শিক্ষকের চপেটাঘাতের অপমান সহ্য করতে না পেরে নারায়ণগঞ্জ শহরের গণবিদ্যা নিকেতন স্কুলের ছাত্রী উম্মে হাবিবা শ্রাবণীর আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক কামরুল হাসান মুন্নাকে বহিষ্কার করেছে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি। একই ঘটনায় অভিযুক্ত স্কুলের শিক্ষিকা নাসিরন বেগমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্কুলের শিক্ষক মিলনায়তনে কয়েক ঘণ্টার সভায় সব সদস্যের সম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উম্মে হাবিবা শ্রাবণী গণবিদ্যা নিকেতন স্কুলের নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় ছাত্রী। মেধাবী এই ছাত্রী নারায়ণগঞ্জ শহরের নিতাইগঞ্জ ছালাপট্টি এলাকার মো. হাবিবউল্লার মেয়ে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে শ্রাবণী দ্বিতীয়।
ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক সদস্য আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টার সভায় ম্যানেজিং কমিটির সব সদস্যের সম্মতিক্রমে প্রাথমিকভাবে খণ্ডকালীন শিক্ষক কামরুল হাসান মুন্নাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পরীক্ষা চলাকালীন পরিদর্শক ও স্কুলের শিক্ষিকা নাসরিন বেগমকে ঘটনার কারণ লিখিত আকারে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু ওই ছাত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি সেহেতু আমরা তাদের দোষী বলতে পারি না। তবে ঘটনার দিন যা ঘটেছে তার ওপর ভিত্তি করে প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
গণবিদ্যা নিকেতনের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন মুকুল বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো অভিযোগ না দেয়ায় এবং ওই ছাত্রীর লিখে যাওয়া চিঠির ওপর ভিত্তি করে কামরুল হাসান মুন্নাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষিকা নাসির বেগমকে ওইদিনের ঘটনা লিখিতভাবে জানানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ওই ছাত্রীর পরিবারের লোকজন গ্রামের বাড়িতে থাকায় কয়েকদিন পর অনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলে শোকসভা, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও ওই পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দিলে কামরুল হাসান মুন্নাকে চাকরিচ্যুত করা হবে।
সভায় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সচিব ও স্কুলের প্রধান শিক্ষক এমএ কাইয়ুম, শিক্ষক প্রতিনিধি মাওলানা মাঈনুদ্দিন, মজিবুর রহমান ভূঁইয়া, নারী শিক্ষিকা প্রতিনিধি জাহানারা বেগম, অভিভাবক সদস্য মো. আরজু আহমেদ, নুরুল ইসলাম, সদস্য শফি হোসেন মোল্লা, হেনা খান, জানে আলম প্রমুখ।
আত্মহত্যার নেপথ্যে
গত বৃহস্পতিবার শহরের গণবিদ্যা নিকেতন স্কুলের বার্ষিক পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উম্মে হাবিবা শ্রাবণী। পরীক্ষা চলাকালীন অসদুপায় (নকল) অবলম্বনের অভিযোগে পরীক্ষার পরিদর্শক নাসরিন বেগম তাকে আটক করে স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকের কাছে নিয়ে যান। এ সময় ওই কক্ষে থাকা স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক কামরুল হাসান মুন্না শ্রাবণীকে উপর্যুপরি চড় থাপ্পড় মারেন এবং তার পরিবারের কাছে অভিযোগ করবে বলে জানান। একপর্যায়ে ওইদিনের পরীক্ষা থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এ অপমান সইতে না পেরে ওইদিন রাতে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে শ্রাবণী। আত্মহত্যার আগে সে একটি চিরকুটও লিখে যায়। চিরকুটে সে তার মাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে- ‘প্রিয় মা, আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী আমাদের স্কুলের নাসরিন মিস। সে বিনা কারণে আমার পরীক্ষা দেয়াটা বাতিল করে দিছে। মা আমি তাদেরকে অনেক বলেছি, কিন্তু কেউ আমার কথা শুনে নাই। মা মুন্না স্যার বিনা কারণে আমারে মারছে। পুরা স্কুল আমারে নিয়া হাসাহাসি করতাছে। মা আমি এটি সহ্য করতে পারি নাই। তাই আমি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলাম। মা যদি পারেন আমারে মাফ করে দিয়ে জুয়েল ভাইরে বইলেন আমারে মাফ করে দিতে। ইতি-হাবিবা।’ চিরকুটের শেষাংশে তার মাকে উদ্দেশ্য করে লেখা ছিল- ‘মা আমারে কাটাছেঁড়া করতে না কইরেন’।
শুক্রবার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ শহরের ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে উম্মে হাবিবা শ্রাবণীর ময়নাতদন্ত শেষে লাশ তারা গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।
শ্রাবণীর পরিবার যা বলছে
এদিকে শ্রাবণীর বাবা হাবিবউল্লাহ জানান, তারা নারায়ণগঞ্জে এসে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। সকাল সাড়ে ৯টায় স্কুলের যাওয়ার আগে ও রিকশা ভাড়ার জন্য ১০ টাকা চেয়ে নেয়। আর পরীক্ষার জন্য দোয়া চায়। এরপর আর কোনো কথা হয়নি। সকালে ও স্কুলে চলে যায়, আমি ও ওর মা (সেতারা বেগম) জমি সংক্রান্ত কাজে সোনারগাঁ যাই। সেখানে আড়াইটা বেজে যায়। তারপরও কাজ শেষ করতে পারিনি। এর কিছুক্ষণ পর পর বাসা থেকে ফোন আসে শ্রাবণী ফাঁসি দিয়েছে। পরে নারায়ণগঞ্জে ফিরে এসে হাসপাতালে মেয়ের লাশ পাই। আমার মেয়ে খারাপ ছাত্রী ছিল না। সে কোনো অপরাধ করলে আমাদের বলতো। আমার মেয়ে অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করছে।
মা সেতারা বেগম বলেন, আমার মেয়ে লিখে গেছে, ‘প্রিয় মা আমারে মাফ করে দিও। স্যারের অপমানে এ কাজ করেছি। আমার মায়েরে সুইসাইড করতে বাধ্য করছে ওই স্যারেরা।’
শ্রাবণীর মামাতো ভাই জনি বলেন, সে স্কুলে কোনো অপরাধ করলে অবশ্যই তার পরিবারকে জানাতে পারতো। এভাবে একটি মেয়েকে অপমান করার কোনো নিয়ম নেই। শ্রাবণীর মৃত্যুর জন্য স্কুলের ওই দুই শিক্ষকই দায়ী। তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।’
শ্রাবণীর আত্মীয় নুরুল ইসলাম বলেন, ওই শিক্ষকদের শাস্তি দাবি করছি, যাতে কোনো মেয়েকে এমন অপমান না করতে পারে। ওই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি এম এ মালেক জানান, শ্রাবণীর ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। যদি পরিবারের লোকজন কোনো অভিযোগ করে তাহলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।