দেশের সুষম উন্নয়নের অন্যতম শর্ত সহজ জ্বালানি শুবিধা নিশ্চিত করা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশাল ও খুলনার জনসভায় দেশের উত্তর ও দক্ষিণে অল্প সময়ের মধ্যেই গ্যাস সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বরিশাল, খুলনা ও রংপুর অঞ্চলে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে এরইমধ্যে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে উত্তর-দক্ষিণবাসীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণ হবে। ঘটবে শিল্প বিকাশ। পরিবর্তন আসবে জীবনযাত্রায়।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বরিশাল ও পটুয়াখালী সফর করেন। সে সময় তিনি দুই জেলায় ৫৪টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ৩৫টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে এক জনসভায় তিনি বরিশালবাসীদের গ্যাস দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ভোলায় পাওয়া নতুন গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পরপর ভোলা থেকে বরিশাল গ্যাস নেয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। এ জন্য প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার দুটি গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করবে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। ভোলা থেকে বরিশালে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকায় ২৮ ইঞ্চি ব্যাসের ৬৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পাইপলাইন বসবে।যা দিয়ে ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সম্ভব। লাইন নির্মাণের সময় ধরা হয়েছে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী গত ৩ মার্চ খুলনা সফর করেন। সেখানে ৫২টি প্রকল্প উদ্বোধন ও ৪৭টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের করেন। পরে বিকেলে খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেন। তিনি সেই ভাষণে খুলনাবাসীদের গ্যাস দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
একই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী খুলনায়ও গ্যাস নিতে ৬ হাজার ৪২৭ কোটি টাকার আরো তিনটি পাইপলাইন স্থাপন প্রকল্প হাতে নিয়েছে জিটিসিএল। গ্যাসের পাইপলাইনটির ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে বরিশাল থেকে খুলনায় যাবে। এ জন্য ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ১০৫ কিলোমিটার একটি পাইপলাইন বসবে। এক হাজার ৪৭১ কোটি টাকার এই পাইপলাইন সর্বোচ্চ ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সঞ্চালন করতে পারবে। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে।
ভোলার গ্যাস ছাড়াও আমদানি করা এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) পাইপলাইনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে যাবে। এলএনজি থেকে প্রাপ্ত গ্যাস নিতে খুলনা পর্যন্ত তিনটি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করবে জিটিসিএল। একটি হলো পায়রা বন্দর থেকে খুলনা পর্যন্ত। ২ হাজার ৭২৭ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসবে। যা ৭৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহে সক্ষম হবে। যার বাস্তবায়নকাল চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।
এছাড়া লাঙ্গলবন্দ থেকে মাওয়া এবং জাজিরা-গোপালগঞ্জ হয়ে খুলনা পর্যন্ত আরেকটি সঞ্চালন লাইন হবে। এতে ব্যয় হবে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ১৭৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই পাইপলাইন দিয়ে ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে। বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তৃতীয় পাইপলাইনটি হবে সাতক্ষীরার ভোমরা থেকে খুলনা পর্যন্ত। ৯শ` কোটি টাকার প্রকল্পটির মাধ্যমে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ৬০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। গ্যাস নিতে পারবে ৭০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত। বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এদিকে গ্যাসের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে উত্তরের রংপুরবাসী। অবশেষে তাদের সে দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। রংপুর বিভাগে গ্যাস সরবরাহের জন্য সঞ্চালন ও বিতরণ নেটওয়ার্ক নির্মাণে প্রায় ১৮শ`কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ-সংক্রান্ত উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) জ্বালানি বিভাগে পাঠিয়েছে জিটিসিএল।
বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের বগুড়া পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন রয়েছে। বগুড়া থেকে রংপুর বিভাগে গ্যাস নিতে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে জিটিসিএল। অর্থের উৎস ধরা হয়েছে জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল। সৈয়দপুর পর্যন্ত প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের আওতায় ২৪ ইঞ্চি ব্যাসের ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসবে। এই সঞ্চালন লাইন দিয়ে ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত।
রংপুর ও নীলফামারী জেলার বিভিন্ন অংশে এই গ্যাস সরবরাহের জন্য ১৬৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর আওতায় মোট ৭৫ কিলোমিটার বিতরণ লাইন বসবে। এর মধ্যে আট ইঞ্চি ব্যাসের ২৪ কিলোমিটার, ১০ ইঞ্চি ব্যাসের ৪ কিলোমিটার, ১২ ইঞ্চি ব্যাসের ২৫ কিলোমিটার এবং ১৬ ইঞ্চ ব্যাসের ৪২ কিলোমিটার লাইন স্থাপন করা হবে। জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের অর্থে এই পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
দ্বীপ জেলা ভোলার ভেদুরিয়ায় জানুয়ারিতে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এ ছাড়া এখানকার পুরনো শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রে মজুদও বেড়েছে। সব মিলিয়ে ভোলায় প্রায় দেড় ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রয়েছে। যা কাজে লাগানো হবে উত্তর-দক্ষিণবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি ও চাহিদায়।