বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে স্বর্ণ চোরাচালান অত্যাধিক বেড়ে গেছে। বিমানবন্দরগুলো দিয়ে যে পরিমাণ স্বর্ণ ধরা পড়ছে প্রতিদিন তা বিশ্ময় সৃষ্টি করছে। আর ধরা না পড়ে কি পরিমাণ স্বর্ণ বেরিয়ে যাচ্ছে তার কোন হিসাবেই নেই। কর্মকর্তারা বলছেন বাংলাদেশে স্বর্ণ চোরাচালান হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে ভারতে স্বর্ণ চোরা চালানের একটি কোরিডোর হিসাবে বাংলাদেশ ব্যবহার হচ্ছে।
বাংলাদেশের বিমানবান্দরগুলো দিয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ আসছে। প্রায় প্রতিদিনই অবৈধ পথে আসা স্বর্ণ ধরা পড়ছে ঢাকা হযরত শাহজালাল এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এই প্রবণতা চলছে প্রায় বছর দু’এক ধরে। সোনা চোরাচালান ঠেকাতে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী এনিয়ে এখন যে বেশ তৎপর সেটা স্পস্ট।
বিষয়টি নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা যায় সেদিনও চোরাই স্বর্ণসহ ১ জনকে আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। এখানে মূলত শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ চোরাচালান বিষয়টি খতিয়ে দেখে। তাদেরকে সহযোগিতা করে এয়ারপোর্ট আর্ম পুলিশ ব্যাটেলিয়ান নামে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের একটি শাখা। বিমান বন্দরে কর্মরত সংস্থাটির সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার মোতাচ্ছের হোসেন জানাচ্ছেন বাংলাদেশে সোনার বড় ধরণের চোরা চালান হচ্ছে সেটা প্রথম বোঝা যায় ২০১২ সালে। যখন প্রথম ১৩ কেজির চোরাই সোনার একটি চালান আটক করা হয়। এর পর থেকেই নিয়মিতহারে সোনা ধরা পড়ছে।
গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসের তৃতয়ি বৃহত্তম সোনার চালান আটক করা হয়, যার পরিমাণ ছিল ১০৫ কেজি। আর বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম ১২৪ কেজি সোনাও আটকের ঘটনাও ঘটে গতবছরই। এসব সোনা এমনভাবে উড়োজাহাজের মধ্যে লুকোনো অবস্থায় পাওয়া গেছে যা খুজে বের করা সহজ সাধ্য ছিল না।
তার পরও কিভাবে ধরা পড়ছে ? জানতে চাইলে মি. হোসেন বলেন, আমাদের কাছে কিছু তথ্য আসে যেমন দুবাই থেকেও অনেক সময় তথ্য আসে যখন তারা স্বর্ণটা কেনে। এরা অনেকগুলো গ্রুপ কাজ করে এবং একটা গ্রুপ অনেক সময় জানিয়ে দেয় যে, এই পরিমাণ স্বর্ণ বাংলাদেশে ঢুকবে। তখন আমরা সেই অনুয়ায়ী একটা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
তথ্য ছাড়া বড় কোন ধরণের চোরাচালান ধরারর অভিজ্ঞতা কি আপনাদের হয়েছে ? জনতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই। ২০১২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম ১৩ কেজি স্বর্ণ কোন ধরণের ইনফোরমেশন ছাড়াই আমরা ধরতে সক্ষম হয়েছিলাম। বোর্ডিং ব্রিজ সংলগ্ন টয়লেটের ভেতর থেকে ১৩ কেজি এবং যাত্রীসহ আমরা ধরেছিলাম। পরবর্তিতে আমরা আরো ধরি ৫ কেজি, ১৫ কেজি, ৭ কেজি এগুলোর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আমাদের কাছে কোন ধরণের ইনফরমেশন ছিল না। আমরা শুধু মাত্র মেনুয়্যাল কিছু কাজ এবং সন্দেহের উপর ভিত্তি করে এই কাজগুলো করেছিলাম।
জানাযাচ্ছে এক শাহজালাল বিমান বন্দরেই ২০১২ সালে সেপ্টেম্বর থেকে গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত ২ মেট্রিকটনেরমত সোনা আটক করা হয়েছে। তবে বিমানবন্দরের দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফাক গোলে কত সোনা বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে তার কোন সঠিক হিসাব নেই।
বিমানবন্দরের ব্যাগেজ নীতিমালা অনুযায়ী একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম স্বর্ণালোঙ্কার বিনা শুল্কে এবং আরো ২০০ গ্রাম স্বর্ণের বার শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে দেশে নিয়ে আসতে পারেন। এই শুল্কের পরিমাণ প্রতি ১০০ গ্রামে ১৩৫০ টাকা। এই সুযোগে একটি বিরাট সংখ্যক প্রবাসী যাত্রী অতিরক্তি মুনাফার আশায় মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে সোনা বহন করে আনছেন। আর এরাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরিণ জুয়েলারি বাজারের স্বর্ণের চাহিদা মেটান। কিন্তু এভাবে স্বর্ণ নিয়ে আসতে হলে বহণকারি যাত্রীকে শুল্ক বিভাগের কাছে স্বর্ণ বহণের ঘোষণা দিতে হয়। কেউ কেউ শুল্ক ফাঁকি দেবার জন্য ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকেন এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফাঁক গোলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পার পেয়ে যান।
কিন্তু শুল্ক বিভাগ থেকে পাওয়া সাম্প্রতিক এই ঘোষণা দিয়ে সোনা আনার তথ্য উপাত্ত দেখে বিষ্ময় জাগে। উপাত্তে দেখা যাচ্ছে ২০১৩ সালে জুলাই মাসে যাত্রীরা ঘোষণা দিয়ে সোনা এনেছেন ২ কেজিরও কম। পরের মাসে এই পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে ১২ কেজি। বাড়তে বাড়তে ডিসেম্বরে গিয়ে ঠেকেছে ২০০ কেজিতে। আর গত এপ্রিল মাসের প্রথম ১০ দিনেই যাত্রীদের আনা ঘোষিত স্বর্ণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০০ কেজি। এই মাসগুলোতে অবৈধ স্বর্ণ আনার পরিমাণও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।
বিমান বন্দর কাস্টমস হাউজের কমিশনার হোসেন আহমেদ বলেন, এত বড় বড় আটক হচ্ছে তার পরেও কিন্তু আমাদের মোট যে আটক মিলিয়ে সর্বমোট ডিক্লিয়ারেশন ফিগার তার মাত্র ৫% এর ও নিচে থাকছে এই আটক। অর্থাৎ সোনা আসছে এ কথা ঠিক। মানুষ জানছে যে আটকের কারণেই আসছে কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি আসছে ডিক্লিয়ারেশনের কারণে। ডিক্লিয়ারেশন বাড়ার একটি অভিয়াস কারণ আমি যেটা মনে করি, সেটা হচ্ছে আমাদের মনিটরিং এবং নজরদারি বেড়ে গেছে। যার কারণে ঝুঁকি কম নিচ্ছে। ডিক্লিয়ার করেই এগুলো বের করে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ এগুলো ডিক্লিয়ার করে যদি বাজারে ছেড়ে দেয়া যায় তাহলে যথেষ্ট লাভ কিন্তু এখনো রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে বৈধ বা অবৈধ পথে সোনা বাংলাদেশে আসছে তার বাজার কোথায় ? প্রথমে খোঁজ নেয়া হয় বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় জুয়েলারি মার্কেট ঢাকার বাইতুল মোকাররমে। এই মার্কেটের একটি সোনার দোকান স্টোন জুয়েলারে বসে কথা হয় মালিক বিশ্বনাথ ঘোষের সাথে। দৈনিক কি পরিমাণ স্বর্ণ বিক্রি করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এখানে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম স্বর্ণ বিক্রি হয়। মাসে তো ২৫ দিন। তাতে ধরেন প্রতিদিন ১ কেজিমত হয়।
কিভাবে পান এই স্বর্ণ জানতে চাইলে বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, আমাদের কাছে কাস্টমাররাই পুরাতন স্বর্ণটা নিয়ে আসে। তার এক্্রচেঞ্জে আমরা বিক্রি করি। তাদের ব্যবহারের জিনিসটা দেখে গেছে ছিড়ে গেছে। আর ব্যবহারের উপযোগী নেই। সে জিনিসগুলি তারা অল্টার করে নিয়ে যায়। এর বাইরে তারা তাঁতি বাজার থেকে রিফাইন স্বর্ণ কারেকশন করেন বলে জানান তিনি এবং এভাবেই তাদের দোকান চলে।
অবশ্য বিভিন্ন সূত্র থেকে যেসব খবরা খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে বাংলাদেশে কাঁচা সোনা অর্থাৎ যে সোন দিয়ে এখনো কোন অলঙ্কার তৈরি হয়নি তেমন সোনার চাহিদা মেটে প্রবাসীদের জন প্রতি আনা ২০০ গ্রাম সোনা দিয়েই।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সভাপতি দিলিপ রায় জানাচ্ছেন, দেশটির দশ হাজারেরও বেশি কিছু দোকানে মাসে দুই হাজার কেজিরমত সোনা বিক্রি হয় বলে ধারণা রয়েছে। আর এই চাহিদার একটি বড় অংশ মেটায় কাঁচা সোনা বা সোনার বার। তিনি আরো বলেন, আমরা বিভিন্ন উপায়ে কাঁচা সোনাটা পেয়ে থাকি। একটা হচ্ছে প্রতিদিনই আমাদের কাছে পুরাতন স্বর্ণের অলঙ্কার আমাদের কাছে রিটার্ন আসে। এগুলো রিাইন করে আমরা নতুন করে স্বর্ণলোঙ্কার তৈরি করি। এভাবে আমাদের একটি চাহিদার আমাদের জোগান হয়। আর আপনারা জানেন যে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বিদেশে চাকুরিতে আছে। তাদের মধ্য থেকে প্রতিদিনই কয়েক হাজার শ্রমিক দেশে আসে আবার চলে যায়। এরা প্রত্যেকেই সরকারের ব্যাগেজগুলোর অধিনে যে ২০০ গ্রাম অলঙ্কার তারা আনতে পারে। এছাড়া তারা ২০০ গ্রাম স্বর্ণের বার তারা আনতে পারে। এটা ১৫০ টাকা ভরি প্রতি ট্যাক্্র দিয়ে। এটাও কিন্তু বিপুল একটা চাহিদা আমাদের মিটিয়ে থাকে।
অবৈধ পথে যে সোনা আসছে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাকি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তার গন্তব্য কোথায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণই বাংলাদেশকে রুট হিসাবে ব্যবহার করছে। এই স্বর্ণগুলি বাংলাদেশের চাহিদাও না বাংলাদেশের জন্যে আসেও না। এদেশকে তারা নিরাপত্তার দুর্বল বলয় বলে মনে করে বলেই এদেশ থেকে আমাদের পার্শবর্তী দেশে চলে যাচ্ছে।
মি. রায়ের এই বক্তব্যকে আর্মড পুলিশের মোতাজ্জের হোসেন এবং কাস্টমস এর কমিশনার হোসেন আহমেদও সামর্থন করছেন। খোজ নিয়ে জানা যাচ্ছে গত বছরের মার্চ মাস থেকে ভারতের সোনা আমদানিতে শুল্ক হার শতকরা ১ ভাগ থেকে বাড়িয়ে শতকরা ১০ ভাগ করা হয়। সেই হিসাবে ভারতের প্রতি ১০০ গ্রাম সোনার জন্য শুল্ক দিতে হয় বাংলাদেশি টাকায় ৩৪ হাজার টাকারমত।
ওদিকে বাংলাদেশে বৈধ পথে আসা সোনাতে প্রতি ১০০ গ্রামের জন্য ১৩৫০ টাকা মাত্র। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সোনার চাহিদা রয়েছে ভারতের বাজারে। ফলে কম শুল্কের বাংলাদেশকে করিডোর হিসাবে ব্যবহার করে ভারতের সোনা পাঁচারের বিষয়টি যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত চৌকিতেও ভারতে পাচারকৃত সোনা আটকের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে এসব চোরা চালানের সাথে কারা জড়িত। একটু খোঁজ খবর করতে একজনকে পাওয়া গেল যিনি মালএশিয়া থেকে সোনা বহণ করে আনেন। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বহণকারি বৈধভাবেই প্রতি সফরেই ২০০ গ্রাম করে সোনা বহণ করে নিয়ে আসেন। কখনো ঘোষণা দেন আবার দেন না। সুযোগ পেলে বৈধ পরিমাণের চেয়ে বেশি সোনাও আনেন তিনি।
এবিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের আমাদের ক্রেতারা হচ্ছে আমরা বায়তুল মোকাররমের দোকানগুলোতে দেই আবার তাঁতি বাজারেও দেই। তারা আমাদেরকে ক্যাশ টাকা প্রদান করেন। এই স্বর্ণ নিয়ে তারা কি করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যা তা জানি এগুলো তারা চালান হবার পর এত সোনাতো আর বাংলাদেশে বিক্রি হয় না। তারা এগুলো ভারতে বিক্রি করে দেয়।
এরা সবাই জুয়েলারি ব্যবসায়ি কিনা এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জুয়েলারি ব্যবসায়ি ছাড়াও অনেক ব্যবসায়ি আছেন যারা টাকা এই খাতে পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসা করেন এবং হুন্ডি খাটিয়ে এদেশ থেকে ভারতে টাকা পাঠান। এরা বিপুল টাকা নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু এদেরকে আমরা কখনই দেখতে পায়না। এরা যাদেরকে দিয়ে কাজ করায় তাদের সাথে আমাদের দেখা হয়। প্রত্যেকবার মাল আনার পর তারা ৫০% নিয়ে নেয় এবং বাকি ৫০% সবার মধ্যে ভাগ করে দেয়। সে এরতম ৪ থেকে ৫ জন মালিকের সাথে কাজ করেন বলে জানান তিনি।
তিনি আরো জানান তারমত বাংলাদেশে হাজার খানেক লোক কাজ করে। তার দলে ৭০ থেকে ৮০ জন কাজ করে বললেন তিনি। ভারতে কিভাবে স্বর্ণ পাঠায় এই প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ভারতেও একটি সিন্ডিকেট আছে। ভারতের যে সমস্ত লোকজনকে ভিসা করে সেখানে পাঠায় তাদের প্রত্যেকে দেখা যায় ৫ কেজি ১০ কেজি করে নিয়ে যায় বডার পর্যন্ত। সেখান থেকে দেখা যায় আবার আরেক গ্রুপ এসে নিয়ে যায়।
এই বহণকারি আরো বলেন, সোনা বহণ করার সময় বিমানবন্দরের অনেক কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগ সাজস থাকে। ১০৫ কেজির যে চালানটি আটক করা হয়েছিল সে সময়ও বিমানের একজন কর্মীকে আটক করা হয়। কাস্টমস কশিশনার মি. আহমেদও বলছেন তারা অনেক সময় স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে বিমানবন্দরের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারিদের যোগ সাজস থাকার প্রমাণ পেয়েছেন। তিনি আরো জানাচ্ছেন এই চোরাচালান বন্ধ করবার জন্য ভারতের সঙ্গে শুল্ক সমন্বয়ের কথাও ভাবছেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও আশঙ্কা রয়েছে। হঠাৎ করে সোনার উপর শুল্ক বাড়িয়ে দিলে তা দেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলবে না তো ? বিবিসি