মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশে মানবাধিকার রক্ষায় যতটুকু সচেষ্ট ও সোচ্চার, তার চেয়ে বেশি সচেষ্ট ও সোচ্চার পরদেশে মানবাধিকার রক্ষায়। তাদের এ নীতি উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে প্রহসন মনে হলেও প্রবল পরাক্রমশালী বিধায় তাদের যে কোনো ধরনের আগ্রাসী অভিযান ওইসব দেশের জন্য কার্যকর প্রতিকারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। বিশ্ববাসীর বিস্মৃত হওয়ার কথা নয় গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুদের মিথ্যা অভিযোগ তুলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী কিভাবে ইরাক আক্রমণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। অনুরূপভাবে যে যুক্তরাষ্ট্র অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তালেবানদের মাধ্যমে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিতাড়িত করেছিল, সেই যুক্তরাষ্ট্রকেই পরবর্তীকালে দেখা গেছে যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে তালেনবানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হতে। যুক্তরাষ্ট্রের এসব কর্মকা- শুধু যে মানবাধিকারের চরম লংঘন তাই নয়, আন্তর্জাতিক আইনেরও নগ্ন উৎক্রমণ।
গণতন্ত্রের সঙ্গে মানবাধিকার নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক শাসনের অনুসারী হলেও একাধিক রাষ্ট্রে শুধ- নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে তারা রাজতন্ত্র ও সামরিক একনায়কতন্ত্র রক্ষা করে চলেছে। জঙ্গি, আল কায়দা ও তালেবান নির্মূলের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র বিগত এক দশক ধরে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন, ইয়েমেনসহ আরও অনেক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই একতরফাভাবে ড্রোন হামলা চালিয়ে মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্ব বিবেককে উপেক্ষা করে চলেছে।
এক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন আসে, কখন ও কী উদ্দেশ্যে ড্রোনের ব্যবহার বৈধ বা আইনসিদ্ধ? অধুনা আমরা ড্রোন বলতে বুঝি চালকবিহীন উড়োযান। ইংরেজিতে ড্রোনকে বলা হয় টঅঠ অর্থাৎ টহসধহহবফ অৎরবষ ঠবযরপষব. ড্রোন সামরিক ও বেসামরিক উভয় উদ্দেশ্যে ব্যবহƒত হয়। সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহƒত ড্রোন যুদ্ধাস্ত্র সংবলিত হয়ে থাকে। অপরদিকে অগ্নি নিয়ন্ত্রণ, পুলিশের পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম, বিরোধপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর সীমানা পর্যবেক্ষণ, বেসামরিক নিরাপত্তা কার্যক্রম যেমন গ্যাস বা তেলের পাইপলাইন পর্যবেক্ষণ প্রভৃতিতে বেসামরিক ড্রোন ব্যবহƒত হয়। যেসব অভিযান মানুষ চালিত যানের জন্য বিপজ্জনক, সেগুলোতে চালকবিহীন যানকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। মনুষ্যবিহীন ড্রোনে ক্যামেরা থাকে। এ ক্যামেরার মাধ্যমে গৃহীত ভিডিও চিত্র ভূমি থেকে বিমান নিয়ন্ত্রণকারী অপারেটরের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। আকাশসীমায় পর্যবেক্ষণ চালানো, নিজ দেশের আকাশসীমা পাহারা দেয়া, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, শত্র“দের বেতার ও রেডিও সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটানো, আড়ি পেতে তথ্য জোগাড় করা থেকে শুরু করে প্রয়োজনে আরও ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে পাইলটহীন এ বিমান। পাইলটের মৃত্যুঝুঁকি না থাকায় যে কোনো পরিস্থিতিতে এ বিমান ব্যবহার করা যায়।
মধ্যপ্রাচ্যে ১৯৭৩ সালের ওম কিপ্পোর যুদ্ধে মিসর ও সিরিয়া সোভিয়েত নির্মিত ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য মিসাইল ব্যবহার করে ইসরাইলি যুদ্ধবিমানের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করলে ইসরাইল সামরিক উদ্দেশ্যে চালকবিহীন ড্রোন ব্যবহার করে আশাব্যঞ্জক সফলতা পায়। ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধে চালকবিহীন ড্রোন ব্যবহার করে ইসরাইল যুদ্ধের শুরুতেই সিরিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এ যুদ্ধে ইসরাইলের কোনো বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি।
৮০ ও ৯০র দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্র উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ড্রোন উদ্ভাবনে সক্ষম হয়। বিগত বছরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ৫০টির মতো দেশ সামরিক ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে ড্রোন ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের পাশাপাশি ইরান ও চীনসহ প্রায় ২০টি দেশ নিজস্ব প্রযুক্তিতে অভিনব ড্রোন উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ড্রোন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। ছাত্রদের দাবিÑ এ ড্রোন দিয়ে সীমানা পাহারা ও তাৎক্ষণিকভাবে উপর থেকে ছবি তোলা সম্ভব হবে। তাছাড়া আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য জানা যাবে। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এটি ব্যবহার করে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজ করতে পারবে। আইন-শৃংখলা বাহিনী এটি ব্যবহার করে দেশের যে কোনো স্থান পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। রেলে যেভাবে নাশকতা বাড়ছে তাতে রেলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ড্রোন দিয়ে রেললাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। অর্থাৎ রেললাইনের পাহারার কাজ করবে ড্রোন।
২০০৪ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র পাক-আফগান সীমান্তে উপজাতি নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সন্ত্রাস নির্মূলের কথা বলে কয়েকশ ড্রোন হামলা চালালে সহস্রাধিকের কাছাকাছি ব্যক্তি নিহত হয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়ে আসছিল, নিহতদের সবাই জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কিন্তু তথ্যনির্ভর অনুসন্ধান সূত্র থেকে জানা যায়, নিহতদের অধিকাংশই নিরীহ সাধারণ নাগরিক, যারা মূলত কৃষিজীবী এবং তাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশুও রয়েছে। এমনও দেখা গেছে, প্রত্যুষে ফসলের মাঠে কাজ করাকালীন ড্রোন হামলার শিকার হয়ে অনেককে করুণ ও মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।
পাকিস্তানের উচ্চাদালত ড্রোন হামলাকে অবৈধ, অমানবিক এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন বললেও পাকিস্তানে অদ্যাবধি কিভাবে ড্রোন হামলা অব্যাহত আছে সে বিষয়টি রহস্যজনক। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক উভয় ধরনের সরকার কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছিল এবং একদিকে যখন তাদের দেশের আদালতের অবস্থান ড্রোন হামলার বিপক্ষে, ঠিক তখন দেখা গেল পাকিস্তানের অভ্যন্তরস্থ সামসি বিমান ঘাঁটি থেকে ড্রোন হামলা চালানো হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া নিজ দেশের বিমান ঘাঁটি থেকে নিজ দেশে ড্রোন হামলা চালানো কি সম্ভব? পাকিস্তানের আদালত ড্রোন হামলাকে ভূখ-ের অখ-তা লংঘন ও সন্ত্রাস নির্মূলে ক্ষতিকর উল্লেখ করলেও দেখা যায়, কোনো এক অজানা কারণে এখনও ড্রোন হামলায় ছেদ পড়েনি। পাকিস্তানসহ অন্য যেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে সেসব হামলাকে পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন হিসেবে দেখলেও তাতে মার্কিন প্রশাসনের কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। বরং তারা উল্টো দাবি করছে, আক্রমণ পদ্ধতি নির্দিষ্ট ও ফলদায়ক এবং এ কারণে আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন বলার অবকাশ নেই।
আন্তর্জাতিক আইন এবং যুদ্ধবিষয়ক জেনেভা কনভেনশনের অনুসৃত বিধান অনুযায়ী দুই বা ততধিক রাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে যুদ্ধে বিজড়িত হওয়ার আশংকা দেখা দিলে তা অবশ্যই প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে হতে হবে। আমাদের এ উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ বিবদমান অধিকাংশ রাষ্ট্রের মধ্যে যেসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, প্রকাশ্য ঘোষণা অথবা আক্রমণের অব্যবহিত পর যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ড্রোন হামলা কোনো ঘোষণা ছাড়াই গোপনে ও চুপিসারে অন্যের আকাশসীমা লংঘনপূর্বক আক্রমণ। এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের দাবিকৃত তথাকথিত নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর চেয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বেসামরিক লোক যে বেশি নিহত হয়েছে, এ বিষয়টি আজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠীর কাছে অজানা নয়।
কোনো দেশে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী থেকে থাকলে এবং তা সংশ্লিষ্ট দেশ বা অপর কোনো দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে থাকলে তাদের নির্মূলের দায়িত্ব একান্তভাবেই সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশ জঙ্গি বা সন্ত্রাস নির্মূলে ব্যর্থ হলে সে দেশের বৈধ সরকারের আমন্ত্রণে অপর কোনো দেশ জঙ্গি বা সন্ত্রাস নির্মূল কার্যক্রমে সে দেশকে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু তথাকথিত জঙ্গি বা সন্ত্রাস নির্মূলের নামে বিভিন্ন দেশে যেসব ড্রোন হামলা পরিচালিত হচ্ছে, তা আক্রান্ত দেশগুলোর সরকারের যথাযথ অনুমতি নিয়ে পরিচালনা করা হয়েছে, এমন দাবির পক্ষে দালিলিক প্রমাণ দেখানোর যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আক্রমণকারী রাষ্ট্রের হাতে আছে কি?
বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তাঘাট, শপিংমল, ট্রেন স্টেশন, বিমানবন্দর ইত্যাদি স্থানে বন্দুকধারীদের অতর্কিত হামলায় নারী-পুরুষ ও শিশুর সর্বাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এসব হামলার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তারা যদিও সন্ত্রাসী বা জঙ্গি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের অভ্যন্তরে নিজ নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত এসব হামলাকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করতে নারাজ। তারা এ ধরনের প্রতিটি হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখছে, যদিও এ ধরনের হামলায় নিহতের সংখ্যা ক্রম ঊর্ধ্বমুখী।
প্রশ্ন হল, যে দেশ নিজ ভূখ-ে দেশের নাগরিকদের নিরাপদে অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে না, সে দেশ কী করে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী নির্মূলের কাল্পনিক অভিযোগে অন্য দেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করে ড্রোন হামলা চালিয়ে কথিত জঙ্গি বা সন্ত্রাসী নির্মূলের প্রয়াস নিচ্ছে? এ ধরনের কাজ আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধের সংজ্ঞানুযায়ী কাপুরুষোচিত। এটি অনেকটা পেছন দিক থেকে ছুরিকাঘাতে আহত বা নিহত করার সমতুল্য। যে কোনো দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ও পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের এ ধরনের ড্রোন আক্রমণ আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর যদি বলা হয়, সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে, সে ক্ষেত্রে কে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী এবং কে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী নয় তা নিরূপণের মাপকাঠি কী? তাছাড়া এ ধরনের হামলায় নারী-পুরুষ-শিশুসহ যে অগণিত বেসামরিক লোকের মৃত্যু ঘটেছে, তার দায় কি হামলাকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র অথবা হামলা চালানোর অনুমতি প্রদানকারী রাষ্ট্রের সরকার নিয়েছে? নিয়ে থাকুক বা না থাকুক, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী আগ্রাসী আক্রমণের কারণে যে কোনো বেসামরিক মৃত্যুর দায় আক্রমণকারী রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। যদিও ক্ষতিপূরণ দ্বারা মৃত্যু পরিমাপ্য নয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কয়টি ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে, এর হিসাব কেউ কি রেখেছে? রাখেনি বলেই বিশ্ব বিবেকের কাছে আজ যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত মানবাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার প্রশ্নবিদ্ধ।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক –