চৌষট্টি বছর ধরে আমাদের এগিয়ে চলার অন্যতম অনুপ্রেরণা একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন। যাকে আশ্রয় করেই প্রতিদিনের চলা। এর চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। তবে আমাদের এ ‘অহংকারের’ প্রস্ফুটিত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি চলচ্চিত্র অঙ্গন। বাংলাদেশে স্বাধীনতার ছয় দশকে ছোট পরিসরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোন চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে এই শিল্পের গুণীজনদের মত, বর্তমানে দেশাত্ববোধের কমতি, রাজনৈতেক পটপরিবর্তন, ভাষার প্রতি অবহেলা আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মমতা সংকেটর কারণে এমনটা ঘটছে। তবে ভালো পরিবেশ, সরকারি ‘সুনজর’ আর দেশাত্ববোধ জাগ্রত করতে পারলে এই শিল্পের সুদিন আসবে বলেও মন্তব্য তাদের। যদিও ছোট আকারে কিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এছাড়া সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র নির্মাণে একধরনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও চলচ্চিত্রের পর্দায় এটি বলার মতো করে সেভাবে আজ পর্যন্ত উঠে আসেনি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে ১৯৭০ সালে নির্মিত হয়েছিল ধ্রুপদী এ চলচ্চিত্রটি। এখন পর্যন্ত চলচ্চিত্রে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্মারক হিসেবে বিবেচিত এই চলচ্চিত্রটি। প্রতিবারই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আগে কিংবা পরে ঘুরে-ফিরে আসে এ চলচ্চিত্র’র প্রসঙ্গ। এ ছবিতে একুশে ফেব্রুয়ারিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে প্রভাতফেরির একটি দৃশ্য রয়েছে। যা এ চলচ্চিত্রকে আরও বিখ্যাত করে তুলেছে। কিন্তু তারপরও সর্বোপরি একটি প্রশ্ন থেকে যায়? কি কারণে স্বাধীনতার ছয় দশক পেরিয়ে গেলেও ভাষা আন্দোলনের বিষয়ের উপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে না? বাংলাদেশের হৃদয়ে ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চলচ্চিত্র জগত সম্পর্কে প্রিয়.কমের সঙ্গে কথা বলেছেন নাট্যবাক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন, নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম এবং মুশফিকুর রহমান গুলজার। সৈয়দ হাসান ইমাম পাকিস্তান আমলে স্বাভাবিকভাবেই ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীক ছবি নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এরপর ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময়ে জনগণের শক্তিতে আমরা একটি ছবিই নির্মাণ করতে পেরেছিলাম। সেটি হল-‘জীবন থেকে নেওয়া’। এছাড়া ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি নির্মাণের আর কারও সাহস হয়নি। কারণ ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীক ছবি নির্মাণ করলে সেন্সরবোর্ড থেকে ছাড়পত্র পাবে বলে মনে হত না। এরপরই তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধ এমন একটি ব্যাপার যেটি ভাষা আন্দোলন থেকে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে করেন তিনি। হাসান ইমামের মতে, ‘মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রীক ছবি তৈরি হল ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। এরপর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পরে জিয়াউর রহমানের মৌখিক নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রীক ছবিগুলোর প্রদর্শন বন্ধ হয়ে গেল। এরপর এক ধরনের বিরূপ পরিবেশে আর কেউ সাহস করল না ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীক ছবি নির্মাণ করার জন্য।’ ‘পরবর্তীতে আবার পরিবেশ পরিবর্তিত হয়েছে। পুরোটাই রাজনৈতিক কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীক চলচ্চিত্র আমরা নির্মাণ করতে পারিনি। তবে এখন কিছু কিছু ছবি নির্মাণ হচ্ছে।’ আমজাদ হোসেন ‘সরকার চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য কোটি কোটি টাকা অনুদান দিচ্ছেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীক ছবি কিংবা তথ্যচিত্র কিন্তু সেভাবে নির্মাণ হচ্ছে না। যেটা হচ্ছে সেটিও মুষ্টিমেও। আর একটি বিষয় হল- মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের কথাই বলে থাকেন।কিন্তু বর্তমানে কোথাও কি ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের কোন চেতনা আছে? কোথাও কিছু নেই। ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলে যেভাবে চলছিলাম আমরা। এখনও সেভাবেই চলছি। বর্তমানে দেশাত্ববোধ, ভাষার প্রতি মমতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মমতা আমাদের মধ্যে কোন কিছুই নেই’। এমনটাই মনে করেন আমজাদ। এ চলচ্চিত্রকার বলেন, ‘সবকিছু কি আর আমার কথায় হবে? যারা দেশ চালাচ্ছে, যারা সরকার। তারাই বিষয়টি ভাল করে বলতে পারবেন। তারা নিশ্চয়ই আমার থেকে ভাল বুঝেন। সিনেমা মানে সৃষ্টি। নবযুগের সূচনা করা। যুদ্ধ হয়েছে সেটি দেখানোর জন্য যে ধরনের পরিবেশ দরকার। সে ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করেই ছবি নির্মাণ করতে হবে। আর এজন্য বাজেট তার থেকে বিষয়টিকে সর্বোপরি গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে ভাষাকে যেভাবে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারপরও কেউ কোন ধরনের প্রতিবাদ করছে না। যেন দেখেও না দেখার ভান করছে। আর বাকিরা কি-ই বা করবে? আর সেখানে প্রতিনিয়ত ভাষার বিকৃতি ঘটছে। সেজন্য কিছু হচ্ছে না।’ গিয়াস উদ্দিন সেলিম ‘আমি আসলে ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীক ছবি নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে কখনও ভাবি নাই। আর এ ধরনের প্রেক্ষাপট নিয়ে ছবি নির্মাণের যে ধরনের বাজেট দরকার সেটিও পাওয়া যায় না। কারণ ১৯৫২ সাল আর পুনরায় আবার পর্দায় ফুটিয়ে তোলা অতো সহজ কথা নয়। যেমন বাজেট নেই তেমনি এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণে যে ধরনের তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও জ্ঞানের দরকার সেটিরও ঘাটতির জায়গা রয়েছে’। ‘সরকার অনুদানের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্য যে ধরনের অর্থ প্রদান করে থাকেন। সেটি দিয়ে আসলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়। কারণ এ ধরনের প্রেক্ষাপট নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্য আড়াই কিংবা তিনকোটি টাকার দরকার। আর সেখানে অনুদানের টাকা দিয়ে আসলে কি হবে? একসাথে এতগুলো ছবি নির্মাণের জন্য টাকা না দিয়ে একটি কিংবা দুটি ছবি নির্মাণের জন্য টাকা দিলে ভাল হত।’ মুশফিকুর রহমান গুলজার ‘ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীক ছবির গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণে প্রযোজকরা সেভাবে এগিয়ে আসছেন না। আর একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমরা সাধারনত সেরকম সুন্দর গল্পও আমরা দেখি না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক গল্প আছে। এছাড়া সাধারণত ভাষা আন্দোলন নিয়ে যে গল্প কিংবা উপন্যাস রচিত হয়েছে। তা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহবোধটি অনেকের মধ্যেই নেই। এটি যেহেতু অলাভজনক একটি বিষয়।’ এ বিষয়ে সরকার কিংবা অন্যকোন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন মুশফিকুর রহমান গুলজার। ‘ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীক চলচ্চিত্র নির্মাণে কিছু চেষ্টা হয়েছে। তবে আমাদের চলচ্চিত্রের বিশাল যে ভাণ্ডার সেটি সমৃদ্ধ করতে পারেনি। প্রথমত উদ্যোগের অভাব, এরপর অর্থের অভাব। সরকার ছবি নির্মাণের জন্য অনুদান দিচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয় ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীক সেরকম কোন চিত্রনাট্য খুঁজে পাচ্ছেন না। ভাষা আন্দোলনের যে বিশাল ইতিহাস সেটির শেষ পরিণিতি এত বড় প্রেক্ষাপট তুলে ধরারও একটি বিষয় রয়েছে।