ইলিয়াছ মাহমুদ ॥ পদ্মা-মেঘনার জল সীমায় ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরতে গিয়ে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কারাবরণ করছে শরীয়তপুরের পৌনে ২শ জেলে। এদের পরিবারে চলছে এখন হাহাকার। লোনের কিস্তি দিতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পরিবারের নারী সদস্যরা। তাদের সামনে এখন শুধুই হতাশা। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, দরিদ্র জেলেদের শুধু জেল জরিমানাই একমাত্র ব্যবস্থা হওয়া উচিত না, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে জেলেদের মাছ ধরতে বাধ্য করে বিভিন্ন আড়ৎদার ও মহাজনেরা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার সরকারকে। ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর ১৫ দিন ছিল ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এ সময় দেশের সব প্রজনন এলাকায় মা ইলিশ শিকার, বিপণন, পরিবহন, মজুদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। শরীয়তপুরেও ঘটেনি এর ব্যতিক্রম। কিন্তু পেটের তাড়না আর ঋণের দায় থেকে মুক্তি পেতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেও মা ইলিশ শিকার করতে গিয়ে জেলার জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার ১৭২ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেককে ১ বছর করে জেল দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসব সাজাপ্রাপ্ত জেলেদের পরিবারে চলছে এখন চরম অভাব অনটন। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি কারাগারে থাকায় পুরো পরিবারের ওপর নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। সাজাপ্রাপ্ত জেলেদের প্রত্যেকের মাথার ওপর রয়েছে বিভিন্ন ঋণের বোঝা। ফলে তাদের স্ত্রী-সন্তান এখন সময় মতো কিস্তি পরিশোধ করতে না পাড়ায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে ঘর-বাড়ি ছেড়ে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার উত্তর তারাবুনিয়া ইউনিয়নের মোল্লা কান্দি গ্রামের আবদুল হাকিম সরদার ও ইসহাক সরদার এ দুই ভাইয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল ১২ সদস্যের একটি বড় পরিবার। বিভিন্ন এনজিও থেকে তারা ৫০ হাজার টাকা ঋণ তুলে নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতো। অভিযানের সময় তারা দুই ভাই মাছ ধরতে গিয়ে আটক হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের দুজনকেই এক বছর করে জেলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে। তারা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর গত ১৫ দিনেও এক বেলা খাদ্য জোটেনি পরিবারে কারোরই। দুচোখের পাতা এক করে এক মুহূর্তও ঘুমোতে পারেনি হাকিমের স্ত্রী রাবেয়া। কেউ তাদের এক কেজি চাল দিয়েও সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। ৫০ হাজার টাকা ঋণে সপ্তাহে ২ হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ আর সৌর বিদ্যুতের সাড়ে ৬শ টাকা করে কিস্তি পরিশোধ করেত না পারায় সীমাহীন গঞ্জনা সইতে হচ্ছে রাবেয়াকে। স্বামী-দেবরের কারামুক্তির জন্য সচেতন সমাজের কাছে দাবি জানিয়েছেন রাবেয়া বেগম। শুধু রাবেয়াই নন, ঋণের দায়ে জর্জরিত দুলারচরের সাজাপ্রাপ্ত জেলে জামাল হোসেন ঢালীর স্ত্রী সালমা আক্তার, কাচিকাটার আবদুর রহমান ছৈয়ালের স্ত্রী মেহেরুন নেছা, চরভাগা গৌরাঙ্গ বাজার এলাকার আলাউদ্দিন বেপারীর স্ত্রী মাফিয়া খাতুন, তারাবুনিয়া গুচ্ছ গ্রামের সিরাজ মোল্লার স্ত্রী হনুফা বেগম ও আবুল কালাম বেপারীর স্ত্রী রোজিনা বেগমসহ শতাধিক গৃহবধূ এখন স্বামীর কারামুক্তির জন্য ফরিয়াদ জানাচ্ছে দ্বারে দ্বারে ঘুরে। বেসরকারি সংস্থা আশা এর উত্তর তারাবুনিয়া শাখার ঋণ প্রদানকারী কর্মকর্তা সুমন হাওলাদার জানান, শুধু এই উত্তর তারাবুনিয়া শাখায় তাদের ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। যার বেশিরভাগ ঋণ গ্রহীতাই হল মৎসজীবী জেলে। এদের মধ্যে অনেক মৎস্যজীবী জেলে থাকায় নিয়মিত কিস্তি আদায় সম্ভব হচ্ছে না। অপর দিকে শরীয়তপুরের স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এসডিএস এর ক্ষুদ্র ঋণবিষয়ক পরিচালক বিএম কামরুল হাসান বাদল বলেন, তাদের সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণকারী যেসব মৎস্যজীবী জেলে আছে তাদের থেকে কিস্তি আদায়ে চাপ প্রয়োগ না করতে কর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে সরকারের পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন সাজাপ্রাপ্ত দরিদ্র জেলে পরিবারের থেকে কিস্তি আদায়ে শিথিলতা অবলম্বনে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা আমরা অবশ্যই মেনে চলবো। শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহসীন বলেন, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ডিমওয়ালা মা ইলিশ শিকার করায় শরীয়তপুর জেলায় ১৭২ জন জেলেকে ১ বছর করে জেল দেয়া হয়েছে। এছাড়াও মা ইলিশ না ধরতে মৌসুম শুরুর আগেই জেলেদের সচেতন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শরীয়তপুর সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরুন্নবী আলম বলেন, জেলেদের শুধু জেল দিয়েই ইলিশ রক্ষা করা সঠিক ব্যবস্থা হতে পারে না। জেলেদের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরতে বাধ্য করে আড়ৎ মালিক, মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীরা। ইলিশ শিকার করে জেলেরাই শুধু লাভবান হয় না। অধিক লাভবান হয় মহাজন ব্যবসায়ীরা। এই সাজার ভাগ তাদেরও হওয়া উচিৎ।