বাবা হওয়ার অনুভূতি তো অসাধারণই। সেই অনুভূতি প্রকাশে একজন সাধারণ মানুষ কিংবা শচীন টেন্ডুলকারের মতো ব্যক্তিত্ব—কারও কোনো পার্থক্য থাকে না। এ এক অনাবিল পাওয়া। অসাধারণ পুরস্কার। ক্রিকেট-কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের জীবনেও এমন একটা দিন এসেছিল, ১৯৯৭ সালের ১২ অক্টোবর। তাঁর প্রথম সন্তান জন্ম নেওয়ার দিন। সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনী প্লেইং ইট মাই ওয়ে’তে টেন্ডুলকার সেই দিনটির বর্ণনা দিয়েছেন বিশদভাবেই। মেয়ে সারার জন্ম-মুহূর্তের ওই মুহূর্তটি যে তাঁর জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে আছে, সেটা বোঝা যায় আত্মজীবনীতে তা বর্ণনা করার ভাষা থেকেই। ওখানে টেন্ডুলকার কোনো সেলিব্রেটি নন, তিনি ওখানে ভারতরত্ন নন, ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারও তিনি সেখানে নন, ওই জায়গাটিতে তিনি কেবলই একজন বাবা।
কোনো ভনিতা না করেই টেন্ডুলকার বলেছেন, ‘১৯৯৭ সালের ১২ অক্টোবর আমি পেয়েছিলাম আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি।’ মেয়ে সারার জন্ম মুম্বাইয়ে। টেন্ডুলকারের শ্বশুরালয় ব্রিচ ক্যান্ডির অদূরে একটি অভিজাত হাসপাতালে। স্ত্রী অঞ্জলি যখন তাঁর গর্ভকালের অন্তিমে এসে পৌঁছেছেন, তখন অন্য আর দশজনের মতোই টেন্ডুলকার প্রচণ্ড উৎকণ্ঠার মধ্যেই দিন কাটিয়েছেন। ক্রিকেটার হিসেবে জনপ্রিয়তার কারণেই হাসপাতালে স্ত্রীকে নিয়ে গিয়ে সেখানে ভর্তি-সংক্রান্ত কাজগুলো করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেই কাজটা করেছেন প্রসূতিকালীন তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসক অজিত গাজেন্দ্রাগাদকর। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন টেন্ডুলকার তাঁর শিশুকে কোলে নিয়ে আদর করতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও অজিত খুব ভালোভাবেই করে রেখেছিলেন।
সন্তানের জন্মের আগের দিন তাঁর শ্বশুরালয়ের সামনের লনে বন্ধু সুনীল হারশার সঙ্গে কথা বলছিলেন টেন্ডুলকার। তিনি লিখেছেন, ‘আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে আমি আমার বন্ধু সুনীলকে বলেছিলাম, আমি তো বাবা হয়ে যাচ্ছি আর কয়েক ঘণ্টা পরেই। আমার জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের পৃষ্ঠা উলটাব আমি।’
ওই মুহূর্তটিতে অজানা শঙ্কার সঙ্গে টেন্ডুলকারের প্রার্থনা ছিল তাঁর স্ত্রী অঞ্জলি ও অনাগত সন্তানের সুস্থতা। সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে—এ-সংক্রান্ত কোনো চিন্তাই তাঁর মাথায় ছিল না।
পরের দিন চিকিৎসক অজিত টেন্ডুলকারকে ফোন করলেন। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। শিশুর মতো প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠলেন ক্রিকেটের মহাতারকা শচীন টেন্ডুলকার। একটি ভিডিও ক্যামেরা হাতে করে তিনি উপস্থিত হলেন হাসপাতালের মেটারনিটি ওয়ার্ডে।
টেন্ডুলকার বলেছেন, ‘এটা অসম্ভব। ওই মুহূর্তে আমার মনের অনুভূতি কেমন ছিল সেটা সুন্দর ভাষায় গুছিয়ে লেখা বা বলা সম্ভব নয়।’ ততক্ষণে তিনি জেনে গেছেন তাঁর মেয়ে হয়েছে। আত্মজীবনীতে মেয়ে হওয়ার কথাটি তিনি লিখেছেন ঠিক এই ভাষায়, ‘ততক্ষণে আমি জেনে গেছি সৃষ্টিকর্তা আমার ও আমার স্ত্রীর জন্য এক কন্যাসন্তানের আশীর্বাদ পাঠিয়েছেন।’ মেটারনিটি ওয়ার্ডে পুরো সময়েরই ভিডিও তিনি করে রেখেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত ক্যামকোর্ডারে।
ওই মুহূর্তেই তিনি তাঁর মেয়ের নাম রেখেছিলেন। টেন্ডুলকার বলেন, ‘আমি অঞ্জলির কাছে গিয়ে বললাম, আমরা আমাদের মেয়েকে “সারা” নামে ডাকব। নামটি অজিত (তাঁর ভাই অজিত না চিকিৎসক অজিত, সেটা পরিষ্কার নয়) আমাদের বলেছিল বেশ কিছু দিন আগেই। আমরা দুজনেই তা খুব পছন্দ করি।’
সন্তানকে প্রথম কোলে নেওয়ার অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রেও টেন্ডুলকার পুরো আবেগই ঢেলে দিয়েছেন তাঁর আত্মজীবনীতে, ‘যখন ডাক্তার আমাকে সারাকে কোলে নিতে বলল, তখন আমি নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। আমি জীবনেও কোনো সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকে কোলে নিইনি। তার পরও আমি সারাকে আমার দুই হাত জড়িয়ে ধরলাম। সে এক অসাধারণ মুহূর্ত।’
সন্তানের জন্মের দিন স্ত্রী অঞ্জলির পাশে থাকতে চেয়েছিলেন টেন্ডুলকার। কিন্তু হাসপাতালে অঞ্জলির কেবিনে আলাদা কোনো খাটের ব্যবস্থা না থাকায় মেঝেতে ঘুমিয়েছিলেন টেন্ডুলকার, ‘আমি ওই রাতে অঞ্জলির সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেবিনে আলাদা কোনো খাট না থাকায় আমাকে একটা মাদুর এনে দেওয়া হলো, তা-ই সই। আমি রাতে তাতেই ঘুমালাম। কিছু না দিলেও আমি মেঝেতে জায়গা করে নিতাম।’
মেয়ে সারা নাকি জন্মের সময় হুবহু তাঁর মতোই দেখতে ছিল—আত্মজীবনীতে লিখেছেন টেন্ডুলকার। আক্ষেপ করেছেন তাঁর ক্রিকেটীয় ব্যস্ততার কারণে সারার শিশুকালে স্ত্রী অঞ্জলির দিকে সহায়তার হাত বাড়াতে না পারার কারণে। সারাকে ফেলে যেকোনো দীর্ঘ সফরে যাওয়ার সময়ই তাঁর হৃদয়টা নাকি দুমড়ে-মুচড়ে যেত। প্রতিটি সফর শেষে বাড়ি ফিরেই সারার কোনো না কোনো পরিবর্তন লক্ষ করতেন। নিজেকে তাঁর বড় বঞ্চিতই মনে হতো।
Collected
Post by : Shishir Azim Akash