রাজধানীর মিরপুরের আল-হেলাল স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চিকিৎসাসেবার নামে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। মিসেস রোকেয়া বেগম নামের ৮০ বছর বয়সী এক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার নামে প্রতারণা করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার ছেলে কামরুল হাসান মোহন।
রোগীর ছেলের সঙ্গে কথা বলে ও টাকা দেওয়ার রশিদ থেকে জানা যায়, শুধু নার্সিংয়ের জন্য রোকেয়া বেগমকে আল-হেলাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দৈনিক সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ হাজার টাকা খরচের কথা বলে ভর্তি করা হলেও ১০ দিনে বিল আসে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫ টাকা। শুধু মেডিকেল গ্যাসের (বিশেষ করে অক্সিজেন) বিলই এসেছে ২৭ হাজার ১৫০ টাকা। কার্ডিয়াক মনিটরিং বিল ১০ হাজার ৭৫০ টাকা। বিনা প্রয়োজনে প্রতারণা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ টাকা আদায় করেছে বলে অভিযোগ করেছেন কামরুল ইসলাম মোহন।
রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকার বাসিন্দা মোহন বলেন, ‘বিভিন্ন জটিল শারীরিক সমস্যার কারণে এ বছরের ১৪ মার্চ আমার মাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করি। স্কয়ারে নিউরোলজি, কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি বিভাগের তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে তিনি চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। একপর্যায়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, আপনার মাকে বাড়িতে নিয়ে যান। আর কোনো চিকিৎসাই তার জন্য প্রযোজ্য নয়। ইচ্ছা করলে আপনারা তাকে হসপাতালে রাখতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে অনেক অর্থ ব্যয় হবে কিন্তু তার জন্য নতুন করে আর কোনো ধরনের চিকিৎসা নেই।’
স্কয়ারের চিকিৎসকদের কাছ থেকে এ কথা শোনার পর খুবই কষ্ট পান জানিয়ে মোহন আরও বলেন, ‘এরপর পরিবারের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেই মাকে বাসায় না এনে কম খরচে বাসার আশপাশের কোনো হাসপাতালে রাখব, যাতে তার সেবার কোনো ঘাটতি না হয়। এ সিদ্ধান্ত থেকে আমরা মিরপুরের আল-হেলাল স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলি। তাদের জানাই, আমাদের রোগীর জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসার দরকার নেই। চিকিৎসকদের মতে তার জন্য আর কোনো ধরনের চিকিৎসাও নেই। আমরা শুধু নার্সিংয়ের জন্য তাকে হাসপাতালে রাখতে চাই। সবকিছু শুনে আল-হেলাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের হাসপাতালে রোগী রাখতে হলে সিসিইউর (হৃদরোগের জন্য বিশেষ পরিচর্যাকেন্দ্র) জন্য দৈনিক সাড়ে ৪ হাজার টাকা, একজন ডিইটি ডাক্তারের জন্য দৈনিক ৩০০ টাকাসহ অন্যন্য খরচ বাবদ দৈনিক প্রায় ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার খরচ পড়বে। আমরা রাজি হই। ১৯ মার্চ তাকে স্কয়ার থেকে এনে আল-হেলাল হাসপাতালে ভর্তি করাই। কিন্তু ১০ দিনে হাসপাতালে বিল আসে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫ টাকা।’
হাসপাতালের বিল সম্পর্কে মোহন বলেন, ‘তারা (হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ) ১০ দিনে মেডিকেল গ্যাসের (বিশেষ করে অক্সিজেন) বিল ধরেছে ২৭ হাজার ১৫০ টাকা। কার্ডিয়াক মনিটরিং বিল ধরেছে ১০ হাজার ৭৫০ টাকা। প্রতিঘণ্টায় প্রতিলিটার অক্সিজেনের মূল্য ৩০ টাকা। সে হিসাবে আমার মায়ের যদি প্রতিঘণ্টায় ৪ লিটার করে অক্সিজেন লাগত, তাহলে ১০ দিনে ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন দিলে এ বিল আসার কথা। কিন্তু আমার মায়ের অক্সিজেন লেগেছে কদাচিৎ। এ ছাড়া যে রোগীর জন্য আর কোনো চিকিৎসাই প্রযোজ্য নয়, তার জন্য কার্ডিয়াক মনিটরিং করা নিরর্থক। তারা (হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ) আমার সঙ্গে প্রতারণা করে এ টাকা আদায় করেছে। অবশ্য ৭ হাজার ৪৫১ টাকা ডিসকাউন্টও দিয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু শামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন উল্লেখ করে মোহন আরও বলেন, ‘আমি ডা. শামীমকে বলি যে, আমার মাকে ভর্তির পূর্বে তো আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। আমি বলেছি তার জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসার দরকার নেই। তারপরও এত টাকা বিল এলো কিভাবে? তখন ডা. শামীম বলেন, সবকিছু মানতে গেলে তো আর ব্যবসা হয় না। এর চেয়ে (৭ হাজার ৪৫১ টাকা) আর কমানো যাবে না। আমি তাকে (ডা. শামীমকে) বোঝানোর চেষ্টা করি যে, আমার মায়ের এত অক্সিজেন লাগেনি আর তার মনিটরিংয়ের কোনো দরকার নেই। কিন্তু তিনি আমার কোনো কথাই শোনেননি।’
কামরুল হাসান মোহনের মা মিসেস রোকেয়া বেগমের চিকিৎসাসংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদন ও স্কয়ার হাসপাতাল থেকে দেওয়া ছাড়পত্র থেকে জানা যায়, রোকেয়া বেগমের ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক ও শরীরের বাম দিক অবশসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা ছিল। এ ছাড়াও তার কিডনি প্রায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল এবং গ্লাসগো কোমা স্কেল (জিসিএস) ছিল ১৫’র মধ্যে ৫, যা ৩-এ (এর নিচে নামে না) নামলেই রোগীকে মৃত ঘোষণা করা হয় বলে জানান চিকিৎসকরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘লাইফ সাপোর্টে, মনিটরিং, মেডিকেল টেস্ট ইত্যাদির নামে বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালই রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে থাকে। এটা এ দেশে নতুন কোনো বিষয় না। এ রোগীর ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সেবার নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে থাকতে পারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের এক চিকিৎসক একই শর্তে (নাম প্রকাশ না করা) বলেন, ‘চিকিৎসাসংক্রান্ত কাগজপত্র দেখে বোঝা যায়, রোগীর অবস্থা খুবই সিরিয়াস। তবে তার ২৪ ঘণ্টা বা কত সময় অক্সিজেন লেগেছে, তা বলা মুশকিল। কার্ডিয়াটিক মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। তবে আমাদের দেশে অনেক বেসরকারি হাসপাতালই চিকিৎসার নামে বাণিজ্য করে থাকে। এই রোগীর বেলায়ও এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।’
তবে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু শামীম অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘নিয়ম মেনেই রোগীর চিকিৎসা ও টাকা নেওয়া হয়েছে। তারপরও যদি রোগীর আত্মীয়স্বজনরা ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে তারা আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। তাহলে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা হবে।’
‘ভর্তির আগে রোগীর ছেলের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া ও টাকা কম নিলে ব্যবসা হয় না’ প্রসঙ্গে ডা. শামীম বলেন, ‘টাকা কম নিলে ব্যবসা হয় না এমন কোনো কথা আমি বলিনি। আর পূর্বে কথা বলার বিষয়টি আমার জানা নেই।’ – দ্য রি