বিদেশে গান করেন। এজন্য তাদের দাম্পত্য সঙ্গী বাছাইয়ে আরো হিসাবি হওয়া দরকার ছিল। সংসারে বিশ্বাস ও আস্থার ভিত শক্ত না হলে তা ভেঙে পড়তে বাধ্য।’
বাউলশিল্পীদের মধ্যে সচেতনা বাড়াতে কাজ করার তাগিদ দেন আবদুল আলীম। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে তিনি এই শিল্প বাঁচাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।