একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিলে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চে এ মামলার দশম দিনের শুনানি শেষ হয়েছে। আপিলের শুনানি কাল শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। নিজামীর আপিলের ওপর আজ সোমবার রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের কাছে এই আশা প্রকাশ করেন। সে হিসেবে চূড়ান্ত রায় আর বেশিদূর নয়। দেশবাসী তাকিয়ে আছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এবং চিহ্নিত রাজাকার নিজামীর রায়ের দিকে। আসন্ন বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে এ রায়কে ঘিরে অনেকে নানা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তবে সবকিছু নির্ভর করবে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের উপর। সোমবার সকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন। তার সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্তি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোমতাজউদ্দিন ফকির। অন্যদিকে নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের সঙ্গে আছেন এস এম শাজাহান। এর আগে গত বুধবার (২ ডিসেম্বর) নিজামীর আইনজীবীরা তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল সেদিন শুনানির জন্য দাঁড়ালেও যুক্তি উপস্থাপন শুরুর আগেই শূনানি মুলতবি হয়ে যায়। ওইদিনের শুনানিতে নিজামীর আইনজীবী এই জামায়াত নেতার অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছেন বলে অ্যাটর্নি জেনারেল পরে দাবি করলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তা অস্বীকার করেন। এর আগে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির দণ্ড দেন। রায়ে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করার অপরাধে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর দেওয়া এ রায়ের বিরুদ্ধে একই বছরের ২৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী। ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার আপিলে ফাঁসির আদেশ বাতিল করে খালাস চেয়েছেন নিজামী। মোট ১৬৮টি কারণ দেখিয়ে এ আপিল করা হয়। নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ৯ টি মামলা নিজামী ছাড়া আরও নয় যুদ্ধাপরাধীর আপিল আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম, নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুস সুবহান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন, হবিগঞ্জের জাতীয় পার্টির নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাহিদুর রহমান, ফোরকান মল্লিক ও আকরাম হোসেনের আপিল। এছাড়া পিরোজপুরের পলাতক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বারের আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল রয়েছে। মীর কাসেম আলী: একাত্তরে চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীকে গত বছরের ২ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। রাষ্ট্রপক্ষের আনা ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা জসিম ও জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে হত্যার দায়ে তার ফাঁসির রায় আসে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ৩০ নভেম্বর আপিল করেন মীর কাসেম। চলতি বছরের ২৮ মে আপিল বিভাগ আপিলের সারসংক্ষেপ দাখিলের জন্য দুই পক্ষকে চার সপ্তাহ সময় দেয়। মোবারক হোসেন: ফাঁসির দণ্ড পাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর আপিল করেন। গত বছরের ২৪ নভেম্বর মোবারককে ফাঁসির দণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। সৈয়দ কায়সার: এরশাদ আমলের কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের ফাঁসির রায় আসে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর। ওই রায়ের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে এ বছর ১৯ জানুয়ারি আপিল করেন তিনি। এ টি এম আজহারুল ইসলাম: গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর এ টি এম আজহারুলকে ফাঁসির রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। রায়ের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন আজহার। আব্দুস সুবহান: এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার বিরুদ্ধে ১৮ মার্চ আপিল করেন জামায়াত নেতা আবদুস সুবহান। ইঞ্জিনিয়ার জব্বার: গত ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ পলাতক আব্দুল জব্বারকে ট্রাইব্যুনাল আমৃত্যু কারাদণ্ড দিলে এর বিরুদ্ধে ২৫ মার্চ আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। মাহিদুর রহমান: চলতি বছরের ২০ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজাকার মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। মাহিদুর খালাস চেয়ে ১৭ জুন আপিল করলেও চুটু আপিল করেননি বলে জানান তাদের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান। ফোরকান মল্লিক: গত ১৬ জুলাই পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের রাজাকার ফোরকান মল্লিককে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২, যার বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে বলে প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল জানান। সিরাজ-আকরাম: চলতি বছরের ১১ অগাস্ট বাগেরহাটের রাজাকার নেতা শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে মৃত্যুদণ্ড ও খান আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে নির্ধারিত ৩০ দিনের মধ্যে আকরাম আপিল করেছেন বলে তার আইনজীবী গাজী এম এইচ তানিম জানিয়েছেন। সিরাজ মাস্টারও আপিল করেছেন বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর তাপস। আপিল করেননি ৫ দণ্ডপ্রাপ্ত চারটি যুদ্ধাপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া পলাতক পাঁচ আসামি আপিল করেননি। এরা হলেন- ফরিদপুরের সাবেক জামায়াত নেতা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, আলবদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান, ফরিদপুরের নগরকান্দার বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন রাজাকার এবংকিশোরগঞ্জের রাজাকার সৈয়দ মো. হাসান আলী। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরিতকরণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। কাজে গতি আনতে মাঝে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে দুটি করা হলেও মামলার সংখ্যা কমে যাওয়ায় চলতি বছর সেপ্টেম্বরে একটি বন্ধ করে দওয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল থেকে এ পর্যন্ত ২১টি রায় এসেছে, যার মধ্যে চলতি বছর এসেছে ছয়টি। এর বাইরে ছয়টি মামলা বিচারের পর্যায়ে এবং তিনটি তদন্ত শেষে বিচার শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে যে ক’টি মামলার রায় এসেছে তার মধ্য থেকে ১৭টির বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। এর মধ্যে চার যুদ্ধাপরাধীর আপিল ও রিভিউ নিষ্পত্তির পর ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে। এছাড়া আরেক যুদ্ধাপরাধীর মামলায় আপিল বিভাগে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় হলেও তার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত না হওয়ায় রিভিউ পর্যায়ে যায়নি। এর আগে আপিল শুনানির পর্যায়ে এলেও মারা যাওয়ায় জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমের আপিল ‘অকার্যকর’ হয়ে যায় এবং বাদ পড়ে। নিষ্পত্তি ৭, কার্যকর ৪ ট্রাইব্যুনালের দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে করা সাতটি আপিলের নিষ্পত্তি হয়েছে এ পর্যন্ত। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ বহাল থাকলে ওই বছর ১২ ডিসেম্বর দণ্ড কার্যকর করা হয়। ঠিক এক বছর পর আপিলের দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত না হওয়ায় রিভিউ নিষ্পত্তি হয়নি। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগের তৃতীয় রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকলে ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সর্বশেষ আপিল বিভাগে সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকায় রিভিউ নিষ্পত্তির পর বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় রোববার প্রথম প্রহরে। চলতি বছর ১৬ জুন মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল রেখে আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। পরে ১৮ নভেম্বর তার সর্বোচ্চ সাজার রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করা হয়। একইদিন খারিজ হয় সালাউদ্দিন কাদেরের রিভিউ আবেদনও। ২৯ জুলাই আপিল বিভাগ সাকার ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে রায় দিয়েছিল।