পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর হওয়া অস্থায়ী বিশেষ জজ আদালতে আজ বুধবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার শুনানি হয়েছে। মামলার আসামি কারাবন্দি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শুনানির সময় বলেছেন, তিনি খুবই অসুস্থ। তিনি আর আদালতে যেতে পারবেন না।
শুনানিকালে বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আক্তারুজ্জামানের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘জজ সাহেবের কাছে কোনো কথা বা নিবেদন করা যায় না। উনি তারিখ দিয়ে উঠে চলে যান। আমাদের কারো কথা শুনেন না। সরকারের হুকুমে এবং নির্দেশে তিনি সব কিছু পরিচালনা করছেন। আমার পায়ে ব্যথা। ডাক্তার আমাকে পা সব সময় উঁচু করে রাখতে বলেছেন। হাতেও প্রচণ্ড ব্যথা। আমাকে জোর করে এখানে আনা হয়েছে। আমি খুবই অসুস্থ। আমি ঘন ঘন কোনো হাজিরা দিতে পারব না। রায় তো লেখাই আছে। আমার হাত-পা প্যারালাইজড হয়ে যাচ্ছে। আপনাদের যা ইচ্ছা রায় দেন, যত খুশি সাজা দিয়ে দেন।’
আদালতে খালেদা জিয়া বলেন, ‘এখানে যে আদালত বসানো হয়েছে এবং প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তা আমার আইনজীবীরা জানেন না। এটা জানলে আমি আসতাম না। আদালত পরিবর্তন হলে কমপক্ষে সাতদিন আগে নোটিশ দিতে হয়। তা জানানো হয়নি। তড়িঘড়ি করে বিচারের জন্য এ কারাগারের ভেতরে আদালত বসানোর এ আয়োজন। মাননীয় আদালত, আমি জানি এ আদালতে আমি ন্যায়বিচার পাব না। সরকারের নির্দেশে এ কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। আমি আর এই আদালতে আসব না।’
এরপর পর্যবেক্ষক হিসেবে আদালতে উপস্থিত থাকা ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা খান আদালতকে বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত, আমি মনে করি যথাযথভাবে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের জানানো হয়নি। ৫০ ফুটের একটি ছোট কক্ষে এভাবে মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে– এখানে আইনজীবী সাংবাদিক কেউ বসতে পারছেন না। এত বড় মামলা কারাগারের ভেতরে পরিচালনা করা হবে তাও জানা ছিল না। দেশের ইতিহাসে এটি প্রথম। তাই প্রক্রিয়াটা যেহেতু যথাযথ হয়নি, মামলার কার্যক্রম মুলতবি করে যথার্থ তারিখ ও যথার্থ স্থানে নির্ধারণ করা হোক।’
এরপর আদালত মামলার পরবর্তী কার্যক্রম আগামী ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন। এ সময় পর্যন্ত এ মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন বহাল রাখেন আদালত।
এর আগে বেলা ১১টা ৭ মিনিটে ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আক্তারুজ্জামান আদালতে প্রবেশ করেন। তার আগে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে আইনজীবী ও সাংবাদিকরা প্রবেশ করেন। দুপুর ১২টা ১২ মিনিটে খালেদা জিয়াকে একটি হুইল চেয়ারে করে আদালতে আনা হয়। এরপর দুপুর ১২টা ২৩ মিনিটে আদালত শুরু হয়ে চলে আধা ঘণ্টারও কম সময়।
আদালতে কারাগার বসানো উপলক্ষে সকাল থেকে কারাগার এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা নেওয়া হয়। কারাগারের সামনের সড়কে যানবাহন ও সাধারণ মানুষের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারাগারের ফটকের সামনে নিরাপত্তা অন্যান্য দিনের চেয়ে আরো জোরদার করা হয়। গলির মুখে মুখেও ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বন্ধ ছিল ওই এলাকার দোকানপাট।
সকাল থেকে কারাগারের সামনে অবস্থান নেন গণমাধ্যমকর্মী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও নেতাকর্মীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি প্রস্তুত রাখা হয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের গাড়ি।
বিশেষ আদালত ৫-এর কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম সকাল সোয়া ১০টায় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এরই মধ্যে আসামি ও বাদীপক্ষের আইনজীবীদের বলে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের ছয়জন করে মোট ১২ জন কারা অভ্যন্তরে বসা আদালতে যেতে পারবেন। ছয়জন আইনজীবীর তালিকা জমা দেওয়ার জন্য আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলকে বলা হয়েছে।’
কারাগারে সাংবাদিকরা যেতে পারবেন। তবে সেখানে কোনো ক্যামেরাপারসন যেতে পারবেন না। সাংবাদিকদের মোবাইল ফোন রেখে শুধু পরিচয়পত্র (আইডিকার্ড) নিয়ে যেতে পারবেন বলে জানান তাজুল ইসলাম।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে কারা অভ্যন্তরে আদালত বসা নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। তবে একে ‘আইন পরিপন্থী’ বলেছেন খালেদা জিয়ার দল বিএনপি ও তাঁর আইনজীবীরা।
আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তাজনিত কারণে সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ জজ আদালত থেকে নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের কক্ষ নম্বর ৭-কে অস্থায়ী আদালত ঘোষণা করা হয়েছে। এখন থেকে সেখানেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হবে।
চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় মোট আসামি চারজন। খালেদা জিয়া ছাড়া অপর তিন আসামি হলেন—খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন মোট ৩২ জন।
২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা করা হয়। মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলাটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক হারুন-অর-রশীদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৫-এর বিচারক ড. আখতারুজ্জামান। এ মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ অন্য আসামিদের ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া অর্থদণ্ডও করা হয়। রায়ের পর খালেদা জিয়া রাজধানীর নাজিমুদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে সাজা ভোগ করছেন।