জীবন থাকলে সম্পর্ক থাকবেই। আর সম্পর্ক থাকলে থাকবে সমস্যা। প্রতিদিন ফেসবুকের ইনবক্সে ও ই-মেইলে আমরা অসংখ্য সম্পর্ক ভিত্তিক প্রশ্ন পাই, যেগুলোর কথা হয়তো কাউকেই বলা যায় না। পাঠকদের করা সেইসব গোপন প্রশ্নের উত্তর দিতেই আমাদের নিয়মিত আয়োজন । আর সম্পর্ক ভিত্তিক সেই প্রশ্নগুলোর উত্তরে পরামর্শ দিচ্ছেন গল্পকার রুমানা বৈশাখী, এডিটর ইন চার্জ (লাইফ ও সায়েন্স),।
আপনি চাইলে নিজের এমনই কোন একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যার কথা লিখে জানাতে পারেন আমাদের। আমরা প্রতিদিন চেষ্টা করবো বাছাইকৃত কিছু সমস্যার সমাধানে কাঙ্ক্ষিত পরামর্শটি দেবার। সমস্যার কথা লিখে জানান আমাদের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। নাম গোপন রাখতে চাইলে লিখে দেবেন “নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক”।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানিয়েছেন নিজের সমস্যার কথা।
“সম্পর্ক থাকলে সমস্যা থাকবে,এই কথাটি খুব ভালো লাগলো। আর জীবন মানেই হয়তো এক রাশ সমস্যা। আমি বর্তমানে অনার্স কমপ্লিট করেছি। ২০১১ সালে আমার বিয়ে হয়। তখন আমার বয়স মাত্র ১৮। আমার বর ছিলেন ৩৪ বছর বয়স্ক। কিন্তু তা আমি জানতাম না। আমার বাবা হৃদরোগী। ছোট ভাই ছিলো ক্লাস ৫ম-এ। মা গৃহিণী। আর আমার স্বামী আমেরিকা প্রবাসী।
আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়েটা হয়। বিয়ের আড়াই মাস পর সে চলে যায়। আমার ভিসা হওয়ার পর আমাকে নিতে আসে ২০১৪ তে। আমিও আসি আমেরিকা। পরীক্ষা দিতে বাংলাদেশে আসি ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন ইন্টারনেটে এতোটা এক্সপার্ট ছিলাম না,আমার হাসব্যান্ডের সাথে বিয়ের পর থেকে এই ৩ বছরে যোগাযোগ তেমন ভাবে হতোনা।
৬ মাস আগে বাংলাদেশে একটি ছেলের সাথে পরিচয় হয়। সে ফটোগ্রাফার। আমার ফেবু আইডি নেয় সে। এরপর আস্তে আস্তে বন্ধু হয়ে যায় সে আমার। সবসময় আমার খবর নিতো। ফোন করতো। আমাকে বুঝাতো তার কাজে যে সে আমাকে ভালোবাসে। আমিও তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। সে জানতো আমি বিবাহিতা এবং আমার সবকিছুই। আমি তার সাথে কখনো মিথ্যে বলিনি। আর স্বভাব গত দিকেই আমি সত্যি কথা বলি। একদিন সে আমাকে প্রপোজ করে,আমি তাকে ফিরিয়ে দেই। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। বার বার বলত এবং বোঝাতো আমাকে তার ভালোবাসাটা। আমি তাকে না করলেও আমিও তাকে মনে মনে একটা জায়গা দিয়ে ফেলেছিলাম তা বুঝতেও পারিনি। মাঝে আমি আবার আমেরিকা আসি ১ মাসের জন্যে। আসার দিনও আমি তার সাথে দেখা করে আসি। আমি চলে আসার কিছুদিন পর সে সুইসাইড এটেম্পট করতে চায়,আমাকে আবার প্রপোজ করে। আমি আগ পিছু কিছু না ভেবে রাজি হয়ে যাই। আর তাকে বলি আমি কেবল আর ৬ মাসের জন্যে দেশে আসবো। আর আমি কোন খেলার রিলেশন চাইনা। সেও বললো আমি তোমাকে বিয়ে করবো। যা করা প্রয়োজন করবো। আমাদের বেশ ভালোই চলছিলো। বড্ড বিশ্বাস করতাম আমি তাকে। খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
আমি আর আমার হাসব্যান্ড আলাদা থাকতাম আগে থেকেই। আমি অপেক্ষা করছিলাম কবে দেশে যাবো তার কাছে। এক মাস পর আমি দেশে যাই। ভালোই চলছিলো আমাদের। আমার পুরো পৃথিবী জুড়েই সে ছিলো। সে পড়তো বিবিএ-তে। আমার ছোট ছোট আবদার গুলো সে খেয়াল রাখতো। নৌকায় চড়া,আকাশ দেখা,একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা। কিন্তু এর মাঝেও তার সাথে আমার নানা বিষয়ে ঝগড়া লাগতো। আবার ঠিকও হতো। কিন্তু গত ২ মাস আগে সে হঠাৎ যোগাযোগ অফ করে দেয়। ৪ দিন পর আমি চেষ্টা করি তার সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু আমার নাম্বার থেকে কল রিসিভ করছেনা। আমি তার বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করি,তার বাসায় পাঠাই। সে বলে অন্য কাহিনী। ওদের বাসায় নাকি সব জেনে গেছে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে। তার ফোন তার ভাইয়ের কাছে ইত্যাদি। ও বলছে কিছুদিন পর আমার সাথে যোগাযোগ করবে। কিন্তু করেনি। ১২ দিন পর আমি আমার এক ক্লাসমেট, যে ওর কাজিন, তাকে জানাই। সে আমাদের দেখা করানোর ব্যবস্থা করে। ও সেদিন আসে। বলে ওর সব সমস্যার কথা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি তুমি কি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাও? সে আমার মাথায় হাত রেখে বলে যে সে চায়। এরপর তার কাজিন ও আমার চেষ্টায় আমাদের কয়েকবার দেখা হয়। কিন্তু আমি তাকে ফেইসবুকে টেক্সট করলে সিন হতো কিন্তু রিপ্লাই দিতোনা। জিজ্ঞেস করলে বলতো তার ভাই ঢুকেছে ইত্যাদি। সে আমার সাথে এসব নিয়ে অনেক মিথ্যে বলে। আমি নিজেও এখনো জানিনা কেন সে আমার সাথে এমন করলো।
আমি তাকে ফোন কিনে দেই। কিন্তু সে তারপরও যোগাযোগ করতে পারেনা তার নাকি বাসায় সমস্যা। ২ মাস আপু আমি কিছু খেতে পারিনি। আমি অনেক সিক হয়ে পড়ি। তার কারণে আমি এক্সামে খারাপ করি। তার কষ্ট আমার সহ্য হতোনা। প্রায় টাকা লাগলে কিছু আমি দিতাম। কিন্তু আমার হাসব্যান্ড-এর টাকা আমি কখনোই ওর পিছনে খররচ করতাম না। আমি একটা পার্ট টাইম জব করতাম আমেরিকায়। তার আরনিংটা সেইভ করে দেশে নিয়ে এসেছিলাম। আমি এই মাসে আবার বিদেশে চলে আসি। আসার দিন তাকে ফোন দেই,রিসিভ করেনি। মেসেজও দিই। কিন্ত সে একটা খবরও নিলোনা। আমি ফেবুতে তাকে মেসেজ দেই। বিনিময়ে সে আমাকে ব্লক মেরে রাখে। আমি সইতে পারছিলাম না এসব, তাও সহ্য করছিলাম। আপু, বুঝাতে পারবোনা আমার প্রতিটা সেকেন্ড কেমন গিয়েছে। সে এতোদিন ফেবুতে কোন আপডেট দেয় নি। আমি চলে আসার দিন থেকে তার সব কিছু আপডেট হচ্ছে। পিকচার এভরিথিং। আপি, আমি যা করেছি তা অন্যায় আমার স্বামীর প্রতি, কিন্তু প্রেমিকের প্রতি কোন অন্যায় আমি করিনি। আমি ২ মাসে অনেক বার সুইসাইড করার ট্রাই করেছি। নিজেকে নিজের ঘেন্না লাগছিলো। কিন্তু পারিনি। আমি এখন আমার স্বামীর সাথে। কিন্তু আমি তো তাকে ভালোবাসিনা।
আমি কিছুতেই প্রেমিককে ভুলতে পারছিনা। প্রতিটা সময় আমার তার কথা মনে আসে। সে অনেক মিথ্যে বলে সম্পর্কটা গড়ছিলো। আমাকে বলেছিলো সে বাইরে চলে আসার ট্রাই করছে। কিন্তু আজ বুঝি সব মিথ্যে ছিলো। আমার স্বামীর সাথে আমার কোন দৈহিক সম্পর্ক নেই। আর আমার ভিতর থেকে তার জন্যে কিচ্ছু আসছেনা। আর বয়সের পার্থক্যটা আমি যখন থেকে বুঝতে পেরেছি তখন থেকে মানতে পারছিলাম না। আর আমি ছোটবেলা থেকেই একটু রেস্ট্রিকশন এর মধ্যে একা একাই বড় হয়েছি। কারো সাথে কিছু শেয়ার করার সুযোগ আমি পাইনি। আপু আগে ভেবেছি বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে আস্তে আস্তে সব মেনে নিবো। ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই ঘটনার পর আমি কিছুতেই আর নিজেকে বুঝাতে পারছিনা। আপু, বেঁচে থাকার মানে কি? আমি কেন বেঁচে থাকবো? জীবনে কখনো কারো ক্ষতি জ্ঞানত করিনি আমি। কিন্তু ঠকেছি পদে পদে। ওই ছেলের জন্যে আমি মেন্টালি মরে গেছি,আর সব দিক থেকে তো অবশ্যই। আমার মনে হয় জীবনটা এতো লম্বা কেন,প্রতি পদে পদে আমার মরতে ইচ্ছে হয়। আমি কিছুতেই এসব মানতে পারছিনা। আমার হাসব্যান্ডকেও না। আপু। মানুষ কেন এমন হয়? আমি কী করবো?”
পরামর্শ:
সত্যি কথা বলি আপু, আপনার চিঠি পড়ে আমার একটুও সহানুভূতি জাগছে না মনে। আপনার বোকামি দেখে খারাপ লাগছে, কিন্তু আপনার জন্য খারাপ লাগছে না। আপনাকে জাজ করার বা আপনাকে তিরস্কার করার আমি কেউ নই। তবে আমিও কোন পুরুষের কারো স্ত্রী, কারো কন্যা, কারো বোন। আর সেই দিক থেকে আমি দেখতে পাচ্ছি যে আপনি যা করেছে এবং করছেন, সেটা ভয়াবহতম অন্যায়। প্রত্যেক মানুষকেই নিজের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয়। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলি আপু, আপনি এখন যে কষ্ট পাচ্ছেন সেটা আপনার নিজেরই কর্মফল। নিজের জীবনে এই ভোগান্তি আপনি নিজেই ডেকে এনেছেন।
প্রথমত, আমি আপনার স্বামীর কোন দোষ দেখতে পাচ্ছি না। আসলেই পাচ্ছি না। আপনি যদিও চেষ্টা করেছেন মানুষটাকে দোষী দেখাতে, কিন্তু ৩৪ বছর বয়স হওয়া কোন দোষ না। তিনি আপনাকে আমেরিকা নিয়ে গিয়েছেন ঠিক আছে, কিন্তু লেখাপড়ার জন্য নিয়মিত দেশে পাঠাচ্ছেন , তাও কয়েক মাসের ব্যবধানে! আমেরিকা থেকে যাতায়াত করতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, সেটা সকলেই ভালো করে জানে। মানুষটি কেবল আপনার লেখাপড়ার জনই এই অর্থ ব্যয় করছেন, মাসে মাসে আপনার যাতায়াতের খরচ যোগাচ্ছেন। অন্য কেউ হলে বলতো যে লাগবে না লেখাপড়া করা। নিজের উপার্জন আপনি প্রেমিকের পেছনে ব্যয় করেছেন, আর স্বামীর টাকায় দেশে এসে এসে পরকীয়া করেছেন। এমন কাজ কি কোন বিবেকবান মানুষ করতে পারেন বলুন? স্বামীর সাথে আপনার কোন শারীরিক সম্পর্ক নেই বলেছেন। চিঠি পড়ে বুঝতে পারছি যে আপনার অনীহার কারণেই নেই। এদেশের অসংখ্য পুরুষ স্ত্রী চাক কিংবা না চাক, জোর পূর্বক শারীরিক সম্পর্ক করে থাকে। আপনার স্বামী কি কখনো জোর করেছে আপনাকে? করেনি। যদি না করে থাকে, তাহলে আপনি নিজেই ভেবে দেখুন মানুষটি ভালো না খারাপ। একসাথে বৃষ্টিতে ভিজে আর আকাশ দেখে জীবন কাটে না আপু। সেগুলো কেবল শাহরুখ খানের সিনেমাতেই ভালো লাগে। যে মানুষটি দায়িত্ব নিয়ে আপনাকে লেখাপড়া করাচ্ছেন, স্বনির্ভর হবার স্বাধীনতা দিচ্ছেন তাঁকে বিনা দোষে শাস্তি দিয়ে আপনি একটা প্রতারকের জন্য হা হুতাশ করছেন… এই অন্যায়ের কর্মফল তো আপনাকে ভোগ করতেই হবে, আপু।
আপু, আপনার বয়স অনেক কম। ভাববেন না যে আমি আপনাকে দোষারোপ করছি। আমি কেবল বাস্তবতা আপনাকে দেখানোর চেষ্টা করছি। যেহেতু আমাকে আপু ডেকেছেন, বোন হিসাবে এটাই আমার কর্তব্য আপনাকে সত্য বলা। আর সত্য এটাই যে আপনার প্রেমিক প্রতারক। সে আপনার সাথে সম্পর্ক করেছিল আপনার টাকার কারণে, তাঁর পেছনে যথেষ্ট খরচ আপনি করেছেন দেখতেই পাচ্ছি। সে ইচ্ছা করেই আপনাকে বিবাহিতা ও কম বয়স্ক দেখে সম্পর্ক গড়েছিল, ভেবেছিল স্বামীর টাকা এনে আপনি তাঁকে দেবেন। হয়তো শারীরিক সম্পর্ক করার লোভও তাঁর ছিল (ইতিমধ্যেই সেটা আপনারা করেছেন কিনা জানিনা)। কিন্তু যখন দেখেছে যে আপনি বিয়ে করতে চান, সিরিয়াস সম্পর্ক চান, তখনই সে সরে পড়েছে। খুব সম্ভবত অন্য কাউকে পেয়ে গেছে , যার কাছ থেকে আপনার চাইতেও বেশি সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
আপু, মানুষ মাত্রই ভালো ও খারাপ দিক থাকে। আমার প্রথম পরামর্শ হলো, আপনার স্বামীর ভালো দিকগুলো দেখার চেষ্টা করুন ও তাঁকে ভালোবাসার চেষ্টা করুন। তাহলে ভালো থাকবেন। আর যদি সেটা একান্তই না পারেন, মানুষটাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন। এভাবে তাঁকে কষ্টে রাখার মানে নেই। আপনার কারণে সে কেন ভালবাসাবিহীন জীবন কাটাবে? তাঁর ১০০ ভাগ অধিকার আছে স্ত্রীর ভালোবাসা পাওয়ার, সন্তানের পিতা হওয়ার। আপনি তাঁকে ছেড়ে দিলে তিনি অনেক ভালো একজন স্ত্রী পাবেন, যে স্ত্রী তাঁকে পৃথিবীর সব সুখ দেবে। তাই তাঁকে ছেড়ে দিন। যদি স্বামী ডিভোর্সে রাজি না হয়, নিজের পরকীয়ার কথা স্বামীকে জানিয়ে দিন। এতে তিনি নিজেই আপনাকে ছেড়ে দেবে। আপনারা দুজনেই নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবেন।
আর আপু, স্বামী সব কিছু জেনেও যদি মেনে নেন আপনাকে, আমি বলবো তাঁর সাথেই থাকুন। কারণ এমন মানুষ লাখে একটা মেলে।