চিত্রনায়িকা নাসিমা আক্তার নদী। পরনে উত্তেজক পোশাক। মহাখালীর গুলশান লিংক রোডে মাল্টিপ্ল্যান স্পোর্টস নামে বিভিন্ন ক্রীড়া সামগ্রীর একটি শোরুমে গিয়ে নিজেকে পরিচয় দেন ব্যস্ততম চিত্রনায়িকা হিসেবে। বেছে বেছে কেনেন ৭ লাখ টাকার পণ্য। তারপর সেগুলো গাড়িতে তোলেন। এর মধ্যে গাড়িও পাঠিয়ে দিয়েছেন বাসায়। দোকানিকে জানালেন, তার কাছে নগদ টাকা নেই, আছে অনেকগুলো ডলার। সেগুলো ভাঙিয়ে দাম পরিশোধ করতে হবে। এজন্য কারওয়ান বাজার অথবা গুলশানে যেতে হবে। ড্রাইভারকে ডেকে এনে পাঠিয়ে দেন ডলার ভাঙাতে। ততক্ষণে একটি প্রাইভেট কার এসে থামে ওই দোকানের সামনে। তাতে লাগানো ‘প্রেস’ লেখা স্টিকার। পাশে সাঁটানো বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাংলাভিশন’-এর লোগো। ওই গাড়ি থেকে দুই যুবক নেমে শোরুমে ঢুকে নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বলে, ‘ম্যাডাম একটু ঝামেলা হয়েছে। সাত রাস্তার মোড়ে আপনার গাড়ির চাকা পাংচার হয়েছে। ড্রাইভার টাকা নিয়ে আসতে পারছে না।’ নদী তখন দোকানের ব্যবস্থাপকের কাছে ৫০ হাজার টাকা চাইলেন। ওই টাকা হাতে পেয়েই হঠাৎ শোরুম থেকে বেরিয়ে ‘প্রেস’ লেখা গাড়িতে ওঠে পড়েন নায়িকা। এরপর রং-সাইড দিয়েই দ্রুতগতিতে গাড়িটি পালানোর চেষ্টা করে। দোকানের কর্মচারীরা ছিনতাইকারী বলে চিৎকার করে ধাওয়া করেন। গুলশান-১ নম্বরে কর্মরত ছিলেন এসআই আবদুল বারেক ও এসআই আবদুল মান্নান। তারা গাড়িটি থামাতে সক্ষম হন। অবস্থা বেগতিক দেখে নদী গাড়ি থেকে নেমে যান। এ সময় পুলিশ ও উপস্থিত জনতার মধ্যে কয়েকজন তার হাত ধরে আটকানোর চেষ্টা করেন। এ পরিস্থিতিতে নদী হঠাৎ করে যাকেই সামনে পাচ্ছিলেন তাকেই কামড়াতে শুরু করেন। কামড়ের ভয়ে পুলিশসহ অন্যরাও পিছু হটে যায়। সেই ফাঁকে অন্য একটি গাড়িতে উঠে পালিয়ে যান নদী। ভিড়ের মধ্যে সটকে পড়ে তার গাড়িচালকও। তবে পুলিশ টিভি চ্যানেলের লোগোসহ গাড়িটি আটক করে। আটক করা হয়েছে ‘ভুয়া সাংবাদিক’ পরিচয় দেয়া ওহিদুল ও ফারুককে। সিনেম্যাটিক এ ঘটনা ঘটেছে শনিবার দুপুরে।
আটককৃতরা হচ্ছে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলের চৈতট গ্রামের দুলাল হোসেনের পুত্র ফারুক হোসেন ও মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরের চরসিলই গ্রামের মোতালেব সরকারের পুত্র অহিদুল হোসেন। এসময় তাদের গাড়ি থেকে তের পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী, মেয়েদের বস্ত্র জব্দ করা হয়। ঘটনার পর থেকে নদী পলাতক।
পুলিশ জানায়, এক সময় অশ্লীল ছবিতে অভিনয়ের জন্য বিতর্কিত নায়িকা নদী এফডিসিতে বহু আগেই নিষিদ্ধ হয়েছেন। অভিনেতা মান্না ও শাকিব খানের সঙ্গে নায়িকা চরিত্রে বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয়ের সুযোগ হাতছাড়া হবার পরই নানা কৌশলে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন একটি প্রতারক চক্র। এই চক্রে বেশ কয়েকজন তরুণী ও যুবক রয়েছে।অর্থ উপার্জনের জন্য বেছে নেন ভিন্নপথ। মাদক ব্যবসার জন্য ইতিমধ্যে ইয়াবা সুন্দরী হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠেছে তার। নদীর আয়ের উৎস এখন নানাভাবে প্রতারণা ও মাদক ব্যবসা। এছাড়াও অর্থের বিনিময়ে বিত্তশালীদের প্রমোদ ভ্রমণের সঙ্গী হন তিনি। গত শনিবার নদীর দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের চার নম্বর সড়কের একটি বাসায় দীর্ঘদিন থেকে ভাড়া থাকেন নদী। তার স্বামী মারা গেছেন কয়েক মাস আগে। ওই বাসাতে নদী ও তার ছোট বোন হিসেবে পরিচিত একটি মেয়ে রয়েছে। কিন্তু গতকাল ওই বাসায় গিয়ে তা তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, নদীর বাসায় প্রতিদিনই লোকজন যাতায়াত করতো। ওই বাসার একজন ভাড়াটে জানান, প্রায়ই সন্ধ্যার পর কালো রঙের একটি গাড়িতে করে বের হতেন নদী। প্রায় রাতেই বাসায় ফিরতেন না তিনি। মাঝে মাঝে সঙ্গীদের গাড়িতে চড়তেন। তবে কোথায়, কাদের সঙ্গে যেতেন তা বলতে পারেননি তারা। বাসার নিরাপত্তকর্মী মুহাম্মদ হোসেন জানান, নদী দীর্ঘদিন থেকে এই বাসায় আছেন। তার আত্মীয় ও বন্ধুরা বাসায় যাতায়াত করতো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী ও চলচ্চিত্রের কয়েকজনের সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক রয়েছে নদীর। তাদের মাদক সেবনের নিরাপদ স্থান নদীর বাসা। এ প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনকি দেশের বাইরেও প্রমোদ ভ্রমণের সঙ্গী হন নদী। এক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে তিনি মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার বন্ধুদের সঙ্গে উপস্থিত থাকতেন নদী। এ চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা বিক্রি করেন নদী। নদী ও তার সঙ্গীরা মূলত ইয়াবার ডিলার। পরিচিতজনদের কাছে ইয়াবা সুন্দরী হিসেবেই পরিচিতি গড়ে উঠেছে তার।