আমজাদ হোসেন প্রথিতযশা চলচ্চিত্র নির্মাতা। এছাড়া চিত্রনাট্যকার, কাহিনীকার, সংলাপকার, গীতিকার, নাট্যকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও কবি হিসেবে পরিচিত। দেশিয় চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক অনবদ্য কুশলী নাম। তিনি নির্মাণ করেছেন বিখ্যাত সব ছবি। যার মধ্যে ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘ভাত দে’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’র মতো সৃজনশীল চলচ্চিত্র রয়েছে।
দেশিয় চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য–সংষ্কৃতি-মূল্যবোধ সংরক্ষণ ও সুস্থধারার বিনোদনমূলক ছবি নির্মাণে নির্মাতাদের সহায়তা ও অনুপ্রেরণা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে একসময় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বাংলাদেশে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বা বিএফডিসি। কিন্তু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ ছয় দশকেরও বেশি সময় পার করেছে। বর্তমানে একদিকে ভারতীয় সিনেমার বাজার আর স্যাটেলাইটের অনুষ্ঠানের প্রভাব, অন্যদিকে দর্শকদের রুচি ও চাহিদার পরিবর্তন ঘটেছে। তারপরও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছে না বিএফডিসি। আর এজন্য বিএফডিসি নিয়ে নির্মাতা, অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের ক্ষোভের অন্ত নেই। বাদ গেলেন না গুণী ব্যক্তিত্ব আমজাদ হোসেনও।
আমজাদ হোসেন মনে করেন, বিএফডিসিতে আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বা ডিজিটাল ও সময়োপযোগী যন্ত্রপাতির নামে কিছুই হচ্ছে না! যা হচ্ছে তাও দায় সারানো কাজের মত। আর বিএফডিসিতে কিছুই নেই। ভঙ্গুর একটি প্রতিষ্ঠানে রুপ নিয়েছে। আমরা ৫৫-৫৬ বছর ধরে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছি। আমার মনে হয়, ডিজিটালের নামে বর্তমানে টেলিফিল্ম হচ্ছে’।
তিনি আরও বলেন, ‘ডিজিটাল একটি কঠিন বিষয়। এর উপর অনেক পড়াশোনার বিষয় রয়েছে। অনেক কারিগরি বিষয়ে জানতে হবে। উদাহরণস্বরূপ একটা কথা বলি আমেরিকার কথা শুনলে সবাই খুশি হয়। ডিজিটাল এখন বাংলাদেশে আমেরিকার মত। কেউ কোন কাজ জানেন না। সবাই শুধু নামটাই জানেন। দক্ষ ও নির্মাণসই পরিচালক হাতেগোনা মাত্র। তারপরও যারা নির্মাণ করছেন সেভাবে দর্শক হৃদয়ে গেঁথে থাকবে এমন ছবিও হচ্ছে না। রাজ কাপুর কিংবা সত্যজিৎ রায় ঘরে ঘরে জন্মায় না। যারা ভাল ছবি নির্মাণ করেন তারা যুগে হয়তো একজন আসেন। আর ওই মানের যদি নির্মাতা না থাকে তাহলে বড় মাপের শিল্পী কি করে তৈরি হবে? নতুন অনেক নায়ক নায়িকা আসছেন কিন্তু তারকা শিল্পী তৈরি হচ্ছে না। এমন ধরনের প্রশ্নের উত্তরে একথাই বললেন এ পরিচালক।
যৌথপ্রযোজনা নিয়েও ভীষণ বিরক্তি তার কণ্ঠে। প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই বললেন, বাংলাদেশে কি এর আগে কখনও কি যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণ হয়নি! এরপর বললেন, ‘ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রির কি অবস্থা, চলছে কি চলছে না? সিনেমা হলগুলো কি অবস্থায় আছে? যৌথ প্রযোজনা এর আগেও হয়েছে। কিন্তু এখন হচ্ছে যাচ্ছে-তাই। আপনি যদি বলিউড থেকে শাহরুখ খানকে নেন, তাহলে বাংলাদেশ থেকে কে তাঁর বিপরিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করবেন? দুই দেশের পরিচালক থেকে শুরু করে কলাকুশলী সমান থাকতে হবে। কিন্তু এখন যৌথ প্রযোজনার নামে হচ্ছেটা কি?
যারা নীতি নির্ধারক তারা যদি বুঝে শুনে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষতি চান তাহলে সেখানে আমার আর কিই বা বলার আছে? আমাদের দেশে সে মাপের কোন শিল্পী নেই, যার ছবি কলকাতা কিংবা ভারতে চলবে। তারকা শিল্পী কি আর একদিনে তৈরি হয়ে যায়? সময়, অভিনয় দক্ষতা, মেধা, শ্রম লাগে। এখনতো একটা বিষয় এমন হয়ে গেছে যে ঘরে ঘরে তারকা! কিন্তু একটা বিষয় দেখেন, কয়জন শিল্পী বা পরিচালক সামাজিক সম্মানটুকু পান। তাদেরকে তো দর্শকরা ঠিকভাবে চেনেনই না। আমাদের সরকার যা ভাল বুঝবেন চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে তাই করবেন। মান-সম্পন্ন পরিচালক ছাড়া কোন ভাল মানের শিল্পী তৈরি হতে পারেন না।
[আমজাদ হোসেন সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৩ সালে একুশে পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার। এছাড়া নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, ভাত দে চলচ্চিত্রের জন্য তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বিভিন্নভাবে ১৫টি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন।]