বেনাপোল বন্দর থেকে খালাস করা আমদানিকৃত বৈধপণ্য মাঝপথে আটক করে হয়রানির প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকালের জন্য আমদানি রপ্তানি বন্ধের হুমকি দিয়েছে বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনগুলো। হয়রানির কারণে ইতিমধ্যে বেনাপোল বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি কমে গেছে। একইসঙ্গে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ধস নামতে শুরু করেছে। বৈধ পথে পণ্য আমদানি বন্ধ করে একটি মহল অবৈধ পথে পন্য আমদানিকে উৎসাহী করছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। গত ২৩শে নভেম্বর রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও অদালতে ঝুলে থাকা রাজস্ব সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পওির লক্ষ্যে আসা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের কাছে ব্যবসায়ীরা বিজিবির হয়রানির অভিযোগের তথ্য তুলে ধরা হলে রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (কাস্টমস) ফরিদ উদ্দিন জানান, বৈধ রুটে আমদানি করা কোন পণ্য চালান আটক করার কোন বৈধতা নেই বিজিবির। তবে বিজিবি যদি কোন ইনফরমেশন পায় তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে তারা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কমিশনারকে অবহিত করবেন। কমিশনরাই পণ্য চালানটি পুনঃপরীক্ষা নিরীক্ষা করে যদি কোন অনিয়ম পান তাহলে কাস্টমস অ্যাক্ট অনুয়ায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করবেন। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত বৈধ পণ্য রাজস্ব পরিশোধ করে বন্দর থেকে খালাস করার পর বিজিবির হয়রানির কারণে আমদানি কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত ৩রা নভেম্বর তারিখে ঢাকার আমদানিকারক মেসার্স তানজিম এন্টারপ্রাইজ, ভারতে থেকে ২৪৯ প্যাকেজ থান কাপড় আমদানি করেন, যার কাস্টমস বি/ই নাম্বার-৬০৭৯৬। পণ্য চালানটি কাস্টমসের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ১৭ লাখ ৬৫ হাজার ৩০৭ টাকার রাজস্ব পরিশোধের পর ঢাকার যাওয়ার সময় মাঝপথে বিজিবি পণ্য চালানটি আটক করে তিনদিন পর বেনাপোল কাস্টম হাউসে জমা প্রদান করেন। পরে কাস্টম ও বিজিবি যৌথ পরীক্ষা করে পণ্য চালানের ঘোষিত পরিমাণ ও সংখ্যা সঠিক পাওযা যায়। একই দিনে ঢাকার আমদানিকারক আনাম এন্টারপ্রাইজ ভারত থেকে ২৮০ প্যাকেজ থান কাপড় আমদানি করেন যার কাস্টমস বি/ই নং- ৬০৬৯৬ তারিখ: ৩/১১/১৫ যেখানে ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ২১৭ টাকার রাজস্ব পরিশোধ করে ঢাকায় যাওযার পথে বিজিবি মাঝপথে তা আটক করে, কোন গরমিল না পাওয়ার পরও কাস্টমসে জমা প্রদান করে বলে সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মালিক সেলিম জানান। তবে ২৬ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল জাহাংগীর হোসেন জানান, পণ্য চালানটি থান কাপড় হিসেবে আমদানি করা হলেও মূলত এগুলো শাড়ি হিসেবে ব্যবহার হবে। এতে সরকারে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হযেছে। অন্যদিকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে এ ক্ষেত্রে রাজস্ব ফাকির কোন ঘটনা ঘটেনি। কারন থান কাপড় কেটে জামা ও থ্রিপিস তৈরি করা যায়। যদি থানে ১২ হাত পর পর ব্লাউজ পিসসহ মার্জিন করা থাকে তাহলে এটিকে শাড়ি হিসেবে ধরা হবে। বেনাপোল কাস্টমসের সহকারী কমিশনার ড. সিরাজুল ইসলাম জানান, ভারত থেকে যেসব কমার্শিয়াল আইটেম আমদানি হয় তার মধ্যে কাপড় আমদানি খাতে সরকার প্রতিদিন প্রায় ৩-৪ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে থাকে। আমদানিকৃত থান কাপড় যথাযথ রাজস্ব আদায় করেই খালাস দেয়া হয়ে থাকে। সাধারণত ২০-৩০ মিটারের থান কাপড়ে যদি কোথাও কোন মার্জিন করা না থাকে তাহলে সেটাকে শাড়ি হিসেবে শুল্কায়ন করার কোন সুযোগ নেই। যদি কাপড়ে মার্জিন করা থাকে তাহলে শাড়ি ফেব্রিকস হিসেবে প্রতিকেজি ৪.৫০ মার্কিন ডলারে শুল্কায়ন করা হয়ে থাকে। যদি পাতলা জর্জেট থান কাপড়ে মার্জিন থাকে তাহলে সেটাকে ওড়না ফেব্রিকস হিসেবে প্রতিকেজি ৩.২০ মার্কিন ডলারে শুল্কায়ন করা হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য কাস্টম হাউসের চেয়ে বেনাপোলে এ জাতীয় পণ্য বেশি মূল্যে শুল্কায়ন করা হচ্ছে। সেখানে ক্যাটকারি করে এ জাতীয় পণ্যের শুল্কায়ন করা হয় না। বেনাপোল কাস্টম কর্তৃপক্ষের জোর করে মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা ও বন্দর থেকে খালাসকৃত পণ্যের মাঝপথে বিজিবি কর্তৃক হয়রানির কারণে আমদানিকারকরা বেনাপোল বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি বন্ধ করে চোরাই পথে পণ্য আমদানি করছে। ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া হচ্ছে। ভারত থেকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে সবচেয়ে কম সময়ে দ্রুত পণ্য আমদানি করা সম্ভব। আগে এ বন্দর দিয়ে প্রতিদিন আমদানি হতো প্রায় পাঁচশ ট্রাক মালামাল। বর্তমানে আমদানি হচ্ছে তার অর্ধেক। বেনাপোল বন্দরের চিরচেনা উচ্চ শুল্কহারের পণ্যগুলো অধিকাংশ এখন আমদানি হচ্ছে মংলা, সোনামসজিদ ও বুড়িমারি বন্দর দিয়ে। ফল, পিয়াজ, চাল, মাছসহ পচনশীল পণ্য চলে গেছে ভোমরা ও সোনামসজিদ বন্দরে বেনাপোল কাস্টমসের সঙ্গে অন্য সব শুল্ক স্টেশনগুলোর সঙ্গে অভিন্ন মূল্যে শুল্কায়ন না হওয়ায় আমদানিকারকরা তাদের সুবিধার্থে অন্য বন্দরে চলে যাচ্ছে বলে জানান সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া বেনাপোলে রয়েছে ভারতের সঙ্গে বিশাল সীমান্ত এলাকা যা পুরোপুরি রক্ষিত নয়। বিজিবি ও পুলিশকে ম্যানেজ করে চোরাকারবারীরা এসব সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার পণ্য সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। কাস্টম কর্মকর্তারা যদি হয়রানি বন্ধসহ শুল্কায়ন মূল্য বৃদ্ধি না করতো তাহলে চোরা পথে পণ্য আসা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে এ বন্দর দিয়ে আমদানি বৃদ্ধি পেতো আর বাড়তো সরকারের রাজস্ব আয়। আমদানি রপ্তানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক আনু জানান, বেনাপোল কাস্টমস হাউসে রাজস্ব বোর্ড সম্প্রতি তিন জন সৎ ও দক্ষ অফিসার নিয়োগ দিয়েছেন। বর্তমানে পণ্য চালান স্বচ্ছতার সঙ্গে পরীক্ষা করে মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানিকারকরা এই বন্দর ছেড়ে মংলা, সোনামসজিদ, বুড়িমাড়ি ও ভেমারা বন্দরে চলে গেছে। একদিকে কাস্টমসের কড়াকড়ি অনদিকে বিজিবির হয়রানি সব মিলিয়ে বেনাপোল বন্দরে অমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বিজিবি চোরাচালানের মাধ্যমে আসা পণ্য আটক না করে বৈধ পথে আমদানি করা পণ্য আটকের নামে হয়রানি করছ্ে। তাছাড়া বিজিবি এ পর্যন্ত ৩২টি চালান আটক করলেও একটিতেও শুল্ক ফাকির কোন ঘটনা উদ্ঘাটন করতে পরেনি। বেনাপোল কাস্টম সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, বেনাপোল বন্দর কে ধ্বংস করার জন্য একটি মহল জোর তৎপরতা চালাচেছ। বৈধ রুটে আমদানি করা পণ্য চালান বিজিবির এককভাবে তল্লাশির কোন আইনি সুযোগ নেই। যদি কোন চালানে গোপন সংবাদ থাকে তাহলে কাস্টমস কে সঙ্গে নিয়েই ইনভেন্ট্রি করতে হবে। তবে মূল্যের বিষয়ে অন্যন্য কাস্টমস হাউস বেনাপোল কাস্টমস হাউসকে অনুসরণ করলে এ বন্দরের মাধ্যমেই আমদানি রপ্তানি বেড়ে যাবে অনেকাংশে। বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার এ এফ এম আবদুল্লাহ খান জানান, কাস্টম হাউসে মূল্য বৃদ্ধির কারণে কমার্শিয়াল আইটেমর আমদানি কমে গেছে। তবে অন্যন্য শুল্ক স্টেশন দিয়ে এ জাতীয় পণ্য খালাস হচ্ছে। তাছাড়া চোরাচালানের মাধ্যমে এসব পণ্য আসায় সরকার একদিকে রাজস্ব হারাচ্ছে এবং অবৈধভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে। রাজস্ব আয় কমে গেলেও প্রোথ বেড়ে ১৩ শতাংশে উন্নীত হযেছে।