এই পৃথিবীটা কেবল সাদা মানুষদের নয়; পৃথিবীটা বহুরঙা মানুষের। মানুষে মানুষে রঙে যে বৈচিত্র্য আ আদতে পৃথিবীর সৌন্দর্য্য। বৈচিত্র্য আর সাম্যের এই সুমহান বাণী নিয়ে জীবনভর লড়ে গেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী যে নেতা; আজ সেই নেলসন ম্যান্ডেলার ৯৬ তম জন্মদিন। বিশ্ববাসীর কাছে যিনি মাদিবা নামে পরিচিত।
ম্যান্ডেলা শুধু দক্ষিণ আফ্রিকারই নেতা নন। বিশ্বজনীন তিনি, সারাবিশ্বের মানুষের নেতা। তার আদর্শকে ধারণ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে বিশ্ব। বিশ্বব্যাপী শোক ও স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে পালিত হচ্ছে দিনটি।তার কারণ একটাই। ম্যান্ডেলা আজ আর আমাদের মাঝে নেই। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ২০১৩ সালের বছরের ৫ ডিসেম্বর ৯৫ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
এবারের ম্যান্ডেলা দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, “বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন শেষ হয়েছে। কিন্তু বিশ্বে এখনও হুমকি তৈরি করে রেখেছে দারিদ্র্য, বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, সংঘাতের মতো বৈরী বিষয়গুলো। নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস এসবের বিরুদ্ধে কাজে নামার আহ্বানের দিন। সমাজের বাস্তব সমস্যাগুলো দূর করার ব্যাপারে প্রত্যেককে আহ্বান জানানোর মাধ্যমে দিনটি পালন করতে পারি আমরা।”
১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই ম্যান্ডেলার জন্ম। ১৯৪৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আফ্রিকানদের দল ন্যাশনাল পার্টি জয়লাভ করে। দলটি বর্ণবাদ ও বিভিন্ন জাতিকে আলাদা করে রাখার পক্ষপাতি ছিল। এ প্রেক্ষাপটে ম্যান্ডেলা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫২ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৫ সালের জনগণের সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ সম্মেলনে মুক্তি সনদ প্রণয়ন করা হয়, যা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি।
১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ম্যান্ডেলাসহ ১৫০ জন বর্ণবাদবিরোধী কর্মীকে দেশদ্রোহিতার মামলায় গ্রেফতার করা হয়। ৫ বছর পর সব আসামি নির্দোষ প্রমাণিত হন। এ সময় বুঝতে পারেন অহিংস আন্দোলনে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। তাই ১৯৬১ সালে অন্যদের সঙ্গে গঠন করেন এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন উমখোন্তো উই সিযওয়ে (এমকে)। তিনি অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা পরিকল্পনা ও সমন্বয় করেন। এ ছাড়া বিদেশ থেকে টাকা যোগাড় ও সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য কাজ শুরু করেন। ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর দলটি বিভিন্ন অফিসে হামলা করে। তবে পরিকল্পনা ছিল কাউকে হতাহত না করা। তিনি সশস্ত্র আন্দোলনকে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে শেষ চেষ্টা বলে অভিহিত করেন। ১৯৮০ এর দশকে এমকে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। এতে অনেক বেসামরিক লোক হতাহত হয়। বর্ণবাদের অবসানের পরে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের রিপোর্ট থেকে এএনসির অনেক নেতা এ বিষয়ের তথ্য অপসারণ করতে চাইলে ম্যান্ডেলা তীব্র সমালোচনা করেন।
ম্যান্ডেলার মতো জেলে থাকার অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে বিরল। এএনসির প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে ১৯৬৩ সালের ১১ জুলাই গ্রেফতার হন। তাদের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। অন্তর্ঘাতের অভিযোগ স্বীকার করলেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগ অস্বীকার করেন। প্রিটোরিয়ার সুপ্রিম কোর্টে কাঠগড়ায় ১৯৬৪ সালের ২০ এপ্রিল জবানবন্দি দেন। ব্যাখ্যা করেন, কেন এএনসি সশস্ত্র আন্দোলন বেছে নিয়েছেন। বলেন, বহু বছর ধরে এএনসি অহিংস আন্দোলন চালিয়ে এসেছিল। কিন্তু শার্পভিলের গণহত্যার পর অহিংস আন্দোলনের পথ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। গণহত্যা, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারকে অবজ্ঞা করে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেওয়া, জরুরি অবস্থার ঘোষণা এবং এএনসিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরে অন্তর্ঘাতমূলক সশস্ত্র সংগ্রামকেই বেছে নেওয়া হয়। ১৯৬৪ সালের ১২ জুন সবাইকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তার সশ্রম কারাবাস শুরু হয় রবেন দ্বীপে। এখানে ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান। জেলে থাকার সময়ে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি বাড়তে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৮২ সালের মার্চ তাকে পোলস্মুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন রাষ্ট্রপতি পি ডব্লিউ বোথা ম্যান্ডেলাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেন। শর্তটি ছিল, তাকে সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ করতে হবে। ম্যান্ডেলা প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করেন। ম্যান্ডেলা ও ন্যাশনাল পার্টি সরকারের মধ্যকার প্রথম আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু এ সব আলোচনায় বিশেষ কিছু অগ্রগতি হয়নি।
১৯৮৮ সালে ম্যান্ডেলাকে ভিক্টর ভার্সটার কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত এখানেই বন্দি ছিলেন। এ সময় মুক্তির জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে চাপ বাড়তে থাকে। ১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রপতি বোথা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তার স্থলাভিষিক্ত হন ফ্রেডেরিক উইলেম ডি ক্লার্ক। ক্লার্ক ১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এএনসিসহ অন্যান্য বর্ণবাদবিরোধী সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়া হয়। কারামুক্তি সারাবিশ্বে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। মুক্তির দিনে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। শান্তি রক্ষা ও দেশের শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানান। আরও বলেন, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি।
কারামুক্তির পর এএনসির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯০ হতে ১৯৯৪ পর্যন্ত এ দলের নেতা ছিলেন। ১৯৯৪ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি জয়ী হন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।
চার দশকে ২৫০টিরও বেশি পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে রয়েছে এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্কের সঙ্গে যৌথভাবে ১৯৯৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার। এ ছাড়া ১৯৮৮ সালে শাখারভ পুরস্কারের অভিষেক পুরস্কারটি যৌথভাবে অর্জন করেন।
ম্যান্ডেলা ৩ বার বিয়ে করেন। তার ৬ সন্তান।
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে ম্যান্ডেলার ৬৭ বছরের সম্মানে ৬৭ মিনিট দাতব্য ও স্বেচ্ছাসেবাধর্মী কাজে ব্যয় করার কর্মসূচি পালন করা হবে জোহানেসবার্গে। দেশটির প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা দেশব্যাপী পরিচ্ছন্নতা অভিযানের ঘোষণা দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে দাতব্য অনুষ্ঠানেরও পরিকল্পনা করা হয়েছে।