ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আশ্রায়ণ প্রকল্প-২ নিয়ে অনিয়মের ছড়াছড়ি

: Newsdesk ,স্বদেশ নিউজ২৪.কম
: ৬ years ago
আশ্রায়ণ, প্রকল্প, দুর্নীতি, ঘর, Ashrayan, project, corruption, house, rtvonline

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলায় আশ্রায়ণ-২ প্রকল্প নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এই প্রকল্পের আওতায় যার জমি আছে ঘর নেই তার নিজ জমিতে গৃহনির্মাণ করে দিচ্ছে সরকার। দুইশ’ ৫৬ বর্গফুট আয়তনের প্রতিটি টিনের ঘর নির্মাণে সরকারের বরাদ্দ এক লাখ টাকা।একেকটি ঘরের জন্যে উপকরণ হিসেবে ধরা হয়েছে ঘর ও বারান্দার জন্যে সাড়ে পাঁচ বান্ডিল টিন, কাঠ ১৮ সেফটি, ইট সাড়ে পাঁচশ’, সিমেন্ট ১০ বস্তা, বালু ও সুড়কি ৫০ ফুট করে।ভালো মানের টিন, কাঠ ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী দিয়েই প্রকল্প সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন।টিন ছাড়া বাকি সব উপকরণই নিম্নমানের বলে অভিযোগ করেন ঘর পাওয়া লোকজন। তাছাড়া উপকরণ পরিমাণেও দেয়া হচ্ছে কম।কোনও কোনও এলাকায় ঘরের উপকরণ নিজ খরচে উপকারভোগী মানুষকে তার জমি পর্যন্ত টেনে নিতে হচ্ছে।কোথাও কোথাও নির্মাণ সামগ্রীও কিনে দিতে হচ্ছে ঘর পাওয়া দরিদ্র লোকজনকে। ঘর পেতে ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারকে দিতে হয়েছে টাকা। ঘর পাওয়া লোকের তালিকাতেও আছে অনিয়ম। ঘর আছে, অবস্থা ভালো, এমন লোকও পেয়েছে ঘর। ইউপি সদস্যরা নিজেও পরিবারের সদস্যদের নামে ঘর বাগিয়েছেন।একজনের নামে বরাদ্দ ঘর আরেকজনের বাড়িতে উঠানো হচ্ছে। জেলার সাতটি উপজেলায় এখন পর্যন্ত দুই হাজার পাঁচশ’ ৬০টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।এরমধ্যে সরাইল উপজেলায় একশ’ ৬২, নাসিরনগর উপজেলায় চারশ’ ৭৬, কসবা উপজেলায় দুইশ’ ২২, বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ৫০, সদর উপজেলায় পাঁচশ’ ১২, বিজয়নগর উপজেলায় চারশ’ ৮৭ এবং নবীনগর উপজেলায় ছয়শ’ ৫১টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়।নবীনগরের একটি ইউনিয়ন বিদ্যাকুটে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আড়াইশটি ঘর। আখাউড়া ও আশুগঞ্জ উপজেলায় কোনও ঘর বরাদ্দ হয়নি এখন পর্যন্ত।এসব উপজেলার কোনও কোনওটিতে ঘর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কোনও কোনও উপজেলায় কাজ শুরু হয়েছে।সরেজমিনে কয়েকটি উপজেলায় গিয়ে দেখা গেছে, সুবিধাভোগীদের তালিকা করা থেকে শুরু করে ঘর নির্মাণ করা পর্যন্ত পদে পদে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।জেলার বিজয়নগর উপজেলার সিংগারবিল ও চম্পকনগর ইউনিয়নে ঘর নির্মাণ কাজ শুরু হয় প্রথমে। এরপরই এই দুই ইউনিয়নের স্বচ্ছল ও জনপ্রতিনিধিদের নিজস্ব লোকজন ঘর পেয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে।এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী আফরোজ এবং ওই দুই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া ও হামিদুল হকের বিরুদ্ধে প্রকৃত ঘরহীন মানুষের পক্ষে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়।সিংগারবিল ইউনিয়নের দৌলতকান্দি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সরকারের দেয়া ঘরে বসবাস করছেন ঘর পাওয়া পরিবারগুলো। তাদের একজন দিনমজুর আবদুল আউয়াল। কিন্তু ঘর পেয়েও খুশি নন তিনি।তার অভিযোগ ঘরের টিন ভালো হলেও ইট, সুড়কি, কাঠ কোনোটাই ভালো দেয়া হয়নি। কাঠে (মেহগনি) এখনই ঘুন ধরা শুরু হয়েছে। ঘরের মেঝের কাজও ভালো হয়নি।তার আরও অভিযোগ চেয়ারম্যান নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ঘর এনেছেন বলে চেয়ারম্যানের লোক আবু তাহের তার কাছে পাঁচ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে সুদে তিন হাজার টাকা এনে দেন তিনি।এখানকার পূর্ব হাটির সজিব জানান, ফ্লোর ঢালাইয়ে সিমেন্ট কম দেয়া হয়েছে।পুরো ঢালাইয়ে দেড় বস্তা সিমেন্ট দেয়া হয়েছে। যে ইট লাগানো হয়েছে সেগুলোও দুই নম্বর।দৌলতবাড়ির রোকেয়া বেগম আগে ঘর থাকার পরও ঘর পেয়েছেন। সিংগারবিল ইউনিয়নে মোট ৯৪টি ঘর বরাদ্দ হয়েছে বলে জানান ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া।এর মধ্যে ১০-১৫টি ছাড়া বাকি সবগুলোর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে এজন্য কারও কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে চেয়ারম্যান বলেন এরচেয়ে মরে যাওয়া ভালো। টাকা নিয়েছি এমন রেকর্ড নেই। কারও কাছ থেকে এক টাকাও নেয়া হয়নি।চম্পকনগর ইউনিয়নের গেরারগাঁও গ্রামের বৃদ্ধ আবুল কাশেমের জমিতে ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। তার ঘরে লাগানো ১২টি খুঁটির মধ্যে দুটি খুঁটি ভাঙা। এগুলো ঠিকাদার জোড়াতালি দিয়েছেন বাঁশ কাঠ দিয়ে।আবুল কাশেম অভিযোগ করেন ঘরের আধা কাজ করে ফেলে রেখেছে। তারা আসে না, ঘরও ঠিক করে দেয় না। তিনি বলেন, যে ইট দেয়া হয়েছে সেগুলো ধরলে ভেঙে পড়ে।এই গ্রামের বাকশক্তিহীন মো. আবদুল খালেক পেয়েছেন ঘর। তার ঘরের চাল ও বেড়া লাগেনি এখনও। তার ভাই আবদুল কুদ্দুস জানান, ভিটের বালু নিজেরা কিনে এনেছেন। ইট পরিবহনের আড়াইশ টাকা, কাঠ আনার খরচ বাবদ সাড়ে তিনশ’ টাকা, পালা আনার খরচ দুইশ টাকা তারাই দিয়েছেন।কুদ্দুস আরও জানান,  ঘরের কাঠ নিম্নমানের। লোহা মারলে সেগুলো ফেটে যায়। রোদে থেকে কাঠ বেঁকেও গেছে। তার মতে ছয় মাসও ঘর টিকবে না।এই ইউনিয়নের পেটুয়াজুড়ি গ্রামের মিজান পেয়েছেন ঘর। চান্দুরা-আখাউড়া সড়কের পাশেই তার বাড়ি। মিজানের বাবা আবদুল হাই ও তার স্ত্রী মর্জিনা বেগম জানান, ঘর বানাতে আসা লোকজন তাদের দিয়ে তিন বস্তা সিমেন্ট ও একশ’ ইট কিনিয়েছেন। কাঠ আনার টাকা এবং অন্যান্য মালপত্র আনার ভাড়া তারাই দিয়েছেন। মিস্ত্রীর মজুরি আর খাবার দিতে হয়েছে তাদেরকেই। সব মিলিয়ে তাদের খরচ ১০ হাজার টাকা।এই গ্রামের আলাউদ্দিনের ঘরের কাজ অসমাপ্ত আছে দীর্ঘদিন ধরে। ভিট আর কাঠের কাজ হয়েছে।আলাউদ্দিন জানান, অনেকদিন ধরেই এভাবে পড়ে রয়েছে। ভিট করা হয়েছে চার মাস আগে। কিন্তু এখনও চাল ও বেড়া আসেনি।তবে কাজের ঠিকাদার হারুনুর রশিদ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা নিম্নমানের মালামাল দিচ্ছি না।চম্পকনগর ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পেটুয়াজুড়ি গ্রামের ওবায়দুল হক তার চাচাতো ভাই সেলিম মিয়া, ফুফাতো ভাই আবেদ আলী, চাচাতো ভাইয়ের বউ জোহরা বেগম এবং চাচা অহিদ মিয়ার নামে ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন।এ বিষয়ে ওবায়দুল হক বলেন, আত্মীয় হবে কেন। যাদের দরকার তাদের দিয়েছি।এই উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সদর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. মাহবুব আলম বলেন, তালিকা হয়েছে অনেক আগে। তালিকায় ত্রুটি থাকলে আমরা বাদ দিয়ে দিচ্ছি। বিজয়নগরে এমন একশ’ জনকে বাদ দেয়া হয়েছে।উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলী আফরোজ বলেন, যখনই অনিয়মের অভিযোগ এসেছে তখনই ব্যবস্থা নিয়েছি। বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বাররা টাকা নিচ্ছে কিনা এ বিষয়ে তার কাছে কোনও অভিযোগ নেই।