আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত অপহরণ-খুনের মামলার আসামিরা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ১১ দিনেও মূল হোতা নূর হোসেনসহ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। আসামিরা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আত্মগোপনে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য জড়িত সন্দেহে ১৬ জনকে আটক করা হয়েছে। তবে অপহরণ-খুনের সঙ্গে তাদের সরাসরি জড়িত থাকার কোনো তথ্য-প্রমাণ এখন পর্যন্ত মেলেনি।
গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়া হয় সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার সহযোগী তাজুল, লিটন, স্বপন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীরকে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই একই জায়গা থেকে তুলে নেয়া হয় আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালককে। ঘটনার তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল নজরুলসহ ছয়জনের এবং পরদিন আরেকজনের লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে। অপহরণের পরপরই নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ তা নেয়নি। পরদিন ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ মামলা নথিভুক্ত করে।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, র্যাব পরিচয়ে তার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর এর মূল হোতা হচ্ছেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও কাউন্সিলর নূর হোসেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া, নূর হোসেনের সহযোগী ও হাসমত আলী ওরফে হাসু, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম রাজু, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আনোয়ার এবং বিএনপি সমর্থক ও নূর হোসেনের জমি ব্যবসার সহযোগী ইকবাল হোসেন।
মামলায় আরো অভিযোগ করা হয়, আসামিরা সবাই নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ এবং তারা এলাকায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জুয়াসহ নানা কার্যকলাপে জড়িত। এলাকার একটি রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে নজরুলকে হত্যার হুমকি দেয় নূর হোসেন। ঘটনার দিন একটি মামলার সাক্ষ্য দিতে গেলে নজরুলকে তুলে নিয়ে যান আসামিরা। মামলা দায়েরের পরই আসামিরা গা ঢাকা দেয়।
সূত্র জানায়, এর মধ্যে ইয়াসিন মিয়া বিদেশে পালিয়ে গেছে। নূর হোসেনসহ অন্য আসামিরা আত্মগোপন করেছেন। তারা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই-তিনজন নেতার আশ্রয়ে রয়েছেন। আর এ কারণেই পুলিশ ও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা তাদের গ্রেফতার করতে পারছে না। নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, আসামিরা দেশের বাইরে গেছে না দেশের কোথাও আত্মগোপন করেছে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই আমাদের কাছে। তবে আসামিদের সন্ধানে অভিযান চলছে।
গতকাল বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সাত অপহরণ-খুনের ঘটনায় তদন্ত প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। যে কোনো সময় অভিযুক্তদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি তিনি।
জানা গেছে, নূর হোসেনের শিমরাইলের বাড়িতে ৩ মে অভিযান চালিয়ে একটি রক্তমাখা মাইক্রোবাস জব্দ এবং ১৬ জনকে আটক করা হয়। ৪ মে শিমরাইলের জিএম গ্লাস ফ্যাক্টরির পেছন থেকে নূর হোসেনের ব্যবহৃত একটি প্রাইভেটকার উদ্ধার করা হয়। পরদিন অভিযান চালিয়ে পুলিশ নূর হোসেনের ভাইয়ের একটি শর্টগানসহ ৪টি অস্ত্র উদ্ধার করে।
র্যাব-১১ এর বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে সাতজনকে অপহরণ ও খুন করার অভিযোগ করেছেন নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম চেয়ারম্যান। এ ঘটনায় র্যাব-পুলিশসহ গোটা সরকারে তোলপাড় শুরু হয়। গত মঙ্গলবার নজরুলের স্ত্রী লিখিত অভিযোগও করেছেন নারায়ণগঞ্জের এসপির কাছে।
এদিকে অপহরণ-হত্যা মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে নারায়ণগঞ্জের গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক আবদুল আউয়াল এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এই তদন্ত কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য ১০ সদস্যের একটি কমিটি করেছে পুলিশ। র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় র্যাব সদর দফতর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডিআইজি আফতাব উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ঘটনা তদন্তে নিয়োজিত রয়েছে। ইতিমধ্যে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাইদ মাহমুদসহ তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের পর অবসরে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আসামিদের গ্রেফতার করতে পারছে না পুলিশ। তারা কোথায় আত্মগোপন করেছে তাও বলতে পারছে না পুলিশ।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আইনশৃক্সখলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যেই নূর হোসেন পালিয়েছে। পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকারও বলেছিলেন নারায়ণগঞ্জকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এতো নজরদারির মধ্যে আসামিরা কিভাবে পালিয়ে গেল। পুলিশের এ ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র।আ. বা.