হিরো’ বলেই সবার কাছে পরিচিত তাসকিন। তবে এই নামটির আবিষ্কারক মাশরাফি নিজেই। মাশরাফি ছাড়াও পরিচিত অনেক সাংবাদিক তাসকিনকে হিরো নামেই ডাকেন। ছোট ভাইয়ের মতো তাসকিনকে আদরের পাশাপাশি শাসন করেন মাশরাফি। তাসকিনও তাকে বড় ভাইয়ের মতোই মনে করেনে। তাসকিন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি মাশরাফি ভাইয়ের মতো ভালো মানুষ হতে চাই। বড় ক্রিকেটার হয়ে কি হবে, যদি ভালো মানুষই না হতে পারি।’
মাশরাফি কেমন মানুষ সেটা নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে প্রত্যেকটা তরুণ ক্রিকেটার কিভাবে মাশরাফির উপর নির্ভরশীল সেটা জানার প্রয়োজন আছে। মাশরাফিও তাদের প্রত্যেককে ছোট ভাইয়ের মতো আদর-শাসন করে। সেই মাশরাফি তার ‘হিরো’র নিষেধাজ্ঞায় কাঁদলেন। সবাইকে কাঁদালেন।
এশিয়া কাপে তাসকিনকে দলে নিতে অনাগ্রহ দেখিয়েছিল নির্বাচক প্যানেল! কিন্তু মাশরাফির কথায় তাসকিনকে স্কোয়াডে জায়গা করে দেন নির্বাচকরা। মাশরাফির আস্থার প্রতিদান দিতে এতোটুকু দেরি করেননি তাসকিন। বড় ভাইয়ের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।
শনিবার তরুণ তাসকিনকে ভয়ংকর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হল। আইসিসি তাসকিনের বোলিং অ্যাকশন অবৈধ ঘোষণা করে। বিশ্বমঞ্চে এরকম এক ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। পুরো বাংলাদেশ দল হতভম্ব।
সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি বিন মুর্তজা সচরাচর প্রাণবন্ত থাকেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সোমবারের ম্যাচের আগে মাশরাফি ছিলেন একেবারেই ভিন্ন। মুখে কথা আটকে যাচ্ছিল। জড়তা কাজ করছিল। বারবার ক্যামেরায় মুখ লুকাচ্ছিলেন। ২৫ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফিকে এর আগে কখনও এমনটা দেখা যায়নি। সংবাদ সম্মেলনের পুরোটা সময়েই তাসকিনকে নিয়ে প্রশ্ন। মাশরাফিও উত্তর দিচ্ছিলেন। কিন্তু কোনও উত্তরই শেষ করতে পারছিলেন না তিনি।
তাসকিনকে নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস তাসকিনের বোলিং অ্যাকশন সম্পূর্ণ বৈধ। আমি যাকে নিয়ে কথা বলছি সে আগামী ১০ বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে সার্ভিস দিবে। যে ছেলেটা শেষ আটটি ম্যাচ আমাদের হয়ে দারুণ শুরু করেছে, আমাদের জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছে তাকে ছাড়া আমাদের নামতে হচ্ছে কালকের (রবিবার) ম্যাচে। এটা আমাদের জন্যে বড় আঘাত। এটা এমন একটা সময় আমাদের কাছে এসেছে যখন ওদের ম্যানেজ করা আমাদের জন্যে কঠিন।’
সংবাদ সম্মেলনের শেষে মঞ্চ থেকে নামতে নামতে মাশরাফি অঝোরে কেঁদেই ফেললেন। চোখ মুছলেন জার্সি দিয়ে। মাশরাফি ও ম্যানেজার সুজন বাদে পুরো দল চলে গিয়েছিল টিম বাসে। মাশরাফির হোটেলে ফেরার ব্যবস্থা ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজনের সঙ্গে গাড়িতে। সেই গাড়িতেও অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি বাংলাদেশের অধিনায়ক। নড়াইল এক্সপ্রেসকে সান্ত্বনা দিয়েও থামাতে পারছিলেন না সুজন।
বাইরে থেকে সাংবাদিকরাও সাহস দিচ্ছিলেন। কিন্তু তার কান্না যেন থামার নয়। কারণ এটি বেদনাহত, হৃদয় চূর্ণ হওয়ার অশ্রু। সংবরণের চেষ্টা সেখানে ব্যর্থ অস্ত্র। ভারতের প্রসিদ্ধ বাংলা দৈনিক বর্তমানের সিনিয়র সাংবাদিক রবীন্দ্র চৌধুরী জয়। কলকাতার মানুষ। মাশরাফির কান্না দেখে রীতিমতো হাউমাউ করেই কেঁদে উঠলেন এ বাঙালি। বারবার বলছিলেন, ‘এমন দৃশ্য আমি জীবনেও দেখিনি রে ভাই। দলের খেলোয়াড়দের জন্য এমন টান, এমন ভালোবাসা কোথাও দেখিনি। ক্রিকেট ইতিহাসে এ ঘটনা কোথাও হয়নি।’
মাশরাফিকে নিয়ে গাড়িটা হুট করে হুইসেল দিয়ে চলে গেল। তার প্রস্থানের পরও সেই আবহের রেশ কাটেনি চেন্নাস্বামীতে। সবার মুখে মুখে ফিরছিল সিংহহৃদয়, দেশপ্রেমে অন্তঃপ্রাণ, সতীর্থদের আপন ভাইয়ের মতো আগলে রাখা মাশরাফির অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা।